শনিবার, ০৪ অক্টোবর ২০২৫, ০৪:৫৫ অপরাহ্ন
উম্মুল ওয়ারা সুইটি:
নাসিরনগর থেকে সাহাপাড়ার ঘটনার মধ্যে আমি পার্থক্য দেখি না। এসব ঘটনায় না আছে কোনো ধর্মপ্রেম, না আছে মানবতা, না আছে নিজ ধর্মের প্রতি শ্রদ্ধা। গত কয়েক বছরের এমন সাত-আটটি ঘটনা বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে, প্রায় সব ঘটনার পেছনেই ব্যক্তিগত, পারিবারিক বা গোষ্ঠীগত কিংবা রাজনৈতিক উদ্দেশ্য লুকিয়ে রয়েছে।
দেশে দেশে ধর্মীয় সহিংসতার এই অপচর্চা এখন রাজনৈতিক অস্থিরতার এক মারণাস্ত্র হয়ে দাঁড়িয়েছে। মাঝে মাঝে মনে হয়, এমন যদি হতো ফেইসবুকে যেকোনো ধর্ম অবমাননা করে যারা পোস্ট দেবেন তাদের আল্লাহ, ঈশ্বর বা ভগবান নিজে এসে শাস্তি দিতেন। তবে এটা সত্য যে, মানুষের কোমল অনুভূতি এবং বিশ্বাসের জায়গায় আঘাত করলে কোনো না কোনোভাবে শাস্তি পেতেই হয়। আর এজন্য মৃত্যুর পর বড় শাস্তি অপেক্ষা করছে।
১৫ জুলাই নড়াইলের লোহাগড়ায় হজরত মুহাম্মদ (সা.)কে কটূক্তি করে ফেইসবুকে হিন্দু সম্প্রদায়ের একজনের স্ট্যাটাস দেওয়ার অভিযোগ সামনে এনে হিন্দু সম্প্রদায়ের ৩০টির বেশি বাড়িঘর পুড়িয়ে দেওয়া, তাদের মন্দিরে ভাংচুর এক নৃশংস বর্বরতা ছাড়া আর কী হতে পারে? এখানে স্পষ্টতই ধর্মপ্রেমের কোনো চিহ্ন পাওয়া যায় না।
যদি সত্যিই মহানবী (সা.)কে নিয়ে কটূক্তি করে কেউ একজন স্ট্যাটাস দিয়ে থাকে, তাহলে সেটি একটি বড় অপরাধ। এই অপরাধের জন্য প্রচলিত আইনে শাস্তির বিধান রয়েছে। তার জন্য আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী রয়েছে। যারা ভীষণ ধর্মপ্রাণ মানুষ তারা তো এই ঘটনায় বেশি করে নফল নামাজ আদায়, রোজা রাখা এবং যে ব্যক্তি এই কাজ করেছে তার হেদায়েত চেয়ে দোয়া কামনা করবেন।
যদি সত্যিই কেউ ফেইসবুকে স্ট্যাটাস দিয়ে এমন অবমাননা করে থাকেন আর সেই ব্যক্তি যদি অন্য ধর্মের হয়ে থাকে, তাহলেও ওই একজনের জন্য তার পরিবারসহ ওই ধর্মের মানুষদের প্রতি গোষ্ঠীগত আক্রমণ কোনোভাবে মেনে নেওয়া যায় না। বরং উচিত হলো একজন ব্যক্তির জন্য যেন তার পরিবার বা ওই সম্প্রদায়ের কেউ ক্ষতিগ্রস্ত না হয় সেই চেষ্টা করা। মহানবী (সা.)-এর জীবন ও কর্ম আমাদের সেই শিক্ষাই দেয়। মুসলিম বিশ্বের অতীত ইতিহাসও সেই সাক্ষ্যই দেয়।
আমি মনেপ্রাণে দোয়া করি এমন ঘটনা যাতে আর একটিও না ঘটে। ধর্মবিশ্বাস দুনিয়ার এক আদি বিশ্বাস। যার যার মত-পথ-বিশ্বাস নিয়ে তিনি থাকবেন। এই সত্যের পরও বাস্তবতা হলো ধর্মীয় ব্যাপারে মানুষ খুব নাজুক থাকে। আর এখন ডিজিটাল দুনিয়া এমন এক জায়াগায় চলে গেছে যে, এক লহমাতেই তা সব মত-পথের মানুষের কাছে পৌঁছে যেতে পারে।
সাহাপাড়ার ঘটনাকে নেহাত একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা বলে মনে হয় না। যেমন রামুতে ঘটেছিল, নাসিরনগরে ঘটেছিল, নড়াইলের সাহাপাড়াতেও একই রকম। যাদের ফেইসবুক আইডিই থাকে না ঘটনার সাত দিন আগে, তারা কিনা কটূক্তি লিখে তোলপাড় করে দেয়।
রংপুরের পীরগঞ্জের ঘটনা দেখলে কী মনে হয়, দায়ভার কার ওপর আসবে? ঘটনাগুলোর আগের পরের বিষয় যদি দেখি, আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর ভূমিকার গড়িমসি চোখে পড়ার মতো। এটা সত্য, এসব ঘটনায় দেশের আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী কখনোই জড়িত নয়। তবে তাদের গড়িমসি নিয়ে প্রায় প্রতিটি ঘটনাতেই বিস্তর প্রশ্ন রয়েছে। সাহাপাড়ার ঘটনায় তা আরও স্পষ্ট।
মনে হয় একটা স্ল্টে স্ল্টে সাম্প্রদায়িক অস্থিরতা ঘটানো হচ্ছে। আর অতি উৎসাহী বকধার্মিকরা দেশের সৌহার্দ্য ও সম্প্রীতি যেমন নষ্ট করছে তেমনি বাইরে দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুন্নের চেষ্টা করছে। এটা হতে দেওয়া যাবে না। কিন্তু ঘটনার পর প্রতিবাদ, বিক্ষোভ বা সংহতি সমাবেশ, মিছিল কোনোটাই এই দুর্নামের ঘা সারাতে পারে না।
গত এক মাসে নড়াইলে দুটি ঘটনা ঘটে গেছে। এর মধ্যে ১৬ জুন নড়াইলের সদর উপজেলার মির্জাপুর ইউনাইটেড ডিগ্রি কলেজের অধ্যক্ষকে মুসলমানদের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত হানায় মদদ দেওয়ার অভিযোগ তুলে পুলিশ ও জনতার সামনে গলায় জুতার মালা পরিয়ে রাস্তায় হাঁটানো হয়। যদি ধরেও নিই, অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ সঠিক; তাহলেও প্রশ্ন থাকছে যে, তার বিচার করবে কে? যারা নিজেরা এভাবে বিচারক সাজছেন তাদের বিচার যদি নিশ্চিত না হয়, তাহলে প্রতিদিন তো এমন ঘটনা ঘটেই যাবে।
নড়াইল হলো বাংলাদেশের এমন কয়েকটি জেলার মধ্যে একটি, যেখানে হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজন বেশি বাস করে। এমন শীর্ষ ৫টি জেলার একটি নড়াইল। এই জেলা দীর্ঘদিন ধরে প্রগতিশীল রাজনীতির একটা কেন্দ্র। কিন্তু ১৬ জুনের পর গত ১৫ জুলাই শুক্রবার লোহাগড়ার দীঘলিয়ায় হিন্দুপল্লীতে একই ধরনের অভিযোগে হামলা, ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ সব হিসাবনিকাশ পাল্টে দিয়েছে।
প্রশ্ন উঠছে তারা কারা যারা এত দীর্ঘ সময় ধরে হিন্দুপাড়ায় তছনছ করার সুযোগ পেল? গোপালগঞ্জের পর হিন্দু সম্প্রদায়ের সবচেয়ে নিরাপদ আশ্রয়স্থলকেই কেন বেছে নেওয়া হলো এমন হামলার জন্য? এসব প্রশ্ন গত দুদিন ধরে মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে। এলাকার স্থানীয় প্রশাসন ও ক্ষমতাসীনদের চোখের সামনেই এই ঘটনায় সবাই হতবাক।
বলাবলি হচ্ছে, গত কয়েক বছর যেসব ঘটনা হয়েছে সেসব জায়গার বেশির ভাগেরই আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর দায়িত্ববান কর্মকর্তারা মুসলিম। কিন্তু নড়াইলে তা নয়। কলেজের অধ্যক্ষের ঘটনা এবং এই ঘটনায় কিছুটা দেরিতে পুলিশকে মাঠে নামতে দেখা গেছে। আর ঘটনার ৭২ ঘণ্টা পর মামলা। স্ট্যাটাস দেওয়া ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করলেও হামলাকারীদের বিষয়ে উদ্যোগ অজ্ঞাতনামা মামলার মতোই।
মহানবী (সা.)কে নিয়ে ফেইসবুক পোস্টের ঘটনা হলো শুক্রবার সকালে। আর হামলা হয় বিকেলে। সেই হামলায় আশপাশ থেকে, মানে অন্য এলাকা থেকে মানুষ এসে জড়ো হয়েছে আর আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সেটা বলতেই পারল না। টের পেল না স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা? এই রকম ঘটনা ঘটিয়ে কেউ কি দেশের অসাম্প্রদায়িক চেতনার ভিত ভেঙে দিতে চাইছে। আমরা যদি সেখানকার স্থানীয় সংসদ সদস্য মাশরাফী বিন মোর্ত্তজার ফেইসবুক পোস্ট দেখি, সেখানে অনেকগুলো ইঙ্গিত পাওয়া যায়। এই দগদগে ঘটনার প্রকৃত তদন্ত হওয়া এখন সময়ের দাবি। এখনো দীঘলিয়া গ্রামের সাহাপাড়ার মানুষ নিজের ঘরে ফেরেনি। তারা ভয় পাচ্ছে। পাশ কাটিয়ে ঘটনার ধামাচাপা আর এটাকে হিন্দুদের ইস্যু করার সুযোগ নিতে বরাবরের মতো একদল মাঠে আছে।
বাংলাদেশের সময়টা এখন স্পর্শকাতর। ভূরাজনৈতিক ও বৈশ্বিক সংকটের এই সময়ে দাঁড়িয়ে আমাদের বাংলাদেশকে নতুনভাবে দেখা দরকার। দেশ ও দেশের মানুষকে দেখা দরকার। ভালোবাসা দরকার এদেশের সব মুসলমান, হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টানসহ সব জাতিসত্তার মানুষদের।
লেখক : সাংবাদিক
ভয়েস/আআ