শনিবার, ০৪ অক্টোবর ২০২৫, ১০:৫৯ অপরাহ্ন
মুফতি এনায়েতুল্লাহ:
শেষ নবী হজরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বিশ্ববাসীর জন্য রহমত হিসেবে প্রেরিত। তার আদর্শ অনুসরণীয় হিসেবে ঘোষিত। অনন্তকালব্যাপী পৃথিবীতে আল্লাহর রহমতের ধারা নবী করিম (সা.)-এর উম্মতের মাধ্যমে প্রবহমান থাকবে। সুতরাং ব্যক্তি, সমাজ, রাষ্ট্রসহ সবক্ষেত্রে নবী মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের অনুসরণই হচ্ছে পরিপূর্ণ দ্বীনের বাস্তব নমুনা।
মহান রবের পক্ষ থেকে তার চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের মহানুভবতা, উদারতা, উৎকৃষ্টতা, সৌন্দর্যবোধ ও স্বকীয়তার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত পেশ করা হয়েছে। যাতে অনাগত ভবিষ্যৎ প্রজন্ম নির্ভেজাল ও নিষ্কলুষ নৈতিক আদর্শ নিয়ে বেড়ে উঠতে পারে। মানবতার সামনে তার মহান কর্ম ও আদর্শ আলোর মতো সদা দীপ্যমান। কোথাও যেন অনাদর্শের কালো থাবা তাকে গ্রাস করতে না পারে।
দুনিয়ায় আগত সব নবী-রাসুল ঐশ্বরিক ধর্ম ইসলাম এবং এক উপাস্য আল্লাহর দিকে মানুষকে আহ্বান করেছেন। যুগের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে এই ধর্মের বিভিন্ন হুকুম-আহকামের পরিবর্তন-পরিবর্ধন হয়েছে। সর্বশেষ নবী এবং রাসুল সাইয়্যেদুনা মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মাধ্যমে ইসলাম সর্বাধুনিক, সুনিপুণ, পরিপূর্ণ এবং চূড়ান্ত অবস্থায় আত্মপ্রকাশ লাভ করেছে।
তার আগমনের মধ্য দিয়ে মানবজাতির জন্য অন্য নবীর প্রয়োজন বিলুপ্ত করা হয়েছে। তিনি যে বার্তা নিয়ে এসেছেন, তা আজও সংরক্ষিত। তার বাণীসমূহ নিখুঁত ও সম্পূর্ণ। তার শিক্ষা, সতর্কবাণী ও আদেশাবলি সর্বজনীনভাবে প্রযোজ্য। মানবসমাজের এমন কোনো দিক নেই যেখানে তার নির্দেশাবলি প্রযুক্ত হয়নি। মানবীয় আচরণ ও কার্যাবলির উন্নয়নে তার উপদেশ সর্বদা উজ্জ্বল ভাস্বর। সুতরাং তিনি অনন্তকালের অনুসরণীয় আদর্শ। নবী মুহাম্মদ (সা.) মানবজাতির জন্য মানবজীবনের প্রতিটি অধ্যায়ে অনুসরণীয়-অনুকরণীয়। এ প্রসঙ্গে মহান আল্লাহ বলেন, ‘আসলে তোমাদের জন্য আল্লাহর রাসুলের মধ্যে ছিল একটি উত্তম আদর্শ।’ সুরা আহজাব : ২১। বর্ণিত আয়াতের দাবি হচ্ছে, মুসলমানরা সব বিষয়ে নবী জীবনকে নিজেদের জন্য আদর্শ মনে করবে এবং সেভাবে নিজেদের চরিত্র ও জীবন গড়ে তুলবে। ইবনে কাসির (রহ.) বলেন, ‘হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর বাণী, কর্ম ও তার সামগ্রিক অবস্থাকে অনুসরণের জন্য এই আয়াতটি একটি বড় ভিত্তি। কারণ রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর সামগ্রিক জীবনকে অনুসরণ করলে কোরআনকেই অনুসরণ করা হবে।’
নবী করিম (সা.) বিদায় হজের ভাষণে মুসলিম উম্মাহ এবং গোটা মানবজাতির উদ্দেশে দুটো মৌলিক আমানত রেখে গেছেন। এর একটি হচ্ছে পবিত্র কোরআন এবং অপরটি হচ্ছে সিরাতে রাসুল (সা.) তথা হাদিসে নববি। প্রতিটি ইমানদীপ্ত মুসলমানের জন্য পবিত্র কোরআন এবং রাসুলের (সা.) পথ ও পাথেয় নিবিড়ভাবে অনুসরণের মধ্যে ইহকালীন কল্যাণ, পরকালীন মুক্তি এবং আল্লাহর সন্তুষ্টি নিহিত। তার মহত্তম চরিত্র মাধুর্যকে অনুসরণ করে জীবন আলোকিত না করলে আল্লাহর রহমত পাওয়ার কোনো সুযোগ নেই।
নবী করিম (সা.) তার কর্মময় ও সংঘাতসঙ্কুল সংগ্রামী জীবনের ২৩ বছরে ইসলামের পরিপূর্ণ রূপায়ণ করে দেখিয়েছেন, ইসলাম নিছক কিতাববন্দি কিংবা অধ্যাত্মবাদ নয়। সেই আলোকধারায় পথ চলাই মুসলমানদের জন্য একমাত্র করণীয়। এ জন্য একজন মুসলমান পবিত্র কালেমা উচ্চারণ করে তওহিদ ও রিসালাতের সঙ্গে জীবনকে গ্রন্থিত করেন, তার সার্বক্ষণিক ইচ্ছা থাকে, আল্লাহ ও তার রাসুলের (সা.) আদর্শকে অনুসরণ করা।
ইসলাম হচ্ছে প্রত্যেক মানুষ এবং সব সৃষ্টিজীব, এমনকি প্রকৃতি ও পরিবেশের জন্যও বাস্তবায়নযোগ্য জীবনব্যবস্থা। হজরত আয়েশা সিদ্দিকা (রা.) হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর জীবন সম্পর্কিত এক ভাষ্যে বলেছেন, ‘তোমরা কি কোরআন পড়োনি, কোরআন মাজিদই হচ্ছে তার জীবনচরিত।’ পবিত্র কোরআনে রাসুলের (সা.) জীবনকে সিরাজাম মুনিরা বা উজ্জ্বল দীপ্তিময় আলোকপ্রভা এবং বিশ্বমানবের মুক্তির দিশারী, সৃষ্টিকুলের জন্য রাহমাতুল্লিল আলামিন হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে।
নবী করিম (সা.) দুনিয়া থেকে বিদায় নিয়েছেন প্রায় দেড় হাজার বছর অতিক্রান্ত হয়েছে। কিন্তু পবিত্র কোরআন আজও দেদীপ্যমান, উজ্জ্বল দীপ্তিতে ভাস্বর। হজরত জিবরাইল (আ.) যেভাবে ভাষায় ও বর্ণনারীতিতে কোরআন মাজিদকে নবী কারিম (সা.)-এর কাছে বহন করে এনেছিলেন, আজও সেভাবেই পবিত্র কোরআন গ্রন্থিত হয়ে অবিকৃত অবস্থায় বিদ্যমান। লাখো-কোটি মুসলমানের ঘরে ঘরে এবং হাফেজে কোরআনের হৃদয়ের সুরক্ষিত দুর্গে বিরাজমান। আল্লাহর রাসুল (সা.) যে মুসলিম উম্মাহ তৈরি করে রেখে গেছেন এবং যাদের প্রতি আল্লাহর রজ্জু সুদৃঢ়ভাবে ধারণ করে রাসুলের (সা.) আদর্শ অনুসরণের নির্দেশ রেখেছেন, মুসলমানরা সে নির্দেশ কতটুকু পালন করতে পারছে? এ প্রশ্ন আজ উঠছে। হ্যাঁ, বলতে দ্বিধা নেই, মুসলমানরা বহু আগেই বিশ্ব নেতৃত্বের অবস্থান থেকে সরে গেছে। কারণ তারা কোরআন-সুন্নাহ ছেড়ে দিয়েছে। নবীর আদর্শ ভুলে গেছে। ফলে মুসলমান পরিচয়টাই এখন যেন মুসলমানদের জন্য দেশ-বিদেশে বিপদ ও বিপর্যয়ের কারণ। অথচ মহান আল্লাহ বলেন, ‘আমি এ কোরআন তোমার প্রতি এ জন্য নাজিল করিনি যে, তুমি বিপদে পড়বে।’ সুরা ত্বহা : ২
বরং মহান আল্লাহ কোরআন মাজিদকে নসিহত ও স্মারকগ্রন্থ হিসেবে অবতীর্ণ করেছেন, যেন প্রত্যেক মানুষের অন্তরে তওহিদের (একত্ববাদ) যে প্রেরণা সুপ্ত আছে, তা জাগ্রত হয়। এ লক্ষ্যে নবী করিম (সা.) সমাজকে সুন্দরভাবে পরিগঠন করতে প্রয়াস চালান। সামাজিক, রাজনৈতিক, অথনৈতিক বিশ্বে এক সফল বিপ্লব ঘটান। নৈতিকতা, সভ্যতা, শালীনতা, পবিত্রতা, শিষ্টাচার, অসংখ্য নীতি ও পদ্ধতি তার জীবন থেকে বের হয়ে বিশ্বের কোনায় কোনায় ছড়িয়ে পড়ে। সামাজিক সমস্যার সমাধানে তিনি যে বিধান দিয়েছেন, তার ভিত্তিতে বহু অর্থনৈতিক আন্দোলনের সূত্রপাত হয়েছে এবং এখনো হচ্ছে।
বর্তমান দুনিয়ায় সৃষ্ট সমস্যার সমাধান নবীর আদর্শের পরিপূর্ণ বাস্তবায়ন ছাড়া সম্ভব নয়। নানা সময় দেখা গেছে, মানবতার ধর্ম ইসলাম, পবিত্র কোরআন, রাসুলের হাদিস, রাসুলের স্ত্রী-সাহাবি থেকে শুরু করে নবী-রাসুলসহ ইসলামি বিষয় এবং বিধানাবলিকে নানাবিধ অত্যাচারের লক্ষ্য বানানো হয়েছে, কটূক্তি করা হয়েছে, মিথ্যাচার করা হয়েছে। তাতে অবশ্য কেউ সফল হয়নি, ভবিষ্যতেও হবে না এর দ্বারা সমাজ-সংসার ও রাষ্ট্রে শান্তি আসবে না।
মনে রাখতে হবে, নবী করিম (সা.)-এর নাম আল্লাহর আরশে অঙ্কিত; তিনি সব মানবগোষ্ঠীর নেতা। সম্মানিতদের সেরা, মহান আল্লাহ কোরআন মাজিদে তাকে অতি সম্মানের সঙ্গে সম্বোধন করেছেন। নবী-রাসুল, মুজ্জাম্মিল ও মুদ্দাসসির ইত্যাদি উপাধি ছাড়া কোথাও ‘ইয়া মুহাম্মদ’ নাম নিয়ে আহ্বান করেননি। এমনকি তার দুশমনদের দুর্ব্যবহার ও কটূক্তির উত্তর আল্লাহতায়ালা স্বয়ং দিয়েছেন এভাবে, ‘নিশ্চয় তোমার প্রতি বিদ্বেষ পোষণকারীই তো নির্বংশ।’ সুরা আল কাউসার : ০৩
লেখক : শিক্ষক ও ইসলামবিষয়ক লেখক