রবিবার, ০৫ অক্টোবর ২০২৫, ০৮:৩৬ পূর্বাহ্ন

দৃষ্টি দিন:
সম্মানিত পাঠক, আপনাদের স্বাগত জানাচ্ছি। প্রতিমুহূর্তের সংবাদ জানতে ভিজিট করুন -www.coxsbazarvoice.com, আর নতুন নতুন ভিডিও পেতে সাবস্ক্রাইব করুন আমাদের ইউটিউব চ্যানেল Cox's Bazar Voice. ফেসবুক পেজে লাইক দিয়ে শেয়ার করুন এবং কমেন্ট করুন। ধন্যবাদ।

ইমরান খানের ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার নেপথ্যে কি ছিল?

আনিস আলমগীর।

আনিস আলমগীর

৯ এপ্রিল ২০২২ শনিবার রাতে পাকিস্তানের রাষ্ট্র ক্ষমতা আসলে কার হাতে ছিল? কারণ সিভিলিয়ান সরকারের কোনও যন্ত্র তখন কাজ করছিল না। ইমরান খান চাচ্ছিলেন না সেদিনই পদত্যাগ করবেন বা তার বিরুদ্ধে সংসদে আনা বিরোধী দলের অনাস্থা প্রস্তাব পাস হোক। তাই সেদিন বারবার সংসদের অধিবেশন বিরতি দেওয়া হচ্ছিল। স্পিকার এবং ডেপুটি স্পিকার প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানের বিরুদ্ধে অনাস্থা প্রস্তাব হতে দেবেন না বলেছেন কিন্তু শেষপর্যন্ত তাদেরকেই দৃশ্যপট থেকে গায়েব করে দেওয়া হলো। আদালতের বেঁধে দেওয়া আল্টিমেটাম রক্ষা করতে গভীর রাতে, দিন শেষের ১৫ মিনিট আগে স্পিকার অধিবেশনে আসলেন, নিজের পদত্যাগের ঘোষণা দিলেন।

তিনি কি পদত্যাগ করেছেন না পদত্যাগে বাধ্য হয়েছেন? দেশি মিডিয়ার প্রচারণায় তখন বলা হচ্ছে ইমরান খানের চাপে তিনি পদত্যাগ করেছেন কিন্তু বিদেশি মিডিয়ায় খবর বেরিয়েছে যে, আদালত এবং সেনাবাহিনী তখন কার্যত সরকার চালাচ্ছিল বিরোধী দলকে সঙ্গে নিয়ে। পর্দার আড়ালে আদালত এবং সেনাবাহিনীর চাপে স্পিকার আসাদ কায়সারকে সরে যেতে হয়েছিল এবং তাদের নির্ধারিত বিরোধীদলের একজন প্যানেল চেয়ারম্যান আয়াজ সাদিককে দিয়ে অনাস্থা প্রস্তাব পাসের মাধ্যমে ইমরান খানের পিটিআই সরকারের যবনিকা টানা হয়েছে।

বিবিসি উর্দুর খবরে প্রতীয়মান হয় সেইরাতে রাষ্ট্রক্ষমতা আসলে জুডিশিয়ারি এবং মিলিটারির হাতে ছিল, মিলিটারির কারণে ইমরান খান সরকারি বাসভবন ছাড়তে বাধ্য হন, যদিও মিলিটারি প্রশাসন এই খবর অস্বীকার করছে। ইমরান খান অনাস্থা ভোটে বাধা দিয়ে সংবিধান লঙ্ঘন করেছেন, আদালত অবমাননার পথে ছিলেন– সবই সত্য কিন্তু তারও খাঁটি কারণ ছিল, যেটি অনাস্থা প্রস্তাব আসার পর থেকে জনগণকে তিনি অবহিত করেছেন। বলছেন চীন-রাশিয়ার সঙ্গে তার সম্পর্কের কারণে আমেরিকা তাকে ক্ষমতাচ্যুত করেছে।

ইমরানের প্রধান অভিযোগ আমেরিকা ওয়াশিংটনে নিযুক্ত পাকিস্তানের রাষ্ট্রদূতকে বলেছে ইমরান খানকে ক্ষমতা থেকে হটাতে, যা তিনি বিশেষ সাংকেতিক বার্তায় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়েছেন। সেখানে বলা হয়েছে মার্কিনিরা ইমরানকে নিয়ে স্বস্তি পাচ্ছে না। এই ঘটনার পর প্রথমে তার দলের, পরে তার জোটের সদস্যদের বিরোধীরা ‘কিনে নেয়’। তার মতে এই অর্থ দিয়েছে আমেরিকা। তাই তার ক্ষমতাচ্যুতির জন্য ইমরান খান ‘বিদেশি ষড়যন্ত্র’কে দায়ী করছেন। আস্থা ভোটে উৎখাত হওয়ার পর তার সমর্থনে পাকিস্তানের বড় শহরগুলোতে বিশাল-বিশাল মিছিল বের হয়েছে, যা বিজয়ীদের উল্লাস, সমাবেশের চেয়ে অনেক বেশি দৃশ্যমান ছিল।

পাকিস্তানের কোনও প্রধানমন্ত্রীর এই পর্যন্ত তার পাঁচ বছরের মেয়াদ পূরণ করতে পারেননি কিন্তু তারচেয়েও বড় বিষয় হচ্ছে যে এই প্রথম কোনও একজন প্রধানমন্ত্রীকে অনাস্থা ভোটের মাধ্যমে বিদায় দেওয়া হলো, যে নিজে দুর্নীতিবাজ নয়, দুর্নীতিকে নির্মূল করতে চান এবং বিদেশি প্রভাবমুক্ত একটি স্বাধীন পররাষ্ট্র নীতি চেয়েছেন। ইমরান পাকিস্তানের ইতিহাসের দ্বিতীয় প্রধানমন্ত্রী যে পাকিস্তানের রাজনীতিতে মার্কিন হস্তক্ষেপ বন্ধ করতে চেয়েছেন। এর আগে সত্তরের দশকে জুলফিকার আলী ভুট্টো একই কাজ করেছিলেন, ইসলামাবাদে আমেরিকার বার্তা জনতার সমাবেশে ছিঁড়ে ফেলে। অবশ্য এ ধরনের কাজ কূটনৈতিক শিষ্টাচার বহির্ভূত কিনা সেটা নিয়েও বিতর্ক আছে।

এদিকে যেদিন দুর্নীতির দায়ে আদালতে হাজির হতে হয়েছিল সেদিন সেই রাষ্ট্রের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নিয়েছেন মুসলিম লীগ প্রধান শাহবাজ শরিফ। এমন একজন ব্যক্তির প্রধানমন্ত্রী পদে প্রার্থিতার বিরোধিতা করে ইমরান খানের পিটিআই প্রধানমন্ত্রী নির্বাচনে প্রার্থী দিয়েও নির্বাচন বর্জন করে এবং একযোগে সবাই পদত্যাগের ঘোষণা দেন। অসুস্থ আছেন ‘অযুহাত’ দিয়ে শাহবাজকে রাষ্ট্রপতি শপথ পাঠ করাননি, শপথ পাঠ করান সিনেট চেয়ারম্যান। পিটিআই নেতারা বলছেন, পাকিস্তানে বিদেশি অর্থায়নে পরিচালিত এই শাসনব্যবস্থার পরিবর্তনকে কোনোভাবেই বৈধ করা উচিত নয়। পাকিস্তানের সার্বভৌমত্বের লড়াই এখন রাজপথে সিদ্ধান্ত নেবে জনগণ, লুটেরা নয়।

প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হয়েই শাহবাজ শরিফ সংসদে তার বক্তৃতায় ইমরানের ‘বিদেশি সরকার’ তত্ত্ব প্রত্যাখ্যান করেছেন। তিনি বলেন পিটিআই দাবি করছে যে তারা ৭ মার্চ চিঠিটি পেয়েছে কিন্তু আমরা তার আগে থেকেই বৃহত্তর জোট করার জন্য মিটিং করছি। তিনি ঘোষণা করেন যে তিনি নিরাপত্তা সংক্রান্ত সংসদীয় কমিটির একটি ইন-ক্যামেরা ব্রিফিং করতে চান, যেখানে সামরিক নেতৃত্ব, আন্তঃবাহিনী গোয়েন্দা মহাপরিচালক, পররাষ্ট্র সচিব এবং যে রাষ্ট্রদূত চিঠি পাঠিয়েছেন উপস্থিত থাকা উচিত। ‘তাদের সঙ্গে মিথ্যা বলা হয়েছে কিনা তা জাতির জানা উচিত। বিদেশি ষড়যন্ত্রের প্রমাণ পাওয়া গেলে ‘আমি বাড়ি যাব’।

এটা বলার অপেক্ষা রাখে না যে পাকিস্তানের রাজনীতিতে আমেরিকা বরাবরই নাক গলিয়ে আসছে। পাকিস্তান হচ্ছে এমন একটি রাষ্ট্র যার উচ্চবিত্তরা তাদের সম্পদ আমেরিকা কিংবা পশ্চিমা দেশগুলোতে জমা করেছে এবং পাকিস্তানের আমেরিকাপন্থী জেনারেলদের অবস্থাও তাই। পর্যবেক্ষকরা মনে করছেন, যদি পাকিস্তান অর্থনৈতিকভাবে এগিয়ে যায় তাহলে এটি সেই দেশ যে মুসলিম ওয়ার্ল্ডের নেতৃত্ব দিতে চাইবে, তারা ইসলামের অতীত গৌরব ফিরিয়ে আনতে চাইবে যেটি তুরস্কের নেতৃত্বে গত শতকের ত্রিশের দশকে ছিল এবং প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান নিজেও সেই ভাবধারা পন্থী।

পশ্চিমা দেশ থেকে পড়াশোনা করে আসলেও ইমরান খান ধর্মীয় বিষয়ে গোঁড়া, এমনকি গত সাধারণ নির্বাচনের আগে তিনি ব্লাস্ফেমি আইনে আরও কঠিন ধারা প্রয়োগের পক্ষে মত দিয়েছেন, আহমদিয়াদের মুসলিম স্বীকার করেন না। ইমরান ইসরায়েলকে স্বীকৃতি দেওয়ার প্রশ্নে পুরোটাই বিরোধী ছিল, যেখানে সেনাবাহিনী দিতে রাজি ছিল। ইমরান প্যালেস্টাইন ইস্যুতে ওআইসি নেতাদের শক্ত ভাষায় বলেছেন তারা সবাই পরাজিত হয়েছে, তারা কাশ্মিরিদের স্বার্থরক্ষা এবং স্বাধীনতা দিতে ব্যর্থ হয়েছে।

ইমরান খানের বিরুদ্ধে অভিযোগ যে তিনি প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান, মালয়েশিয়ার তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী মাহাথির মোহাম্মদকে নিয়ে একটি মুসলিম ব্লক তৈরি করতে চেয়েছেন, ওআইসির বাইরে যারা মুসলিম দেশগুলোর বৈশ্বিক স্বার্থ দেখবে। হয়তো অনেকের মনে আছে ২০২০ সালে সৌদি আরব ইমরান খানকে মালয়েশিয়ায় মুসলিম কনফারেন্সে যোগ দিতে বাধা দিয়েছিল। এছাড়া ইমরান আফগানিস্তানে মার্কিন হস্তক্ষেপের বিরুদ্ধে ছিলেন, সেখান থেকে মার্কিন সেনা প্রত্যাহারের পর পাকিস্তানে মার্কিন সেনাদের ঘাটি করতে দিতে রাজি হননি, ইমরান যুদ্ধ বিরোধী, আফগানিস্তানে ন্যাটোর সাপ্লাই লাইন ব্লক করে দিয়েছিলেন। আমেরিকা মনে করে ইমরান রাশিয়া সফর করেছে, চীন সফর করেছে, বিশ্ববাজারে ডলারের আধিপত্য কমানোর ‘চক্রান্তে’ জড়িত।

এই সমস্ত বিষয় নিয়ে পাকিস্তানের মিলিটারির সঙ্গেও তার দ্বিমত আছে। জেনারেলরা মনে করছে তারা পররাষ্ট্র নীতিতে ব্যালেন্স হারাচ্ছিল এবং তারা চীনকেও চায় কিন্তু আমেরিকান ব্লক থেকে সরে নয়। সে কারণে হয়তো অতি সম্প্রতি পাকিস্তান সেনা প্রধান রাশিয়া বিরোধী বক্তব্য দেওয়া শুরু করেছেন।

এটা এখন পরিষ্কার যে বিরোধী দলগুলো মিলিটারিকে সঙ্গে নিয়েই তাদের উদ্দেশ্য সাধন করতে পেরেছে। কেউ যদি বলে যে পাকিস্তানের বিরোধী দল নিজস্ব শক্তি বলে ইমরানকে হটিয়েছে সে তাহলে বোকার স্বর্গে বাস করে। এটা পাকিস্তানের রাজনীতিতে অসম্ভব ব্যাপার। সাধারণ জনগণও তা বুঝে। ৯ তারিখ রাতের ঘটনা প্রমাণ করে যে মিলিটারিরা ইমরানের বাসভবনে প্রবেশ করেছিল। বলা যেতে পারে সেটা একটা আইসোলেটেড অপারেশন ছিল, যেটা বিবিসি বলছে, কিন্তু তাদের হস্তক্ষেপ ছাড়া একজন জনপ্রিয় প্রধানমন্ত্রীকে ক্ষমতাচ্যুত করা কোনোভাবেই সম্ভব ছিল না।

ইমরান খান প্রচলিত রাজনৈতিক নেতা নন, যেখানে পাকিস্তানের সিংহভাগ রাজনৈতিক নেতাই ব্যবসায়ী, তাদের সম্পত্তি আছে বিদেশে। সব বিবেচনা করলে পাকিস্তান এমন একজন নেতাকে হারিয়েছে যে সারা বিশ্বে পাকিস্তানকে তুলে ধরতে পারে, যে ছিল পাকিস্তানের গ্লোবাল ফেইস।

সদ্য বিদায়ী প্রধানমন্ত্রীর ইমরান খান দৃশ্যত ষড়যন্ত্রের শিকার, চীন-মার্কিন বিরোধের বলি। আমেরিকার থেকে পাঠানো চিঠি প্রকাশ হলে এটা আরও পরিষ্কার হয়ে যাবে কারা এই ষড়যন্ত্রের সঙ্গে জড়িত এবং কারা এর নেপথ্যে আছে। যদি সেনাবাহিনী ভোটে হস্তক্ষেপ না করে, যা তারা যুগ যুগ করে আসছে, তাহলে আগের সামর্থ নিয়েই তিনি ফিরে আসবেন। আর ক্ষমতা হাতে নিয়েই জনগণের জন্য সুযোগ-সুবিধা দিয়ে যতই চমকদার প্যাকেজ ঘোষণা করুক, চিহ্নিত দুর্নীতিবাজদের জোড়া তালির সরকার বেশিদিন টেকা কঠিন হবে, যদিও এই সরকারের মেয়াদও বেশি দিনের না।

লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট। ইরাক ও আফগান যুদ্ধ-সংবাদ সংগ্রহের জন্য খ্যাত।

anisalamgir@gmail.com

ভয়েস/জেইউ।

Please Share This Post in Your Social Media

© All rights reserved © 2023
Developed by : JM IT SOLUTION