শনিবার, ০৪ অক্টোবর ২০২৫, ০৩:১২ অপরাহ্ন
রাজেকুজ্জামান রতন:
অমিত হাবিব নেই! রাতে খবরটা শুনে ধাক্কা খেলাম। অসুস্থ ছিলেন, নিউরো সায়েন্সেস হাসপাতালে ভর্তি হয়ে চিকিৎসাধীন ছিলেন, তার অবস্থার তেমন কোনো উন্নতি লক্ষ করা যাচ্ছিল না এসব খবর পাওয়া যাচ্ছিল কদিন ধরেই। কিন্তু মৃত্যু? প্রায় অবিশ্বাস্য ধাক্কা দিয়ে গেল অমিত হাবিবের এই চলে যাওয়া।
কর্মী এবং সংগঠক এক নয়। এক নয় তাদের বৈশিষ্ট্যে, কাজের ধরনে এবং কাজ করার ক্ষমতায়। নিজে কাজ করতে পারা নয়, অন্যকে কাজে উদ্বুদ্ধ করা, সবাইকে জড়িয়ে কাজ করা, কর্মীর সুপ্ত ক্ষমতাকে জাগিয়ে তোলা একজন সংগঠকের কাজ। কাজের চেয়েও বড় যোগ্যতা তার স্বপ্ন দেখার এবং স্বপ্ন দেখানোর ক্ষমতায়। নির্দেশ দিয়ে প্রশাসক হওয়া যায় কিন্তু নেতা হওয়া যায় না। অমিত হাবিব ছিলেন একজন নেতা ও সম্পাদক।
আমাদের প্রতিষ্ঠানগুলো ভেঙে পড়ারকালে অমিত হাবিব একজন প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার কারিগর ছিলেন। আমরা প্রতিনিয়ত দেখছি প্রতিষ্ঠানকে পদানত করে ব্যক্তিপ্রধান হয়ে উঠছেন এবং এটাই এখন যোগ্যতা বলে বিবেচিত। যখন অন্যের কৃতিত্বকে আত্মসাৎ করে আমিই সব এই প্রবণতা প্রবল হয়ে উঠেছে, যখন পেছনে থেকে সহকর্মী অথবা অনুজদের এগিয়ে দেওয়ার দৃষ্টান্ত প্রায় নেই বললেই চলে, তখন আমাদের একজন অমিত হাবিব ছিলেন।
দূর থেকে দেখলে বনকে ঘন আর ভীষণ সবুজ মনে হয়। কাছে গেলে দেখা যায় বৃক্ষগুলো ততটা কাছাকাছি নয় অনেকটা আলাদা। দূর থেকে যতটা নিবিড় মনে হয়, কাছে এলে মনে হয় ততটা নয়। মানুষের ক্ষেত্রেও তাই, দূর থেকে যেমন মনে হয় কাছে গেলে, পাশে থাকলে, একসঙ্গে চললে তার অনেকটাই জানা হয়, অনেক ভুল ধারণাও পাল্টে যায়। দূর থেকে গম্ভীর, কথাবার্তায় রাগী আর কখনো একা একা থাকা দেখে অমিত হাবিব সম্পর্কে যে ধারণা হয় তার সঙ্গে মিশেছেন যারা, তারা উপলব্ধি করেছেন তিনি বৃক্ষের মতো একা কিন্তু বন গড়ে তোলার দক্ষতা ছিল তার। তাই তিনি ছিলেন বনের মধ্যে মাথা উঁচু করে থাকা বৃক্ষের মতো একাকী এবং একত্র।
নিজেকে আড়ালে রেখে আড়ালে থাকা সত্যটাকে উন্মোচন করতে সাহস লাগে, যোগ্যতা লাগে আর তার চেয়ে বেশি দরকার হয় একটা রুচিশীল মন। আজকের এই প্রদর্শনবাদিতার যুগে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে নিজেকে বিকটভাবে দেখানোর একটা প্রতিযোগিতা আছে। কে কত নিজেকে দৃশ্যমান করে তুলতে পারে তার জন্য রুচিহীন প্রতিদ্বন্দ্বিতা চলছে। ফলে যোগ্যতার চেয়ে দৃশ্যমান হয়ে উঠতে পারাটাই যেন লক্ষ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই নিজেকে জাহির করার সময় এবং এই জগতে অমিত হাবিব ছিলেন একটা ব্যতিক্রমী চরিত্র।
অমিত হাবিবের মৃত্যুর তথ্য যখন হাসপাতাল থেকে বলা হলো, তখন সময়ের ক্যালেন্ডারে তিনি সাংবাদিকতায় পার করেছেন ৩৬ বছর ৬ মাস। তার এই সাংবাদিকতা জীবনটা লক্ষ করলে বৈচিত্র্য আর ঝুঁকি নেওয়ার মানসিকতার পরিচয় পাওয়া যাবে। তার শুরুটা হয়েছিল স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের উত্তাল সময়ে ১৯৮৬ সালে। তিনি মাসিক উন্মেষ, সাপ্তাহিক পূর্বাভাস, আজকের কাগজ হয়ে ভোরের কাগজে যোগ দিয়েছিলেন ১৯৯২ সালে। সংবাদপত্রে তখন নতুন ধারার সূচনা হচ্ছে। পাল্টে যাচ্ছে লেখার ধরন, লেখার বিষয় আর পত্রিকার গঠন বিন্যাস। তিনি ভোরের কাগজে ১৯৯৮ সালে বার্তা সম্পাদকের দায়িত্বপ্রাপ্ত হন। এরপর ২০০৩ সালে যোগ দেন দৈনিক যায়যায়দিনে। তারপর ২০০৭ সালের সেপ্টেম্বরে চীনের পেইচিংয়ে যান, সেখানে তিনি চীনের রাষ্ট্রায়ত্ত গণমাধ্যম চায়না রেডিও ইন্টারন্যাশনালে (সিআরআই) যোগ দেন। সিআরআইতে ২০০৮ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত কাজ করেছেন। এরপরই তিনি দেশে ফিরে যোগ দেন সমকালে, এখানে তিনি প্রধান বার্তা সম্পাদকের পদে কাজ করেছেন। এরপর ২০০৯ সালের নভেম্বরে অমিত হাবিব কালের কণ্ঠে নির্বাহী সম্পাদক হিসেবে যোগ দেন। ২০১৩ সালে তিনি সেখানে উপদেষ্টা সম্পাদক হিসেবে কাজ শুরু করেন। ২০১৭ সালে সম্পাদক হিসেবে তিনি দেশ রূপান্তরে যোগ দেন। ২০১৮ সালের ২০ ডিসেম্বর তার নেতৃত্বে আত্মপ্রকাশ করে দেশ রূপান্তর। নিশ্চয়ই পাঠকরা শেষ বিচারক। সেই পাঠকরাই বলবেন এ সময় দেশ রূপান্তর তার বৈশিষ্ট্য এবং নতুনত্বে কতটা আকর্ষণীয় হয়েছে। তবে প্রথম সারির পত্রিকায় পরিণত হয়েছে, এ কথা নির্দ্বিধায় বলা যায়।
খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে কর্মীদের কাছ থেকে সেরাটা আদায় করা আর খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে সত্যটা খুঁজে বের করা এই দুই ক্ষেত্রেই তার দক্ষতা ছিল অসাধারণ। একটা রিপোর্ট কীভাবে করতে হবে, কোন বিষয়টা প্রধান করে তুলতে হবে, লিখবে যা দেখতে হবে যে তার চেয়ে বহু গুণ বেশি, ফাঁকি দিয়ে অথবা জোড়াতালি দিয়ে রিপোর্ট করলে একসময় তালিগুলো যে খুলে গিয়ে বিড়ম্বনায় পড়তে হবে সে কথা বোঝাতে গিয়ে কখনো কঠিন কথা বলেছেন। তাতে মন খারাপ হয়েছে কিন্তু এর ফলে যে কত বড় শিক্ষা হয়েছে আজ সেটা মানবেন তার অনুজরা। এটা তো সবাই জানেন, আঘাত ছাড়া গিটারেও সুর উঠে না, তবলায় তোলা যায় না বোল। তার এই আঘাত ছিল নিখুঁত হওয়ার আর নিখুঁত কাজ আদায় করার জন্য। ফলে তিনি তৈরি করতে পেরেছিলেন একদল প্রতিশ্রুতিশীল সাংবাদিক। যারা আজীবন শ্রদ্ধায় তাঁকে মনে রাখবেন।
আপাত কঠোর এবং কিছুটা নির্দয় মানুষটার মনে সহকর্মীদের জন্য ভালোবাসা ছিল অফুরান। তার পরিচয় পেয়েছেন সবাই। মৃদু হাসির মধুর ছোঁয়া পায়নি কে, তার কাছে? কিছুটা আত্মমগ্ন, কিছুটা একরোখা, কিছুটা রাগ আর কিছু অভিমান তাঁকে কখনো আড়ালে রাখত। সবার মধ্য থেকে তিনি যে একটু আলাদা তা বোঝা যেত সব সময়ই। তার এই দূরত্ব কোনো বিচ্ছিন্নতা তৈরি করত না বরং সমীহ জাগাত। এটা তার কৃত্রিমতা নয় বরং সহজাত বৈশিষ্ট্য হয়ে দাঁড়িয়েছিল।
সবকিছুর ওপরে তার ছিল পড়াশোনা! কত বিষয়ে পড়তেন যে তিনি। নিজের অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি, তিনি বামপন্থি রাজনীতি করতেন না কিন্তু আলাপচারিতায় মনে হতো না তিনি বামপন্থিবিদ্বেষী। বয়সের বিচারে আমি তার সমবয়সী, একই বছরে উচ্চমাধ্যমিক পাস করেছি। কিন্তু খুব স্বল্প সময়ে তার সঙ্গে আলোচনায় খুঁটিনাটি থেকে মৌলিক অনেক বিষয়ে তার জ্ঞান ও জিজ্ঞাসা বিস্মিত করেছে। প্রকৃতি ও সমাজে রয়েছে নানাবিধ দ্বন্দ্ব, তা জানার চেষ্টা ছিল তার। সাংবাদিক হিসেবে শুধু নয়, একজন আধুনিক মানুষ হিসেবেও তিনি ছিলেন অনন্যসাধারণ।
পথের দৈর্ঘ্য দিয়ে দূরত্ব মাপা যায় কিন্তু জীবনের দৈর্ঘ্য দিয়ে মানুষের গুরুত্ব পরিমাপ করা যায় না। অমিত হাবিবের জীবনটা দৈর্ঘ্যে তেমন বড় কি? বাংলাদেশের মানুষের গড় আয়ুর চেয়ে ১২ বছর কম জীবন পেয়েছিলেন তিনি। গড়পড়তা যোগ্যতা, দায়িত্ব পালনের মানসিকতা আর দক্ষতায় তিনি ছাড়িয়ে গিয়েছেন অনেক অগ্রজকে। কিন্তু এই এগিয়ে থাকা নিয়ে কোনো অহমিকা কি তার ছিল? তার তর্ক করার দক্ষতা এবং তর্কে ছাড় না দেওয়ার মানসিকতার জন্য অনেকের মনে হতে পারে তিনি কি শুধু হারিয়ে দিতে চান? কিন্তু তার আচরণে সেই মানসিকতার প্রকাশ ঘটেনি কখনো। এক কাপ চায়ের সঙ্গে আচরণের তীব্রতা যেন শেষ হয়ে যেত। তারপর আবার স্বাভাবিক হাসি। কে বলবে একটু আগেই এক তীব্র হার না মানা লড়াই হয়ে গেছে। হার মানতে চাইতেন না তিনি কখনোই। নিজের যোগ্যতা অর্জনের লড়াইয়ে কিংবা সহকর্মীদের যোগ্য করে তোলার প্রচেষ্টায় তার কোনো বিরাম বা বিশ্রাম কোনোটাই ছিল না। কাজ থেকে বিচ্ছিন্ন থাকার কথা যেন ভাবতেই পারতেন না। হাসপাতালে যাওয়ার আগে পর্যন্ত কাজে ব্যস্ত ছিলেন। কেউ কি বুঝতে পেরেছিল তার অসুস্থতার কথা? নিজের কষ্টের কথা বলে সহানুভূতি আদায় করাটা এখন প্রায় শিল্পের পর্যায়ে পৌঁছে গেছে। সেখানেও তিনি ব্যতিক্রমী চরিত্র। মাঝেমধ্যে প্রশ্ন জাগে, এ কি তার সহ্যক্ষমতা, নাকি নীরব অভিমান?
আজ অমিত হাবিব নেই! তার সহকর্মীরা বুঝবেন কি হারিয়ে গেল। তার বন্ধুরা বুঝবেন, তারা কি হারালেন। সংবাদপত্র জগৎ বুঝবে কি শূন্যতা তৈরি হলো। পেছন থেকে টেনে ধরার অনেক মানুষ আছে কিন্তু নিজে পেছনে থেকে অন্যদের এগিয়ে দেওয়ার মানুষের বড় অভাব। অমিত হাবিবের অকাল প্রস্থান সেই অভাব বোধকে আরও বাড়িয়ে দিল। অভাব আর বেদনায় আমরা তাঁকে মনে রাখব। তিনি আছেন আমাদের স্মৃতির গোপন মণিকোঠায়। বিদায়, অমিত হাবিব!
লেখক : রাজনৈতিক সংগঠক ও কলামিস্ট