রবিবার, ০৫ অক্টোবর ২০২৫, ০৬:৩৬ পূর্বাহ্ন

দৃষ্টি দিন:
সম্মানিত পাঠক, আপনাদের স্বাগত জানাচ্ছি। প্রতিমুহূর্তের সংবাদ জানতে ভিজিট করুন -www.coxsbazarvoice.com, আর নতুন নতুন ভিডিও পেতে সাবস্ক্রাইব করুন আমাদের ইউটিউব চ্যানেল Cox's Bazar Voice. ফেসবুক পেজে লাইক দিয়ে শেয়ার করুন এবং কমেন্ট করুন। ধন্যবাদ।

মুক্ত উদ্যানে শকুনের থাবা

উম্মুল ওয়ারা সুইটি:

হায় কিশোর-কিশোরী! হায় তরুণ-তরুণী! শহর কেন গ্রামেও আর আমাদের চুপচাপ বসে থাকবার, ভাবনার জগতে হারিয়ে যাওয়ার কোনো জায়গা নেই। ঘরের সঙ্গে লাগোয়া ঘর। খোলা মাঠ রক্তচক্ষুর দখলে। কিশোর মন চিৎকার করবে কই, আর কোন মাঠেই বা ঘুরে বেড়াবে দামাল ছেলেমেয়েরা?

প্রকৃতিতে কিশোর-কিশোরী মনে একটা উড়ন্ত পাখি খেলা করে। কত গল্প কত স্বপ্ন কত কথা মনের মধ্যে খেলে। অচেনা কত বিষয় শরীরে মনে বয়ে যায়। একটা খোলা মাঠ, একটা প্রান্তর, একটা খোলা জায়গা সেই অনুভূতির কথাগুলো সযতনে লালন করে। বাতাসে বাতাসে কানাকানি, সেই কথা ধাক্কা খায় ফুলের গায়ে, মধুর ছায়ে। আমি জানি, দুরন্তপনার দিনে মন কেমন করে। ছেলেমেয়েরা গলাগলি করে জানান দেয় দুয়ারে কৈশোর আর সামনেই তারুণ্য। কত কিছু নিয়ে যে আগ্রহ ছিল তা বোঝানো যাবে না। স্কুলের বড় দিঘির পাড়ে রেইন্ট্রি গাছের তলায় কতদিন গলাগলি করে বন্ধুরা আড্ডায় মেতেছি। খোলা আকাশের খোলা সমাজে পাখির মতো উড়েছি।

ছেলেমেয়ে, আগানা-বেগানা কিছুই তো ছিল না! শরীরের পরিবর্তন আর মনের পরিবর্তন কোনোটাই আর অজানা থাকে না আমাদের। শহরতলির পার্কের সব ধুলো জানে পাখিদের ডানা গজাচ্ছে। অবশ্য, আমাদের কৈশোর-তারুণ্যের সেই সময়টায় ডিবি পুলিশের কনস্টেবল বা নাজমুলের মতো পুলিশ কিংবা পার্ক-উদ্যানের গার্ডরা এখনকার ‘অতি দায়িত্ববান’ ছিলেন না। আবার সমাজে এত অপরাধপ্রবণতাও ছিল না।

এখন তো চাপ ধাপ আর ভাপে দুরন্ত পাখিদের মধ্যেও শকুনের বাস খুঁজে পাই।

১. আর্য, অনার্য, পুরাতন, সনাতন, ধর্ম-বর্ণ-জাতপাত সব নিয়েই ছিল আমাদের বৈশাখ। গত তিরিশ বছরে মৌলবাদ আর সাম্প্রদায়িকতা আমাদের এমন উৎসবগুলোতে হানা দেওয়ার প্রস্তুতি নেয়। দিয়েছেও কয়েকবার। আমরা হারিয়েছি অনেক। গত দুই বছর করোনায় কোনো উৎসব-আয়োজনের সুযোগ ছিল না। ঘরে ঘরে ঘাড় নিচু করে শৈশব আর তারুণ্য ডুকরে কেঁদেছে মহামারীতে। এবার করোনা যায় যায়। এসেছে বৈশাখ, নেমে আসি খোলা প্রান্তরে। একইসঙ্গে চলছে পবিত্র রমজান। রোজার মাহাত্ম্য প্রতিটি মনই সম্মানের সঙ্গে দেখে।

এবার পহেলা বৈশাখের সকালে আনুষ্ঠানিকতায় বেরিয়েছিলাম। দুপুরের আগেই ফিরেছি। সন্ধ্যানাগাদ আবার পুরো পরিবার আর কয়েকজন বন্ধু নিয়ে বের হলাম। এই নগরে ঘোরার জায়গা মানেই এখন রেস্তোরাঁ না হয় মার্কেট। আর আছে শহরের বুকে এখনো দাঁড়িয়ে থাকা দুটো বড় পার্ক রমনা পার্ক ও সোহরাওয়ার্দী উদ্যান। ওদিকে মিরপুরে চিড়িয়াখানা ও বোটানিক্যাল গার্ডেন। অবশ্য পার্ক নামের আরও জায়গা আছে শহরে। কিন্তু সেগুলোতে মানুষের সঙ্গে যে আচরণ করা হয় তার বর্ণনা এখন না-ই বা দিলাম।

আমাদের দলে সত্তরোর্ধ্ব এক নারী, ১৫ বছর বয়সের এক কিশোরী, ১১ বছরের কিশোর, তিরিশোর্ধ্ব দুজন এবং আমি আর আমার বয়সী আরও দুজন। আমরা যখন পার্কে ঢুকি তার ৪০ মিনিট পরই হলো মাগরিবের আজান। ইফতারের সময়। অনেকেই এসেছে পরিবার-পরিজন নিয়ে। ঘাসে কিংবা পার্কের বেঞ্চিতে বসে ইফতার করছে।

নির্মাণাধীন লেকের পাড়ে অনেকেই বসে আছে। একদল ২০/২২ বছরের ছেলে খিস্তিখেউড় করছে। অভিভাবকের সঙ্গে শিশুরাও আছে। এদিকে ওরা সিগারেট খাচ্ছে। গার্ডরা মামা বলে তাদের সালাম দিচ্ছে। ৫০ গজ দূরে দুই তরুণ-তরুণী বসে ইফতার করছে। ছেলেটি মেয়েটিকে কিছু একটা মুখে তুলে দিয়েছে বোধহয়। অমনি গার্ডপনা জেগে উঠল! মেয়েটি মাথা নিচু করে আছে। ছেলেটিকে জেরা করছে গার্ড। পুলিশের হাতে দেবে বলে ধমকাচ্ছে! ছেলেটি বলছে, আমরা তো কিছু করছি না ভাই। ইফতার করেই চলে যাব। তাদের বাবা মা, বংশশুদ্ধ গালিগালাজ করছে গার্ড। হঠাৎ মেয়েটি প্রতিক্রিয়া জানায়, ডাকেন পুলিশ। এখানে ইফতার করতে মানা আছে? …

দূর থেকে দেখে এবার কাছে গেলাম। গার্ড ওই দুজনের প্রতি আমাদের মন বিষিয়ে দিতে নানা মিথ্যা কথা বলছিল। জানতে চাইলাম কী হয়েছে? গার্ড আরও ক্ষেপে ওদের বলছে, নষ্ট মেয়েমানুষ নিয়ে পার্কে ঢুকে পরিবেশ নষ্ট করছে। আমি বললাম, ওরা তো ইফতার করছে। পরিবেশ তো নষ্ট করছে না। ওদের চলে যেতে দিন।

গার্ড ক্ষেপে বলল, আপনি কে? আপনার কথা মতো… আমি বললাম, ‘এই পার্কের মালিক’, আমার নম্বর নিয়ে খোঁজ নাও। গার্ড কী বুঝল জানি না। বলল, আপনাদের লোক এটা উনারা বললেই তো হতো!

২. রমনার শিশু উদ্যানে কিছুক্ষণ সময় কাটিয়ে সামনে এগোলাম। রমনা বটমূলের মঞ্চসজ্জা খোলা হচ্ছে। রমনা রেস্তোরাঁ আগে যেখানে ছিল সেখানে কাজ চলছে। সকালের রমনা বটমূলের ভাঙামেলা দেখতে দেখতে পুরো দল নিয়ে আমরা এগুচ্ছি। অনেকেই তখন মৎস্য ভবনের গেট দিয়ে বের হচ্ছে। আবার কেউ হাঁটছে।

পথের পাশেই একটা বেঞ্চ। পাশ কাটিয়ে যাওয়ার সময় দেখলাম একজন তরুণীর কান্নাজড়িত কণ্ঠ… ‘বিশ্বাস করেন ভাইয়া আমরা আমরা এমনি বসে গল্প করছিলাম।’

গার্ডের সঙ্গে মাস্তান গোছের দুই ছেলে। তারা মেয়েটির কাছে তার অভিভাবকের নম্বর নিচ্ছিল। ছেলেটি বলল আমার নম্বর নেন ভাই। একটু ঘুরতে এসেছি। এদিকে মেয়েটিকে চরিত্রহীন, বেহায়া, প্রস্টিটিউট বলে গালি দেওয়া হচ্ছে। আজ কত টাকা আয় করেছে জানতে চেয়ে ব্যাগ দেখাতে বলছে। এসময় ছেলেটি মানিব্যাগে হাত দেয়। গার্ড এদিক ওদিক তাকায়। মেয়েটির ফোন গার্ডের হাতে। পাশের মাস্তান গোছের দুই ছেলে দেখল যে আমরা একদল মানুষ দাঁড়িয়ে আছি। এবার ছেলেরা গার্ডকে বলল, সামনে নিয়ে চলেন।

গার্ড তাকিয়ে আমাদের দেখল। আমাদের বলল, আপনারা এখানে দাঁড়িয়ে আছেন কেন? বললাম, এখানে দাঁড়াতে ভালো লাগছে। আমরা যে অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে আছি ওই মাস্তানরা তা দেখেছে। গার্ডের হাত থেকে মোবাইল নিয়ে মেয়েটির হাতে দিল একজন। বলল, ‘যা তাড়াতাড়ি ভাগ। আর কোনোদিন যেন পার্কে না দেখি।’ গার্ড বলল, আপনাদের মতো ভদ্রলোকরা আসে। আর এইসব বাজারি মেয়েছেলে এসে পরিবেশ নষ্ট করছে। আরও নানা কথা। এদিকে, ছাড়া পেয়ে মেয়েটি আর ছেলেটি দ্রুত হেঁটে যাচ্ছে। ওদের গায়ে বৈশাখের সাজ। কেমন যাবে ওদের সারাটা বছর?

৩. পহেলা বৈশাখের গভীর রাতে দেখি কুমিল্লা নগর উদ্যানের দুই কিশোর-কিশোরীর একটি ভিডিও ভাইরাল হয়েছে। গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) দুই সদস্যের কাজ এই ভিডিও। এক মিনিট ১০ সেকেন্ড ধরে ওই ভিডিও করা হয়েছে। ভিডিও ফুটেজে দেখা যায়, নববর্ষের দিন নগর উদ্যানে বসে গল্প করছিল দুই কিশোর-কিশোরী। এসময় ডিবি পুলিশের এক সদস্য তাদের পেছন থেকে ভিডিও করতে করতে সামনে এসে দাঁড়ায়। প্রশ্নবাণে জর্জরিত করে তাদের। কিশোরীর মাস্ক খুলতে বলে। এসময় মেয়েটিকে ‘তুই’ বলে সম্বোধন করে পাশে থাকা পুলিশের আরেক সদস্য। কিশোরের পরিচয় জানতে চায়। ওই ডিবি সদস্য কিশোরকে বলেন, ‘মুড়ায়া ছাতনা ছিরালামু একবারে।’ মেয়েটির বাবার ফোন নম্বর চায়। তখন ভয়ে ওই বাচ্চা ছেলেমেয়ে দুটি মাফ চাইতে থাকে।

পরদিন কথা বললাম, কুমিল্লার এসপি ফারুক আহমেদের সঙ্গে। তিনি ভিডিওটি দেখেছেন। পুলিশ সুপার জানালেন, এই ঘটনা ঘটানো দুই সদস্যকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে। তাদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে। কত যে সাময়িক বরখাস্তের পাহাড় জমে বিভাগীয় তদন্ত হওয়ার কথা! হচ্ছে কি? ঘটনার আড়াল পেরিয়ে বরখাস্তকৃতরা নতুন পদায়নে যায়।

এভাবে দিনে দিনে একটা ঘৃণার সমাজের ছবিই তৈরি হচ্ছে তরুণ প্রজন্মের মনে। সেটা কি তদন্ত করে সমাধান করা যাবে? এই সমস্যাকে এড়িয়ে যাওয়ার আর সুযোগ নেই। সামাজিক পরিসরে এমন দায়িত্ব পালনে নিয়োজিতদের এসব বিষয়ে প্রশিক্ষণের ঘাটতি এখনই মেটাতে হবে।

লেখক : সাংবাদিক

সূত্র: দৈনিক দেশ রূপান্তর/ভয়েস/আআ

Please Share This Post in Your Social Media

© All rights reserved © 2023
Developed by : JM IT SOLUTION