শনিবার, ২৮ Jun ২০২৫, ০২:০৬ পূর্বাহ্ন
আবদুল আজিজ:
হারেছা বেগম (৩০)। স্বামী পরিত্যক্তা এই নারী তার তিন শিশু সন্তানের মুখে খাবার তুলে গিয়ে কক্সবাজারের নাজিরার টেক শুটকি পল্লীতে শ্রমিক হিসাবে কাজ নেয়। সারাদিন কাজ করে বেতন পান ২৫০/৩০০ টাকা। এ নিয়ে হারেছা বেগমের সংসার চলে খুব টানাপোড়নে।
শুধু হারেছা নয়। তার মত কক্সবাজার শুটকি পল্লীতে শ্রমিক হিসাবে কাজ করেন ১২ হাজার নারী শ্রমিক। তাদের প্রত্যেকের বেতন কারও ২শ’ আবার কারও ২৫০/৩০০ টাকা। এ নিয়ে চলে না তাদের সংসার। অথচ শুটকি পল্লীতে নারী শ্রমিকরা পুরুষ শ্রমিকদের চেয়ে বেশী কাজ করেন।
হারেছা বেগমের ভাষ্য মতে, ২০২০ সালের সালের দিকে কক্সবাজারের মহেশখালী ঘোরকঘাটা এলাকায় স্বামীর পরকীয়ার জের ধরে স্বামীর সাথে ছাড়াছাড়ি হয়। এরপর থেকে নানাভাবে বিচারের আশায় ঘোরাঘুরি করে বিচার পাননি। পরে কক্সবাজার শহরে এসে কাজ নেয় শুটকি পল্লীতে। সেই থেকে ৩ শিশু সন্তান নিয়ে শুরু হয় তার জীবন যুদ্ধ। পরিবারের খরচ যোগাতে বাধ্য হয়েই শুঁটকি মহালে দিনমজুরের কাজ করেন। প্রতিদিন ভোর ছয়টায় কাজে আসেন, ফেরেন সন্ধ্যা সাতটায়। দৈনিক ১১ ঘণ্টা কাজ শেষে মজুরি পান ৩০০ টাকা। এই টাকায় তার সংসার চলে না। অথচ একই জায়গায় একই কাজ করে সামশুল আলম (৩৫) মজুরি পান ৫০০ টাকা।
এমন বৈষম্যের চিত্র দেখা যায় পার্শ্ববর্তী মোহাম্মদ আলমের মাছ খোলায়ও। সেখানে কাজ করে ১৬ বছর বয়সী সাইমা। সে কক্সবাজার ভয়েসকে জানায়, তার বাবা রফিক উল্লাহ এক বছর আগে আরেকটি বিয়ে করে অন্যত্র চলে যায়। অসুস্থ মা ও দুই ভাইবোনের সংসারের খরচ যোগাতে সে ভোর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত কাজ করে। পায় মাত্র ২০০ টাকা। ওখানেও পুরুষদের বেতন বরাবরই ৫০০ থেকে ৬০০ টাকা।
বেতনে এমন বৈষম্য কেন? এমন প্রশ্নে তেমন কেউই কথা বলতে না চাইলেও তৈয়বা বেগম নামে এক নারী কক্সবাজার ভয়েসকে জানান, এই বৈষম্য নাজিরারটেক শুঁটকি মহালের শুরু থেকে। এইটাই এখানকার নিয়ম। এর বাইরে কেউ কথা বললে কাজ থেকে তাড়িয়ে দেবে। নির্বাচন করবে। সুতরাং কিছু করার নেই। পেট চালানোর জন্য এই অন্যায় মেনে নিয়ে কাজ করতে হচ্ছে।
নাজিরারটেক মৎস্য ব্যবসায়ী বহুমুখী সমবায় সমিতি লিমিটেডের দেওয়া তথ্যে জানা যায়, কক্সবাজার নাজিরারটেক শুঁটকি মহালের ৪৩৫টি মাছ খোলার প্রায় ১২ হাজার নারী মজুরি হিসেবে এই রেইট নির্ধারণ করা হয়েছে। যে শ্রমিকদের মধ্যে নারীর সংখ্যা ৬০ ভাগ।
বেতন বৈষম্যের ব্যাপারে জানতে মাছ খোলার মালিক জাফর আলমের সঙ্গে কথা হলে তিনি কক্সবাজার ভয়েসকে বলেন, সব জায়গাতে একই রেইট। এছাড়া নাজিরারটেকে নারী শ্রমিক যেভাবে পাওয়া যায় ঠিক সেভাবে পুরুষ শ্রমিক পাওয়া যায় না। আবার পুরুদের কাজ নারীদের চেয়ে এগিয়ে। তাই তাদের বাড়তি বেতন দেওয়া হয়। একই ধরনের কথা বলেন আরও কয়েকজন মাছ খোলার মালিক।
কক্সবাজার পৌরসভার ১ ও ২ নম্বর ওয়ার্ডের নাজিরারটেক উপকূলের কুতুবদিয়াপাড়া, সমিতিপাড়া, ফদনারডেইল, মোস্তাইক্যাপাড়া, বাসিন্যাপাড়া, নুনিয়াছটা, সিসিডিবি, পানিরকূপ পাড়াসহ মোট ২১টি গ্রাম নিয়ে দেশের বৃহৎ শুঁটকিমহালটি গড়ে উঠেছে। এসব গ্রামে বাস করেন দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে আসা অন্তত ৭০ হাজার মানুষ।
শুঁটকি মহাল নিয়ন্ত্রণ করে ‘নাজিরারটেক মৎস্য ব্যবসায়ী সমবায় সমিতি’। তাদের সদস্য সংখ্যা ১ হাজার ১১৭। সমিতির সভাপতি আতিক উল্লাহ কক্সবাজার ভয়েসকে বলেন, বর্তমানে ছোট –বড় ৯৫০টি শুঁটকিমহালে কাজ করছেন ২০ হাজারের বেশি শ্রমিক। এর মধ্যে নারী শ্রমিক প্রায় ১২ হাজার। পুরুষের দৈনিক মজুরি ৭০০-৮০০ টাকা হলেও নারীদের দেওয়া হচ্ছে ২৫০ থেকে ৩০০ টাকা। কারণ জানতে চাইলে আতিক উল্লাহ বলেন, ‘যুগ যুগ ধরে এ নিয়ম চলে আসছে। তা ছাড়া পুরুষের মতো নারীরা ভারী কাজ করতে পারেন না। শারীরিকভাবেও তাঁরা ফিট নন।’
কক্সবাজার জেলা মৎস্য কর্মকর্তা এস এম খালেকুজ্জামান কক্সবাজার ভয়েসকে বলেন, গত মৌসুমে জেলায় ২০ হাজার ৬৩৭ মেট্রিক টন শুঁটকি উৎপাদিত হয়েছিল। এবার শুঁটকির উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ২৬ হাজার মেট্রিক টন। যার বাজারমূল্য ৩০০ থেকে ৪০০ কোটি টাকা। কিন্তু এ ক্ষেত্রে নারীর অবদান উপেক্ষিত থেকে যাচ্ছে।
ভয়েস/আআ