রবিবার, ০৫ অক্টোবর ২০২৫, ০৬:৩১ পূর্বাহ্ন
আহসান বাট:
ব্যাপারটা কিছুটা অদ্ভুতই দেখায়। কারণ পার্লামেন্টে অনাস্থা ভোট, সুপ্রিম কোর্টে জরুরি শুনানি, সরগরম বক্তৃতাবাজি, রহস্যময় হেলিকপ্টার আর সদ্য সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান এবং সামরিক ও গোয়েন্দা প্রধানদের মধ্যে মধ্যরাতের গোপন বৈঠকের মতো এত কিছুর পরও এই সপ্তাহে পাকিস্তানে মৌলিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ কিছুই বদলায়নি। ইমরান খানের সরকার থেকে বিরোধী জোটের হাতে ক্ষমতার এই রূপান্তরটি নিছক অভিজাতমহলের ক্ষমতার লড়াইয়ের পরিণতি, তা কোনো গণভিত্তিক সংগ্রামের ফল নয়। সামরিক বাহিনী ইমরানকে সমর্থন করার পুরনো জায়গা থেকে সরে গিয়ে নিরপেক্ষতা ঘোষণা করে। পার্লামেন্টের তথাকথিত ‘নির্বাচনযোগ্য’ ব্যক্তিরা করেন পক্ষ পরিবর্তন। হঠাৎ করে বিরোধীদের অনুকূলে চলে আসে সংখ্যা। আর ছুঁ মন্তরে ইমরান খান গায়েব! অন্তত আপাতত। ইমরান খানের অপসারণে জনগণের অংশগ্রহণের অভাবের কারণে, তার তথাকথিত ‘হাইব্রিড শাসনের’ সবচেয়ে গুরুতর দোষগুলোকে (রাজনৈতিক কর্মীদের গুম হওয়া, মিডিয়ার স্বাধীনতা হরণ, প্রতিপক্ষকে কারাগারে পোরা ও হয়রানি, ধর্মীয় উগ্রপন্থিদের ব্যাপক সুযোগ দেওয়া ইত্যাদি) চ্যালেঞ্জ করা হলো না। সুতরাং কাঠামোগত সংস্কার ছাড়া গত সপ্তাহান্তের ঘটনাগুলো একটি দেশের জন্য স্রেফ টাইটানিকের ডেক চেয়ারগুলো নতুন করে সাজানোরই সমতুল্য হবে। এ দেশের তামাশায় পর্যবসিত রাজনৈতিক দৃশ্যপটের সঙ্গে এর প্রকৃত চ্যালেঞ্জ, হুমকি এবং সম্ভাবনার কোনো সংগতি নেই।
সামরিক কর্র্তৃপক্ষের জন্য শিক্ষা
গত সপ্তাহের ঘটনাপ্রবাহের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পাঠটি হওয়া উচিত সেনাবাহিনীর জন্য। আশা করা যায়, তারা রাজনীতি নিয়ে ইঞ্জিনিয়ারিং বন্ধ করবে। সংবিধান বহির্ভূত কলাকৌশলের বৈধতা বা নৈতিকতাকে বাদ দিয়েই বলা যায়, তাদের ট্র্যাক রেকর্ড অত্যন্ত খারাপ। অর্ধ শতাব্দী আগে, সামরিক স্বৈরশাসক আইয়ুব খান উদীয়মান রাজনৈতিক তারকা জুলফিকার আলি ভুট্টোকে তার আনুকূল্যের আওতায় নিয়ে আসেন। ১৯৭০-এর দশকের গোড়ার দিকে শেখ মুজিবুর রহমান এবং তার বাঙালি জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের সঙ্গে ভারসাম্য বজায় রাখার জন্য ভুট্টোই ছিলেন ‘এস্টাবলিশমেন্টের’ (প্রভাবশালী পাক সামরিক-বেসামরিক-গোয়েন্দা চক্র) পছন্দ। কিন্তু দুপক্ষের সখ্য ভেঙে গিয়েছিল খুব খারাপভাবে। ১৯৭৭ সালে জেনারেল জিয়াউল হকের অভ্যুত্থানে ভুট্টো ক্ষমতাচ্যুত হন। জিয়ার শাসনামলেই ভুট্টোকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছিল। এরপর ১৯৮০ এর দশকে নওয়াজ শরিফের উত্থান। তখন তিনি এক উঠতি শিল্পপতি। সে দশকের শেষের দিকে ‘বিপজ্জনক’ বেনজির ভুট্টোকে মোকাবিলা করার জন্য নওয়াজ শরিফ ছিলেন এস্টাবলিশমেন্টের পছন্দ। এ জুটির বিচ্ছেদও হয় বাজেভাবে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে রাজনীতিতে সেনাবাহিনীর ভূমিকার বিরুদ্ধে সবচেয়ে উচ্চকণ্ঠ ছিলেন সেনা অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত নওয়াজই। এলো ইমরান খানের পালা। সেনাবাহিনী ২০১০ এর দশকের শুরুতে তার সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা গড়ে তোলে। তারা ইমরান ও তার দল পাকিস্তান তেহরিক-ই-ইনসাফ (পিটিআই)-কে ব্যবহার করল পাকিস্তান পিপলস পার্টির (পিপিপি) সরকার এবং রাজপথে থাকা পাকিস্তান মুসলিম লীগ-নওয়াজকে (পিএমএল) চাপ দিতে। ২০১৮ সালে ব্যাপকভাবে কারচুপি হওয়া বলে বিবেচিত একটি নির্বাচনের মাধ্যমে ইমরানকে ক্ষমতায় বসানো হলো। কিন্তু ঝানু পর্যবেক্ষকরা জানতেন ঠিক কীভাবে এই নাটকটি শেষ হবে ঠিক গত সপ্তাহের মতোই ক্ষোভ, অশ্রু এবং নিন্দার মধ্য দিয়ে। গল্পটা একই রয়ে গেছে। জেনারেলরা স্বস্তিতে ‘কায়কারবার’ করতে পারবেন এমন কাউকেই মদদ দেন। কারণ তারা জনপ্রিয় বিকল্পকে হুমকি মনে করেন। এক দশক বা তার কিছু পরে আরেকজন ভিন্ন জেনারেল আবিষ্কার করেন তার পূর্বসূরিরা ভুল ছিলেন। ‘জুনিয়র পার্টনার’ প্রথমে যতটা মনে হয়েছিল আসলে ততটা নমনীয় নয়। সুতরাং ক্ষমতার লড়াই শুরু হয়। সামরিক বাহিনীই তাতে জয়লাভ করে এবং বেসামরিক ব্যক্তিটি ক্ষমতাচ্যুত হন। ওই বেসামরিক ব্যক্তিটিকে হত্যা না করে স্রেফ কারারুদ্ধ বা নির্বাসিত করা হলে তিনি অবশেষে নিজের গণতান্ত্রিক গুরুত্ব ও পরিচয় আবিষ্কার করেন। আর শুরু করেন সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে রাজনীতি। আবার ঘনিয়ে আসে পরবর্তী ‘সুপুত্রের’ পালা। এতদিনে পাকিস্তানি সামরিক এস্টাবলিশমেন্টের শিক্ষাটা স্পষ্ট হয়ে যাওয়া উচিত। রাষ্ট্র ও সরকার ব্যবস্থাকে নিজের মতো চলতে দিন। সামরিক বাহিনীর প্রক্রিয়া সম্পূর্ণ অন্যরকম। তারা বহুদলীয় গণতন্ত্রের অন্তর্নিহিত প্যাঁচ এবং গোলমেলে ব্যাপারগুলো ঠিক বুঝতে পারে না। গত সপ্তাহের চরম বিশৃঙ্খলা যদি একটি বিষয়ও দেখিয়ে থাকে তা হচ্ছে এই হস্তক্ষেপের নীতির স্থপতিরা জানেন না কীভাবে শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা করতে হয়। পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ এবং বাহ্যিক নিরাপত্তার জন্য ইতিমধ্যেই যথেষ্ট নিরাপত্তা হুমকি রয়েছে। এর সামরিক বাহিনী ও গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর নির্বাচন বা রাজনৈতিক দলের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার কোনো অবকাশ আসলে নেই।
পেছনে ফিরে যাওয়া
সামরিক বাহিনীর সঙ্গে ইমরান খানের খাতির পাকিস্তানকে তার রাজনৈতিক বিকাশের ক্ষেত্রে ৩০ বছর পিছিয়ে নিয়ে গেছে। কীভাবে, সেটা বোঝার জন্য আমাদের পিছিয়ে যেতে হবে। একুশ শতকের শুরুতে পারভেজ মোশাররফের সামরিক কর্র্তৃত্ববাদী সরকার ক্ষমতায় ছিল। দুই প্রধান দল পিএমএল-এন এবং পিপিপি পূর্ববর্তী দশকটি কাটিয়েছে সেনাবাহিনীর চাওয়া অপ্রিয় কাজ করার জন্য অদলবদল হয়ে। একটির বিষয়ে ক্লান্ত হয়ে অন্যটিতে গিয়েছে সেনাবাহিনী। এর মধ্যেই ২০০৬ সালে মোশাররফ ক্ষমতার শীর্ষে থাকার সময় দুই প্রধান দলের নেতা নওয়াজ শরিফ ও বেনজির ভুট্টোর (উভয়েই তখন নির্বাসিত) মধ্যে ‘গণতন্ত্র সনদ’ স্বাক্ষরিত হয়। ওই দলিলটি এক মৌলিক পরিবর্তনের সূচনা করবে বলে মনে করা হয়েছিল। অন্যান্য বিষয়ের মধ্যে দুই নেতা প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, সামরিক বাহিনী অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি করলে বা নির্বাচিত সরকারকে উৎখাত করলে তার সঙ্গে হাত মেলাবেন না। অনেক নিন্দুকই ওই চুক্তিকে নিছক নাটক বলে উড়িয়ে দিয়েছিলেন। কিন্তু এরপর যা ঘটে তা ছিল পাকিস্তানের রাজনৈতিক ইতিহাসের একটি গুরুত্বপূর্ণ পর্ব। পারভেজ মোশাররফকে অপসারণের পরের সময়কালে (২০০৮-২০১৩) অষ্টাদশ সংশোধনীর মতো বড় অর্জন এসেছিল, যা পাকিস্তানের পার্লামেন্টকে বরখাস্ত বা বিলুপ্ত করার বিরুদ্ধে শক্তিশালী সুরক্ষা দেয়। একটি সর্বনাশা বন্যা, বৈশ্বিক মন্দা এবং তালেবানের বিরুদ্ধে ধ্বংসাত্মক যুদ্ধের মাধ্যমে পিপিপি সরকার পিএমএল-এন-এর হাতে শাসনক্ষমতা হস্তান্তর করে। সেবারই পাকিস্তানের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো জাতীয় পরিষদ তার মেয়াদ শেষ করে। রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা একটি দেশ গণতন্ত্রাতিক হিসেবে যোগ্য কিনা তা বিবেচনা করার জন্য টানা দ্বিতীয় দফা অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন হয়েছে কিনা সেদিকে নজর দেন। শুধু প্রথম দফা নয়। পণ্ডিতদের মতে, একটি নির্বাচিত সরকার থেকে অন্য সরকারে ক্ষমতার শান্তিপূর্ণ এবং পূর্বাভাসযোগ্য স্থানান্তরই একটি রাষ্ট্রকে প্রকৃত গণতন্ত্র হিসেবে চিহ্নিত করে। প্রজাতন্ত্র হিসেবে জন্মের পঁয়ষট্টি বছর পর অবশেষে পাকিস্তান তা অর্জন করে। পিএমএল-এন-এর আমলে (২০১৩-২০১৮) পিপিপি অনুগত বিরোধীদলের ভূমিকা পালন করে কমবেশি প্রতিদান দিয়েছিল। সামরিক বাহিনী অস্থির থাকলেও তাল মেলানোর জন্য বড় কোনো পক্ষ না থাকায় তার চিরাচরিত কৌশলে মেতে উঠতে পারেনি। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মতো বিদেশি শক্তি সাময়িকভাবে সুবিবেচক হয়ে সামরিক বাহিনীকে ইঙ্গিত দিয়েছিল, তারা আর আগের মতো প্রকাশ্য হস্তক্ষেপ সমর্থন করবে না। এসব কারণে সত্যিকারের আশাবাদ জেগেছিল, পাকিস্তান একটি সামরিক কর্র্তৃত্ববাদী রাষ্ট্র হিসেবে তার ইতিহাসকে পেছনে ফেলে এগিয়ে যাওয়ার দিকে পদক্ষেপ নিয়েছে। কিন্তু অগ্রগতির গতি সবসময়ই ছিল ক্ষীণ। ইমরান খান যেন হয়ে উঠলেন পদ্মবনে মত্ত ষাঁড়। পাকিস্তানের রাজনীতির তৃতীয় শক্তি হয়ে ওঠা ইমরান ও তার পিটিআই গণতান্ত্রিক নীতি-আদর্শের বিন্দুমাত্র পরোয়া করেননি। সামরিক বাহিনী ও গোয়েন্দা সংস্থার সঙ্গে অংশীদারত্বের ব্যাপারে তার আগ্রহের (যা অন্য প্রধান দলগুলো তখন বর্জন করেছিল) ফলাফল হচ্ছে, বেসামরিক-সামরিক ফ্রন্টে পাকিস্তানের অতি কষ্টে অর্জিত অগ্রগতি একজন ব্যক্তির অহমিকার জন্য নষ্ট হয়ে গেল। পাকিস্তান সেই কাক্সিক্ষত টানা দ্বিতীয় তুলনামূলকভাবে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনটি পেলেও তৃতীয়বার তা পেল না।
দল ও গণতন্ত্র
২০১৮ সালের সাজানো নির্বাচন এবং এর আগে যা কিছু হয়েছিল, তা হয়তো পিএমএল-এন আর পিপিপিকে শত্রুকে ‘হারাতে না পারলে তাদের দলে ভিড়ে যান’-এ আদর্শে বিশ্বাসী করে তুলেছিল। ইমরান খানকে সরানোর জন্য চলতি বছর সেনাবাহিনীর সঙ্গে বোঝাপড়ায় আসার মাধ্যমে পিপিপি এবং পিএমএল-এন ঘড়ির কাঁটা ১৯৯০ এর দশকে ফিরিয়ে নিয়ে গেল। মলিন ‘গণতন্ত্র সনদটির’ যা কিছু অবশিষ্ট ছিল তা-ও কার্যত ছুঁড়ে ফেলা হলো আঁস্তাকুড়ে। এই পশ্চাদপসরণ পাকিস্তানের প্রধান দলগুলোর আদর্শিক অঙ্গীকারের অভাবের এক জাজ¦ল্যমান প্রমাণ। ইমরান খান ও তার দল পিটিআই আসলে এখন ক্ষমতার বাইরে থেকেই হয়তো গণতন্ত্র এবং বেসামরিক প্রাধান্যের বেশি ক্ষতি করতে পারে। সেটা হবে যদি ইমরান এভাবেই তার লড়াই চালিয়ে যেতে চান। ইমরান এখন ষড়যন্ত্রের অভিযোগ তুলে আমেরিকাবিরোধী ফর্মুলায় ভর করে এগোচ্ছেন। দেশের ভেতরের পরিবর্তে বাইরের লোকদের ওপর দোষ চাপাচ্ছেন। কিন্তু তিনি যদি আসলে যাদের দায়ী মনে করেন সরাসরি সেই জেনারেলদের নাম বলতেন তাহলে এই গোলমাল থেকে পাকিস্তানের গণতন্ত্রের কিছু লাভ হলেও হতে পারত। পিটিআই-এর সামাজিক ভিত গড়ে উঠেছে প্রধানত শহুরে মধ্যবিত্ত আর অভিজাত শ্রেণিকে নিয়ে। পাকিস্তানে ঠিক এ শ্রেণিগুলোই ঐতিহাসিকভাবে রাজনীতিতে সেনাবাহিনীর হস্তক্ষেপকে দৃঢ়ভাবে সমর্থন করে এসেছে। ইমরান খান স্পষ্টভাবে সেনাপ্রধান বাজওয়াকে উল্লেখ করে কথা বললে ওই শ্রেণিটি ইমরানপন্থি এবং সেনাপন্থি দলে রূপ নিতে পারে। এটি হয়তো সবার অজান্তেই গণতান্ত্রিক সংস্কারের বীজ বপন করতে পারে। ইতিমধ্যেই লক্ষণ দেখা দিয়েছে যে, পিটিআই-এর মূল ভিত থেকে রাজনীতিতে সেনাবাহিনীর ভূমিকা নিয়ে সংশয় বাড়ছে। এই ধরনের বিভাজন শেষ পর্যন্ত সহিংসতায় পর্যবসিত না হলে সৌভাগ্যক্রমে দীর্ঘমেয়াদে পাকিস্তানের স্বার্থের অনুকূলই হতে পারে।
আলজাজিরা অনলাইন থেকে ভাষান্তর :
লেখক যুক্তরাষ্ট্রের ভার্জিনিয়ার ম্যাসন ইউনিভার্সিটির পলিসি অ্যান্ড গভর্নমেন্ট বিষয়ের সহযোগী অধ্যাপক
ভয়েস/আআ