রবিবার, ০৫ অক্টোবর ২০২৫, ০৬:৩১ পূর্বাহ্ন

দৃষ্টি দিন:
সম্মানিত পাঠক, আপনাদের স্বাগত জানাচ্ছি। প্রতিমুহূর্তের সংবাদ জানতে ভিজিট করুন -www.coxsbazarvoice.com, আর নতুন নতুন ভিডিও পেতে সাবস্ক্রাইব করুন আমাদের ইউটিউব চ্যানেল Cox's Bazar Voice. ফেসবুক পেজে লাইক দিয়ে শেয়ার করুন এবং কমেন্ট করুন। ধন্যবাদ।

পহেলা বৈশাখ ও ধর্ম-মূর্খদের তর্জনগর্জন

এ কে এম শাহনাওয়াজ:
ছোটবেলা থেকেই এই হিতবাণী শুনে আসছি, ফলবতী গাছ ফলভারে নুয়ে পড়ে। কিন্তু ফলবিহীন গাছ উদ্ধত ভঙ্গিতে মাথা উঁচু করে থাকে। অর্থাৎ জ্ঞানী অযথা তর্ক করেন না, তার আচরণ হয় বিনীত। আর কপট জ্ঞানী ভড়ং ধরে মূর্খ গলা উঁচিয়ে কথা বলে। প্রতি বছর বৈশাখ এলেই কিছু সংখ্যক ধর্ম-মূর্খ বা জ্ঞানপাপী মানুষ অহেতুকভাবেই নববর্ষ পালন, মঙ্গল শোভাযাত্রা ইত্যাদির বিরুদ্ধে বিষোদগার করতে থাকেন। এসব ইদানীংকালের সংযোজন। অর্থাৎ এই শ্রেণির মানুষ যেন ঢাক বাজিয়ে বলতে চান আমরা এ বিষয়ে মতামত দেওয়ার অধিকার রাখি। তাদের যে কে এই দায়িত্ব দিয়েছে কে জানে। যুগ যুগ ধরে বাঙালি নববর্ষ পালন করে এসেছে। মঙ্গল শোভাযাত্রার সংযোজন অতটা পুরনো নয়। তবে আধুনিক শৈল্পিক রূপ না থাকলেও শত শত বছর ধরে বাঙালি পহেলা বৈশাখে গ্রামেগঞ্জে বৈশাখী মেলা করে আসছে। ব্যবসায়ীরা হাল খাতা করছেন। হিন্দু ব্যবসায়ী পূজাঅর্চনা করে মিষ্টি বিতরণের মাধ্যমে হালখাতার সূচনা করছেন আর মুসলমান ব্যবসায়ী মিলাদ পড়িয়ে মিষ্টি বিতরণ করছেন। এর মধ্যে ধর্মের প্রভাব খুব অল্পই। পুরোটাই বাঙালির লোকজ উৎসব। এ কারণে শত বছর ধরে ইসলামি চিন্তাবিদরা নববর্ষ উদযাপনে ধর্মকে টেনে এনে নিজেদের সংকীর্ণ মনোভাব বা মতলবি বয়ান দেননি। সাম্প্রতিক সময়ে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য সামনে রেখে নিজেদের আলোর সামনে উপস্থাপন করার জন্য পুরনো অন্ধকার পথ ধরে কোনো কোনো মহল হামলে পড়েছে নববর্ষ ও মঙ্গল শোভাযাত্রা নিয়ে। সাধারণ মুসলমানের মধ্যে বিভ্রান্তি ছড়াচ্ছে।

যুগ যুগ ধরে মতলববাজরা ধর্মের ধুয়ো তুলে মানুষের স্বাভাবিক ও নান্দনিক জীবনযাত্রাকে জটিল করে তুলেছে। ধর্মের মঞ্চে নায়ক হতে চেয়েছে।

প্রাচীন খ্রিস্টীয় বিশ্বে রোমের পোপ ধর্ম ও রাজনীতির একাধিপতি হয়ে ধর্মের নাম ভাঙিয়ে নানা ব্যাখ্যা-অপব্যাখ্যা দিয়ে সমাজে বিভ্রান্তি তৈরি করেছিলেন। খ্রিস্টধর্ম তাদের কারণে সৌন্দর্য হারাচ্ছিল। এতে শঙ্কিত হয়ে পড়েছিলেন প্রকৃত ধর্মাচারী খ্রিস্টান সাধুরা। শেষ পর্যন্ত ধর্মকে রক্ষা করার জন্য তারা পোপতন্ত্রকে পরিত্যাগ করে পোপ নিয়ন্ত্রিত গির্জা ছেড়ে নিভৃতে চলে গেলেন। প্রতিষ্ঠা করলেন মঠ। এভাবে মঠতন্ত্র ইউরোপে জনপ্রিয় হয়ে গেল। যেভাবে মরমিবাদী সুফি-সাধকরা বিশ্বময় ইসলাম ধর্ম ছড়িয়ে দিতে পেরেছিলেন। কোনো ঘৃণা বা ফ্যাসাদ ছড়ানো নয়মানুষের প্রতি ভালোবাসা দিয়েই তারা আল্লাহ প্রেম জাগ্রত করেছিলেন। বাংলাদেশে ইসলাম প্রচারে তাই মানবতাবাদী সুফিদের ভূমিকাই ছিল প্রধান। সুফিদের চরিত্র বিভায় মুগ্ধ হয়ে হিন্দু সম্প্রদায়ের উল্লেখযোগ্য অংশ ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছিল। হিন্দু সমাজপতি ব্রাহ্মণ ধর্মগুরুরা কঠিন কঠিন নিয়ম আরোপ করে আর নানা ছুঁতোয় পাপের ভয় দেখিয়ে ধর্মান্তরকরণ রোধ করতে পারেননি। আকৃষ্ট করতে পারেননি সাধারণ হিন্দুদের। বরঞ্চ ধর্মান্তরকরণের গতি আরও বেড়ে যায়। যে কারণে হিন্দু ধর্ম ও সমাজকে রক্ষা করার জন্য ষোল শতকের শুরুতে বাংলায় আবির্ভাব ঘটে শ্রীচৈতন্য দেবের। সাধারণ মানুষের কাছে ফতোয়াবাজ (সমাজ বিধানের নামে মানুষকে নিপীড়িত করা) ব্রাহ্মণরা ততক্ষণে অনেকটাই পরিত্যাজ্য। সুফি দর্শনের আলোকে ঈশ্বর প্রেমের সঙ্গে মানবপ্রেমের বাণী ছড়িয়ে সাধারণ হিন্দুদের আকৃষ্ট করতে পেরেছিলেন চৈতন্যদেব। ফলে তার হাতেই ধর্মান্তরকরণের গতি হ্রাস পেয়েছিল। সব ধর্মই প্রকৃত অর্থে মানবকল্যাণকামী। এ কারণে অমানবিক চিন্তার ধারক মৌলবাদী ব্রাহ্মণরা সাধারণ হিন্দুর মন থেকে দূরে সরে যায়।

ইতিহাসের পারম্পর্যের দিকে তাকালে বাঙালির ওপর বৈষম্য চাপিয়ে দেওয়া পাকিস্তানি শাসকদের সঙ্গে আজ যারা নববর্ষ পালনের মধ্যে ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতার গন্ধ খুঁজে বেড়ান তাদের খুব ঐক্য দেখতে পাই। ব্রাহ্মণ সেন রাজাদের মতো পাকিস্তানি শাসকরাও বিদ্রোহী বাঙালিকে ভয় পেয়েছিল। ভয় পেয়েছিল বাঙালির সাংস্কৃতিক শক্তিকে। উভয়েই বাঙালিকে দমিয়ে রাখতে চেয়েছে ধর্মের দোহাই দিয়ে। ধর্মের নামে নিজেদের মনগড়া ব্যাখ্যা দিয়েছে। ব্রাহ্মণ সতর্ক থেকেছে সাধারণ হিন্দু যেন ধর্মের প্রকৃত বাণী জানতে না পারে। তাই সংস্কৃত ভাষায় রচিত ধর্মগ্রন্থ পড়া শূদ্র হিন্দুদের জন্য নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছিল। বলেছিল সংস্কৃত দেবতার ভাষা, প্রাকৃতজন পড়লে মহাপাতকের কাজ হবে। তাদের জন্য ঈশ্বর চরম শাস্তি রেখেছে। একইভাবে পাকিস্তানি শাসকরা শুরু থেকেই সতর্ক থেকেছে পবিত্র কোরআনের বাণী যাতে বাঙালির হৃদয়ঙ্গম না হয়। তা হলে ধর্মের নাম ভাঙিয়ে শোষণ করা যাবে না। কোরআন শরিফ সাধারণ বিবেচনায় ধর্মীয় সংবিধান। এই মহাগ্রন্থে রয়েছে বান্দার প্রতি আল্লাহর আদেশ ও নির্দেশনামা। তাই কোরআন জানা ও তা মানা মুসলমানের কর্তব্য। কিন্তু কার্যকারণ সূত্রে ধারণা করা যায় কোরআন জানা থেকে সুচতুরভাবে বাঙালিকে দূরে সরিয়ে রাখার চেষ্টা করা হয়েছে। যেমনটি করেছিল ব্রাহ্মণরা। আধুনিক যুগে যেভাবে কোরআন-হাদিস জানার সুযোগ হয়েছে তেমনটি আগে ছিল না। তাই মসজিদের ইমাম সাহেব বা মাদ্রাসায় পড়া হুজুর যেভাবে নামাজ আদায় করা এবং কোরআন শরিফ পড়া শিখিয়েছেন তা-ই বিনা যুক্তিতে মানতে হয়েছে। যিনি শিখিয়েছেন তার ধর্মীয় বোধ কতটা গভীরে তা জানার প্রয়োজন কেউ অনুভব করেনি। রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে এসব আলেমের ভেতর সূক্ষ্মভাবে যে বিশ্বাস ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে সেভাবেই তারা সাধারণ মানুষকে প্রভাবিত করেছেন। ফলে সফলভাবেই কোরআন শরিফ তেলায়াতের সঙ্গে অজু, পবিত্রতা, গিলাফের ভেতর পবিত্র গ্রন্থ রাখা, রেহালে রেখে তাজিমের সঙ্গে পড়া এসব অধিক গুরুত্ব দিয়ে কোরআন শরিফকে সহজ ব্যবহার থেকে দূরে সরিয়ে রাখা হয়েছে। অন্ধের মতো বা ভক্তির সঙ্গে পড়ে সওয়াব পাওয়ার কথা বলা হলেও কোরআনের বাণী জানা ও উপলব্ধির কথা তেমনভাবে বলা হয়নি। কিন্তু আমরা জানি মুসলমানের জন্য কোরআন ধর্মীয় সংবিধান। প্রত্যেক মুসলমানের কোরআন জানা ও সেই মতো মানা কর্তব্য। কিন্তু সতর্কভাবে সেই পথে হাঁটতে দেয়নি পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী।

পাকিস্তান ছিল সাংবিধানিকভাবে ‘ইসলামি প্রজাতন্ত্র’। সরকারি প্রতিষ্ঠান হিসেবে ‘ইসলামি একাডেমি’ প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। সরকারের দায়িত্ব ছিল এই প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে বাংলাভাষায় আল কোরআনের তাফসির প্রকাশ করা। কিন্তু আইয়ুব খানদের একই ভীতি ছিল। প্রকৃত ধর্মকথা জানতে পারলে বাঙালি তাদের অন্যায় শোষণের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী হবে। অথচ বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর বঙ্গবন্ধু ইসলামি একাডেমিকে ‘ইসলামিক ফাউন্ডেশনে’ রূপান্তর করলেন। আর এই প্রতিষ্ঠান থেকে প্রকাশিত হলো বহুখন্ডে কোরআনের বাংলা তাফসির ‘মারেফুল কোরআন।’

ভাষা আন্দোলনকে ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করতে ধর্মের বিকৃত ব্যবহার করল পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী। বলা হলো ‘বাংলা’ হিন্দুর ভাষা আর উর্দু ইসলামের ভাষা। একইভাবে একাত্তরে গণহত্যার সময় পাকিস্তানি সৈন্যদের মগজ ধোলাই করে জানানো হয়েছে পূর্বপাকিস্তানের মানুষরা কাফের। এদের খতম করা ইমানি দায়িত্ব। স্বাধীনতার পর অনেক বছর পর্যন্ত এদেশে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ক্ষমতা প্রত্যাশী তথাকথিত আলেম সম্প্রদায়কে তেমনভাবে দেখা যায়নি। মানুষের মধ্যে বিভেদ ছড়ানো আর ফিতনা-ফ্যাসাদ তৈরি করায় ব্যস্ত তেমন সম্প্রদায়ের ভূমিকা স্পষ্ট ছিল না। এখন সুবিধাবাদী তেমন গোষ্ঠী বেশ সক্রিয়। তাই পহেলা বৈশাখের মঙ্গল শোভাযাত্রা ফ্যাসাদ সৃষ্টির উপলক্ষ হয়। শোভাযাত্রায় থাকা প্যাঁচা, পাখি আর পশুর মডেলে তারা হিন্দুয়ানি খুঁজতে থাকে। মূর্তিপূজার সঙ্গে তুলনা করে। ভাবখানা আবহমান বাংলায় লক্ষ্মীদেবীর বাহন ছাড়া প্যাঁচার অস্তিত্ব নেই। তবে তো বাঙালির সংস্কৃতি থেকে, প্রতিদিনের জীবন থেকে প্যাঁচা, রাজহাঁস, হাতিএসব পশুপখিকে নির্বাসন দিতে হয়। কারণ হিন্দু ধর্ম মতে এসব পশুপাখি কোনো না কোনো দেবদেবীর বাহন। যারা মূর্তি, ভাস্কর্য ও প্রতীকী চিত্রের পার্থক্য বুঝে না বা বুঝতে চায় না তাদের সঙ্গে তর্ক করা বৃথা। কোন বাঙালি মুসলমান আছে যারা মঙ্গল শোভাযাত্রার এসব পশুপাখির মডেল দেখে দেবতা জ্ঞান করে পূজা দেন? ধর্মের প্রধান ভিত্তি ইমান। সাধারণ বাঙালি মুসলমানের ইমানের ভিত্তি শক্ত বলে এসব তাদের ছুঁয়ে যায় না। তারা প্যাঁচাকে প্যাঁচাই দেখে দেবীর বাহন হিসেবে দেখে না। যাদের দুর্বল ইমান তারাই অকারণে হায় হায় করে।

একুশ শতকের এই মুক্তবুদ্ধি চর্চার যুগে যদি ৮-৯ শতকের রোমান পোপদের মতো, ১২-১৫ শতকের কট্টর ব্রাহ্মণদের মতো, পাকিস্তানি শাসকদের মতো নিজেদের সুবিধাকে কুক্ষিগত করার জন্য মনগড়া ধর্মের ব্যাখ্যা করে আর ভীতি ছড়িয়ে বাঙালিকেবাঙালি মুসলমানকে নিজেদের আজ্ঞাবহ করার চেষ্টা করা হয় তবে তা তো বুমেরাং হয়ে তাদের কাছেই ফিরে যাবে। এদের নিকৃষ্ট আচরণ সামাজের স্বাভাবিক ছন্দে মাঝে মধ্যে সংকট তৈরি করতে পারে তবে সুবিধার ফসল খুব একটা ঘরে তোলা যাবে না। ব্রাহ্মণরা সাধারণ হিন্দুর জন্য ধর্মগ্রন্থ পড়া নিষিদ্ধ ঘোষণা করে সত্য থেকে দূরে সরিয়ে রেখে খবরদারি করতে চেয়েছিল। কিন্তু স্বঘোষিত তথাকথিত ইসলামি নেতাদের বিভ্রান্তিকর বক্তব্য ছড়িয়ে এখন কোনো লাভ হবে না। কারণ ধর্মগ্রন্থ জানা ও উপলব্ধি করার শিক্ষা-জ্ঞান এদেশের অনেক মানুষেরই আছে। সুতরাং মতলববাজদের কোন কথা পরিত্যাজ্য হবে তা বোঝার ক্ষমতা অনেকেরই আছে। সতর্ক থাকতে হবে জ্ঞানমূর্খ ও জ্ঞানপাপীদের তর্জন-গর্জনে সমাজে যাতে কোনো ক্ষত তৈরি না হয়।

লেখক অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়

shahnawaz7b@gmail.com

Please Share This Post in Your Social Media

© All rights reserved © 2023
Developed by : JM IT SOLUTION