শনিবার, ০৪ অক্টোবর ২০২৫, ০৬:৫৭ অপরাহ্ন
রাজেকুজ্জামান রতন:
পুঁজিবাদী সমাজে সবকিছুকে যেমন পণ্য বানানো হয়, তেমনি উৎসব নিয়েও বাণিজ্য হয়। উৎসব সেটা ধর্মীয় কিংবা লোকাচারভিত্তিক অথবা করপোরেট সংস্কৃতি যাই হোক না কেন তা পণ্যায়িত বা বাণিজ্যকরণের হাত থেকে বাঁচার উপায় নেই। মানুষের আবেগ, বিশ্বাস এখন আর অর্থনীতির বাইরে থাকতে পারছে না। তাই ঈদ এলে কেনাকাটা, পোশাক, খাদ্য, যানবাহনে যাতায়াত কিংবা বেড়াতে যাওয়ার প্রসঙ্গ চলে আসে। আলোচনায় আসে সামর্থ্যবান আর সামর্থ্যহীনদের বৈষম্যের কথাও। উৎসবের আনন্দ আছে তা যেমন সত্য, উৎসবের ব্যয় প্রচুর সেটাও তেমনি সত্য। মাথাপিছু আয়ের হিসাব দিয়ে এ ব্যয়ের পরিমাণ বা প্রয়োজনীয় কিছু কিনতে না পারার বেদনার পরিমাণ পরিমাপ করা যাবে না। কোরবানির জন্য ৫-৭ লাখ টাকা দামের গরু কেনার কথা অথবা গরুর দাম ৩০ লাখ টাকা এ ধরনের সংবাদ যতটা প্রচারিত হয়েছে, নিম্নবিত্ত এবং দরিদ্র মানুষের চাপা কান্নার শব্দ ততটাই আড়ালে পড়ে আছে। ঈদের খবরে আনন্দের ভিড়ে চাপা পড়ে আছে সেসব।
দেশের উন্নয়ন নিয়ে নানামাত্রিক কথা শোনা যাচ্ছে। তবে উন্নয়নের ছোঁয়া লেগেছে সবচেয়ে বেশি সরকার-সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের বক্তৃতায়। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য কথা হচ্ছে দেশে নাকি গরিব মানুষ পাওয়া যাচ্ছে না। একজন তো বলেই ফেললেন, কোরবানির মাংস বিতরণ নিয়ে তার দুর্ভোগের কথা। কোরবানির মাংসের কিছু অংশ গরিব মানুষ, আত্মীয়, পড়শিদের মধ্যে বিতরণ করার রেওয়াজ আছে। তো তিনি এই রেওয়াজ অনুসরণ করতে গিয়ে পড়লেন ভীষণ বেকায়দায়। কারণ গরিব মানুষ নেই, গ্রামে গরিব মানুষ পাওয়া যাচ্ছে না। খোঁজ খোঁজ পড়ে গেল, গরিব মানুষ কোথায় পাওয়া যায়। শেষে দূরে অন্য এলাকায় কিছু গরিব মানুষ পাওয়া গেল বলে রক্ষা। তা না হলে তো আর মাংস বিতরণ করা হতোই না। তার এ কথা অবিশ্বাস করার কোনো উপায় নেই। কারণ তিনি সরকারের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি। তবে অনেকেই মনে করতে পারেন তার গ্রামে বা তার বাড়ির সামনে গরিব মানুষ যেতে পারেনি। পারেনি দুটো কারণে। এক ভয়, দুই ভিড়। অবশ্য এ দুটোকে কারণ না বলে ফলাফল বলা যেতে পারে। কারণ হলো ক্ষমতা। ক্ষমতাসীনদের কাছে যেতে গরিব মানুষের ভয় আবার ক্ষমতাসীনদের চারপাশে প্রচুর ভিড়। সে ভিড় ঠেলে যাওয়া শুধু কঠিন নয় ঝুঁকিপূর্ণও বটে।
সরকারি হিসাবে এ বছর ঈদে সারা দেশে ৯৯ লাখ ৫০ হাজার ৭৬৩টি গবাদি পশু কোরবানি হয়েছে। আট বিভাগের মধ্যে সবচেয়ে বেশি পশু কোরবানি হয়েছে ঢাকা বিভাগে। আবার ঢাকা বিভাগের চেয়ে চট্টগ্রাম বিভাগে গরু-মহিষ কোরবানি হয়েছে বেশি। গত বছর সারা দেশে ৯০ লাখ ৯৩ হাজার ২৪২টি গবাদি পশু কোরবানি হয়েছিল। তথ্য অনুযায়ী গত বছরের তুলনায় এ বছর ৮ লাখ ৫৭ হাজার ৫২১টি গবাদি পশু বেশি কোরবানি হয়েছে। হিসাব যে পাকা এবং কোনো সন্দেহ নেই তার প্রমাণ প্রতিটি পশুর সংখ্যা নিরূপণ করা হয়েছে। তা না হলে ৫২১টা পর্যন্ত হিসাব করা সম্ভব হলো কীভাবে?
এমনকি বিভাগওয়ারি গরু, মহিষ, ছাগল ভেড়ার হিসাব পর্যন্ত সরকারি তথ্যে উল্লেখ করা হয়েছে। এ বছর ঢাকা বিভাগে ১১ লাখ ৬৭ হাজার ৮১০টি গরু-মহিষ, ১৩ লাখ ২৩ হাজার ৭১১টি ছাগল-ভেড়া ও অন্যান্য ২৪৭টিসহ ২৪ লাখ ৯১ হাজার ৭৬৮টি গবাদি পশু, চট্টগ্রাম বিভাগে ১৩ লাখ ১৩ হাজার ৬৭৮টি গরু-মহিষ, ৮ লাখ ১৪ হাজার ৬৮৫টি ছাগল-ভেড়া, অন্যান্য ৯৬টিসহ ২১ লাখ ২৮ হাজার ৪৫৯টি গবাদি পশু, রাজশাহী বিভাগে ৭ লাখ ৯ হাজার ২৪৩টি গরু-মহিষ ও ১ লাখ ২৮ হাজার ৮৮৫টি ছাগল-ভেড়াসহ ১৯ লাখ ৯৮ হাজার ১২৮টি গবাদি পশু, খুলনা বিভাগে ২ লাখ ৫৮ হাজার ২৬৪টি গরু-মহিষ, ৬ লাখ ৬৭ হাজার ৯৩০টি ছাগল-ভেড়া ও অন্যান্য ১৫টিসহ ৯ লাখ ২৬ হাজার ২০৯টি গবাদি পশু, বরিশাল বিভাগে ২ লাখ ৬৭ হাজার ৬১৪টি গরু-মহিষ ও ২ লাখ ৩১ হাজার ৩২৩টি ছাগল-ভেড়াসহ ৪ লাখ ৯৮ হাজার ৯৩৭টি গবাদি পশু, সিলেট বিভাগে ২ লাখ ১ হাজার ১৮৬টি গরু-মহিষ ও ১ লাখ ৯১ হাজার ৩৯৭টি ছাগল-ভেড়াসহ ৩ লাখ ৯২ হাজার ৫৮৩টি গবাদি পশু, রংপুর বিভাগে ৫ লাখ ৩১ হাজার ৯৩টি গরু-মহিষ ও ৬ লাখ ৭ হাজার ৮০৩টি ছাগল-ভেড়াসহ ১১ লাখ ৩৮ হাজার ৮৯৬টি গবাদি পশু এবং ময়মনসিংহ বিভাগে ১ লাখ ৮০ হাজার ৫৪৮টি গরু-মহিষ, ১ লাখ ৯৫ হাজার ১৮৬টি ছাগল-ভেড়া ও অন্যান্য ৪৯টিসহ ৩ লাখ ৭৫ হাজার ৭৮৩টি গবাদি পশু কোরবানি হয়েছে। অর্থাৎ প্রায় ৪৫ লাখ গরু-মহিষ আর ৫৪ লাখ ছাগল-ভেড়া কোরবানি হয়েছে। অর্থাৎ প্রায় ৬০ হাজার কোটি টাকার বাণিজ্য হয়েছে। এর সঙ্গে যুক্ত আছে পশু পালন, পশুখাদ্য, পশু চিকিৎসা, পরিবহন, হাটবাণিজ্য এমনকি চাঁদাবাজির মতো বিষয়। ঈদের পোশাক, খাদ্য, যাতায়াতসহ নানা আয়োজনের খরচ যুক্ত করলে প্রায় ৮০ হাজার কোটি টাকার এক বিশাল কর্মযজ্ঞ হয়েছে ঈদে।
ঈদের পর আরেকটি বিশাল অর্থনৈতিক বিষয় হলো পশুর চামড়া-বাণিজ্য। গার্মেন্টসের পর যে প্রধান ৫টি রপ্তানি খাত তার অন্যতম খাত হচ্ছে চামড়াজাত পণ্য। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর শ্রম জরিপের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৬ সালে এ খাতে কর্মরত শ্রমিকের সংখ্যা ছিল ১ লাখ ২৯ হাজার, যা কর্মসংস্থানের শূন্য দশমিক ২২ শতাংশ। রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) তথ্যে দেখা গেছে, ২০১৩-১৪ অর্থবছরে এ খাতে রপ্তানি আয় ছিল ১১২ কোটি ডলার। ২০১৬-১৭-তে এসে তা বেড়ে ১২৩ কোটি ডলার হয়। তবে পরের দুই অর্থবছরে চামড়াশিল্পের রপ্তানি আয় উল্লেখযোগ্য হারে কমছে। ২০১৭-১৮ অর্থবছরে তা নেমে আসে ১০৮ কোটি ডলারে। গত ২০১৮-১৯ অর্থবছরে তা আরও কমে হয়েছে ১০২ কোটি ডলার। ২০১৯-২০ অর্থবছরে তা আরও কমে ৭৯ কোটি ৭৬ লাখ ডলারে নেমে আসে। ২০২০-২১ অর্থবছরের এ খাত থেকে আয় হয়েছে ৯৪ কোটি ১৬ লাখ ডলার। আর ২০২১-২২ অর্থবছরে রপ্তানি দাঁড়িয়েছে ৫২ বিলিয়ন ডলার, যেখানে ১২৪ কোটি ৫২ লাখ ডলারের চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য রপ্তানি হয়েছে। দেশের অভ্যন্তরীণ বাজারের হিসাব ধরলে চামড়াশিল্প যেমন আয়তনে বড়, তেমনি অর্থনীতির স্থায়ী ভিত্তিও বটে। কারণ এর কাঁচামাল পাওয়া যায় দেশে, দেশে একটা বড় বাজার আছে এবং যা আরও বড় হওয়ার সম্ভাবনা আছে।
কিন্তু ঈদের পর চামড়া নিয়ে একটা সংকট দেখা দেয় প্রতি বছর। এবারও লাখ টাকার গরুর চামড়া ৩০০ টাকায় বিক্রি করা যায়নি। ছোট গরুর চামড়া ১০০ টাকাতেও কিনতে চাননি চামড়া ক্রেতারা। বড় আকারের গরুর চামড়া ৩৫ থেকে ৪০ বর্গফুট, মাঝারি আকারের গরুর চামড়া ২২ থেকে ৩০ বর্গফুট আর ছোট গরুর চামড়া ১৬ থেকে ২০ বর্গফুট হয়ে থাকে। বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ব্যবসায়ীদের সঙ্গে বৈঠক করে লবণযুক্ত গরুর চামড়া ঢাকায় ৪৭ থেকে ৫২ টাকা এবং ঢাকার বাইরে ৪০ থেকে ৪৪ টাকা নির্ধারণ করে। খাসির চামড়ার দাম নির্ধারণ করা হয় ১৮ থেকে ২০ টাকা প্রতি বর্গফুট এবং বকরির চামড়া প্রতি বর্গফুট ১২ থেকে ১৪ টাকা নির্ধারণ করা হয়। ধারণা করা হয়, দেশে ৩১ কোটি ৫০ লাখ বর্গফুট চামড়া সংগ্রহ করা হয়, যার অর্ধেকের বেশি সংগৃহীত হয় কোরবানি ঈদে। সরকার নির্ধারিত দাম অনুযায়ী ২৫ বর্গফুটের একটি মাঝারি গরুর লবণযুক্ত চামড়ার দাম হওয়ার কথা ১২৫০ টাকা। লবণ এবং শ্রমিকের খরচ গড়ে ৩০০ টাকা বাদ দিলে তা দাঁড়ায় ৯৫০ টাকা। এ থেকে পরিবহন খরচ আরও ১০০ টাকা বাদ দিলে কাঁচা চামড়ার দাম তো ৮৫০ টাকা হওয়া দরকার। কোরবানির পর এ দাম কি পেয়েছেন কেউ? চামড়ার সরকার নির্ধারিত দাম না পেলেও ৪ বর্গফুট চামড়ায় তৈরি একটি মাঝারি মানের জুতাও কি বাজারে ৩ হাজার টাকার নিচে পাওয়া যায়?
চামড়া সংরক্ষণের জন্য লবণের প্রয়োজন হয় প্রচুর। চামড়ার গুণগত মান সংরক্ষণ খুবই গুরুত্বপূর্ণ। গরম, আর্দ্রতা এসব বিষয় বিবেচনায় রেখে চামড়ায় যত দ্রুত লবণ দেওয়া যায়, ততই চামড়ার মান রক্ষা করা সম্ভব। সাধারণত পশুর চামড়া খুলে নেওয়ার ৪ ঘণ্টার মধ্যে যদি লবণ দেওয়া যায় তাহলে মান রক্ষা করা যায়। দেশে লবণের উৎপাদন হয়েছে যথেষ্ট এবং বলা হয়েছিল যে লবণের কোনো ঘাটতি নেই এবং আমদানির দরকার নেই। কিন্তু ব্যবসায়ীরা বলছেন, লবণের দাম বেড়ে গেছে। কোরবানির সময় চাহিদা বাড়ে এ সুযোগটি হাতছাড়া করার মতো বোকামি করেননি লবণ ব্যবসায়ীরা। ঈদের সময় ৬০০ টাকা দামের ৭৫ কেজির বস্তা লবণ বিক্রি হয়েছে ৯০০ টাকা দরে। শুধু দাম বাড়ানো নয়, ওজনেও কম দেওয়া হয়েছে। ৭৫ কেজির পরিবর্তে বস্তায় দেওয়া হয়েছে ৬০ কেজি। মুনাফা এখানেও।
ত্যাগের মহিমায় ঈদ উদযাপিত হলেও মুনাফার চক্কর থেকে মুক্ত হতে পারেনি উৎসব। গরু পালনকারীরা তাদের শ্রম ও যত্নের দাম পাননি কিন্তু ক্রেতারা বেশি দামে পশু কিনেছেন। হাটের ইজারাদাররা আয় করেছেন, নানা ধরনের চাঁদাবাজি হয়েছে। কোরবানির পর সস্তা দামে চামড়া বিক্রি করেছেন কিন্তু চামড়ার ব্যাগ ও জুতা কিনতে হবে বেশি দামে। ঈদের অর্থনীতি বড় হচ্ছে, কেনাকাটার আড়ম্বর বাড়ছে কিন্তু আড়ালে থেকে যাচ্ছে শ্রমজীবী মানুষের প্রতিদিনের ত্যাগ আর কষ্ট। উৎসব তাদের জীবনের বঞ্চনাকে উন্মোচন করে দেয়। এ অবস্থার অবসান না হলে উৎসবের আনন্দ সবার জীবনে আসবে না।
লেখক রাজনৈতিক সংগঠক ও কলামিস্ট
ভয়েস/আআ