রবিবার, ০৫ অক্টোবর ২০২৫, ০৪:৪৫ পূর্বাহ্ন
মোস্তফা মামুন:
আসলে ঈদ মানে কী
‘ঈদ মানে খুশি।’
‘এক চড় দেব।’
‘ঈদ মানে খুশি স্যার। খুশিরই দিন।’
‘আরেকটা চড় দেব।’
এভাবে খুশির কথা বারবার উল্লেখ করা হয়, আর চড়ের সংখ্যা বাড়তে হবে। কর্মচারীটি থেমে গেল। এভাবে ঈদের মাহাত্ম্য বর্ণনা করে চড়াক্রান্ত হওয়ার মানে হয় না।
এবার চড়ের হুমকিদাতা, দোকানের মালিক প্রশ্ন করেন, ‘আমার খুশি! এই যে তোকে আমার বোনাস দিতে হচ্ছে এটা খুশির বিষয়? বল, এখানে খুশিটা কোথায়? বল, ঈদ মানে যন্ত্রণা। বল…’
কর্মচারীটির সামনে চড়ের সঙ্গে সঙ্গে বোনাস হাতছাড়া হওয়ার ভয়। অগত্যা, ‘স্যার ঈদ মানে যন্ত্রণা।’
মালিক খুশি হলেন। বোনাসের টাকা গুনে দিলেন।
অনেক বছর আগে ঈদ মার্কেটে দেখা ঘটনা। তখন মনে হচ্ছিল, এভাবে ভাবলে তো কিছু মানুষের জন্য ঈদ আসলেই যন্ত্রণার। আর এখন দিন দিন ঈদের ঘোড়া যেদিকে ছুটছে তাতে ঈদ সম্ভবত বেশিরভাগের জন্য আর খুশির বিষয় না।
ঈদে বাড়ি যাবেন। প্রায় অশেষ একটা লাইনে দাঁড়াতে হবে টিকিটের জন্য। আট-দশ ঘণ্টা লাইনে থেকে, না ঘুমিয়ে, প্রচুর ঘেমে হয়তো একটা সোনার হরিণ জোগাড় করলেন। এবার যাওয়ার সময়, ভিড়, রাস্তার উন্নয়ন কাজ, আরও আট-দশ ঘণ্টার ধাক্কা। এই ধাক্কা পেরিয়ে বাড়ি পৌঁছালেন হয়তো, মায়ের হাসিতে ভুললেন সব, কিন্তু এটা কী করে ভুলবেন যে আপনাকে আবার ফিরতে হবে। তাও তো একা নয়। সবারই ফিরতে হবে। আবার টিকিটের চেষ্টা। আবার লাইন, লবিং। এবং সবাই যে যেতে বা ফিরতে পারে এমনও নয়। রাস্তায় সড়ক দুর্ঘটনায় ঈদের খুশির আগেই জীবন শেষ হয়ে যাওয়া দুর্ভাগাদের সংখ্যাও কম হয় না।
দেখে দেখে এমন মেজাজ গরম হয়! আমাদের নেতা-মন্ত্রীরা গরম মেজাজকে আগুনে পরিণত করতে পারেন তাঁদের বাকশক্তির অপূর্ব ক্ষমতায়। রেলমন্ত্রী যেমন রেল স্টেশন পরিদর্শন করতে গিয়ে সামগ্রিক ব্যবস্থাপনা নিয়ে
কৃতিত্ব প্রকাশ করে বললেন, ‘মানুষ রাত থেকে লাইনে দাঁড়ালে তাঁদের আর কী করার আছে?’
তাঁদের অবশ্য কোনো বিষয়েই যে তেমন কিছু করার ক্ষমতা নেই, সেটা আমরা জানি। থাকলে সামান্য সিদ্ধান্তেই এই দুর্ভোগ দূর করা সম্ভব। ছুটিটা তিন দিনের জায়গায় একটু বাড়িয়ে দিলেই হয়। তখন সবার একসঙ্গে যেতে হবে না। এক লাইনে দাঁড়াতে হয় না। কিন্তু আমাদের এমন রাজকাজ পড়ে থাকে যে একদিন ছুটি বাড়ালে যেন দেশ বঙ্গোপসাগরে ডুবে যাবে। শুনে হাসিও পায়। কী এমন কাজ এই দেশের সরকারি দপ্তরে হয় সেই অভিজ্ঞতা সবারই আছে। নতুন করে বলার দরকার নেই। তবু ছুটি বাড়ানো যাবে না! প্রয়োজনে রোজার মাসের সাপ্তাহিক ছুটি কমিয়ে, অপ্রয়োজনীয় কিছু সরকারি ছুটি কমিয়ে, এমনকি কর্মীদের প্রাপ্য অর্জিত ছুটির সমন্বয় করে ১০-১২ দিনের একটা দীর্ঘ ছুটি সম্ভব। সম্ভব সত্যিকারের একটা উৎসবের আবহ তৈরি। সম্ভব এই দুর্ভোগ নিমিষেই দূর করা।
সাধারণের ঈদ দুর্ভোগ অবশ্য এখানেই শেষ হচ্ছে না। ঈদের কেনাকাটা করতে, ঘনিষ্ঠদের দাবি-প্রয়োজন মেটাতে আর লৌকিকতা-সামাজিকতায় মাসের প্রায় পুরো আয় বেরিয়ে যায়। যার আয় ৩০ হাজার টাকা, দেখা যায় তার খরচ হয়ে গেছে ৪০ হাজার টাকা। যার ৪০, তার খরচ ৫০। বাকি মাসটা খোদা ছাড়া আর কে চালাতে পারেন! খোদা তো চালাবেন, কিন্তু ঠেলার কাজটা তো নিজেকেই করতে হয়। সেই হিসেবে এদেরও খুশি নেই।
এমন হাজারো যন্ত্রণা পেরিয়ে শেষে ঈদ আসে। এবং এত কিছুর পর আনন্দও চলে। সবচেয়ে বেশি চলে খাওয়া-দাওয়া। প্রায় সব বাসায়ই বিপুল খাওয়া-দাওয়ার বাহারি আয়োজন। রোজার এক মাস সংযমের পর এটাই স্বাভাবিক। একটাই সমস্যা, সব বাসায় প্রায় একই রকম রান্না। সত্যি বললে, যারা রিচ ফুড ঠিক খেতে পারেন না তাদের জন্য ঈদের দিন রোজার চেয়েও কঠিন দিন। হোটেল-রেস্তোরাঁ বন্ধ। ভাত রান্না প্রায় নিষিদ্ধ। তাতে তাদের সেদ্ধ হওয়ার জোগাড়।
এক মুরব্বি শ্রেণির মানুষ ঈদের দিন কেউ এলেই টেনে নিয়ে টেবিলে বসিয়ে বলতেন, ‘খাও বাবা, খাও। এই খাবারটা খুব ভালো হয়েছে।’
কেউ তো বসেই সঙ্গে সঙ্গে খেতে শুরু করতে পারে না। একটু ইতস্তত করত। তিনি সঙ্গে সঙ্গেই বলতেন, ‘তুমি ভাবছ খাওয়াটা কেমন? এই যে দেখো, আমি খাচ্ছি।’
তারপর আরেকটা আইটেম দেখিয়ে, ‘এটা আরও মজা’ বলে সেটায়ও তাঁর হাত।
পরে জানা গেল, কোলেস্টেরল বেশি বলে বাসার লোকজন তাঁকে এসব খেতে দিতে চান না। তিনি তাই অতিথি সেবার নামে নিজেই শুরু করে দিতেন। মেহমানের সামনে কিছু বলা যায় না বলে ওদের ব্যবহার করেই পেটপূজাটা হয়ে যেত। পরে অবশ্য পেটে কিছু সমস্যাও দেখা দিত। সে যা-ই হোক…।
আবার অন্যরকম ঘটনাও আছে। আমাদের এক বন্ধু ঈদে কোনো বাসায় বেড়াতে গিয়ে খাবার দেখেই একটা পর্যবেক্ষণ সেরে নিত। এরপর বলত, ‘এই ভাজিটা খা। দেখে মনে হচ্ছে দারুণ। ওই ডালের আইটেমটাও খেতে পারিস। ইন্ডিয়ান স্টাইলে রান্না মনে হচ্ছে…’
ওর কথামতো ওগুলোতে অন্যরা হাত বাড়াত। মাংসের আইটেম সাধারণত পড়ে থাকত। সেটা খেতে হতো তাকে। বন্ধুদের প্রতি ওর এই ত্যাগের মানসিকতায় আমরা মুগ্ধ ছিলাম। পরে জানা গেল ঘটনা পুরো উল্টো। যেটা ওর খেতে ইচ্ছা হয়, সেটা বাদ দিয়ে সে বাকি খাবারগুলোর প্রশংসা করে, যাতে অন্যরা সেগুলো নিয়ে মেতে থাকে। আসল খাবারটা ওর জন্য অক্ষত থাকে।
খাওয়া নিয়ে অনেক হলো। এবার কোলাকুলি। সেটা ঈদের বিরাট এক অনুষঙ্গ। গত দুই বছরের ঈদকে যে ঈদই মনে হয়নি, কারণ করোনার জন্য কারও সঙ্গে কোলাকুলি করিনি। এই কোলাকুলির কাজটা আবার অনেকে খুব যন্ত্রের মতো করে। শক্তি যোগ করে এমন চেপে ধরে যে ছেড়ে দে মা কেঁদে বাঁচি অবস্থা। কখনো কখনো আবার এই কোলাকুলিকে বেশ ব্যবহার করা যায়।
আমাদের এক বিজ্ঞ ধরনের বড় ভাই ছিলেন, খুব যন্ত্রণা দিতেন। ভুল ধরতেন সব কিছুতে। কঠিন কঠিন প্রশ্ন করে লজ্জায় ফেলতেন। একবার ঠিক হলো, ঈদের কোলাকুলির মাধ্যমে তাঁকে উচিত শিক্ষা দেওয়া হবে।
ঈদের সকালে আমরা ১৫-২০ জনের দল পরিকল্পনামতো এগিয়ে গেলাম তাঁর দিকে। শুরু হলো কোলাকুলি। প্রথমে তাঁর হাসিমুখ ছিল। চার-পাঁচজন যাওয়ার পর মুখ একটু গম্ভীর হলো। ১০ জনের পর মুখে কালো মেঘ। বললেন, ‘থাক, থাক। কোলাকুলি তো শরীরের বিষয়। আসল ভালোবাসা তো মনে। হৃদয়ে।’ বলে নিজের হৃদয়টা হাত দিয়ে দেখালেনও।
কিন্তু আমাদের তখন এমন নেশায় পেয়েছে যে বয়েই গেছে হৃদয়বৃত্তান্ত শুনতে। বাকিরা মন খারাপ করে বলল, ‘ভাই, ওরা করল। আমরা বাদ পড়ব কেন?’
তাঁর চেহারা দেখলে তখন পাষাণেরও মায়া হবে। কিন্তু আমরা সেদিন পাষাণেরও পাষাণ। কোনো ছাড় দিতে রাজি নই।
শেষে আমাদের ফার্স্ট বয় একটা আপস প্রস্তাব দিল। ‘ভাই, বাকি সবাই একসঙ্গে…তাতে আপনার ওপর খুব চাপ পড়বে না।’
বড় ভাই কিছু বলার আগেই সবাই ঝাঁপিয়ে পড়লাম। ভাইয়ের গলা শোনা গেল, ‘এই আস্তে’ ‘এই ঠিক আছে’। এরপর শোনা যেতে থাকল, ‘ইতর’ ‘বদমাশের দল’ ‘তোদের আমি কোনো দিন মাফ করব না।’
সঙ্গে সঙ্গেই কয়েকজন লাফিয়ে পড়ল পায়ে। ‘ভাই, মাফ করে দেন ভাই’ কোরাসে ছাপিয়ে গেল তাঁর সব আর্তনাদ।
কয়েকজন এর মধ্যে পা ধরে তাঁকে কাঁধে তুলে নিল। আশপাশের লোকজন ভাবল, ভাইয়ের প্রতি ভক্তদের ভক্তি। কেউ কেউ শুরু করল হাততালি। ভাইকে তাই অপমানটা বুকে চেপে মুখে হাসি হাসি ভাব রাখতে হলো।
কৌতুককর দৃশ্য হিসেবে মনে রেখেছিলাম। এখন মনে হয়, এটাই আসলে বাঙালির ঈদের প্রকৃত ছবি। বুকে অনেক ব্যথা। মুখে ঝোলানো হাসি।
সবাইকে ঈদের আগাম শুভেচ্ছা।
লেখক: সাংবাদিক ও লেখক