শনিবার, ০৪ অক্টোবর ২০২৫, ১২:৫৭ অপরাহ্ন

দৃষ্টি দিন:
সম্মানিত পাঠক, আপনাদের স্বাগত জানাচ্ছি। প্রতিমুহূর্তের সংবাদ জানতে ভিজিট করুন -www.coxsbazarvoice.com, আর নতুন নতুন ভিডিও পেতে সাবস্ক্রাইব করুন আমাদের ইউটিউব চ্যানেল Cox's Bazar Voice. ফেসবুক পেজে লাইক দিয়ে শেয়ার করুন এবং কমেন্ট করুন। ধন্যবাদ।

নারীর ক্ষমতায়ন নারীর জীবন

ইসমত শিল্পী:
আজকের দিনে এসেও শোনা যায়‘নারী দিবস চাই না, মানুষ দিবস চাই।’ কেউ কি একথা এ কারণে বলেন যেআলাদাভাবে ‘নারী দিবস’ কিংবা ‘পুরুষ দিবস’ দরকার নেই, সবার জন্য একটা ‘মানুষ দিবস’ চাই? না কি একথা এজন্য বলেন যে, ‘নারী এখনো মানুষ হতে পারেনি’? এমন কথা শুধু এখন বা আজ বলা হচ্ছে তা নয়। একটা শ্রেণির মানুষ বলেই এসেছে ‘নারী এখনো মানুষ হয়নি’, নারী হলো ‘মেয়েমানুষ’।

এমন কথা, এমন মন্তব্যের গভীরে লুকিয়ে থাকা মনোভাব ও চিন্তা-চেতনায় বৈষম্য নিয়ে আমরা ভাবি কি? অথচ বৈষম্য ঘোচানোর জন্য কত সেøাগান, বৈষম্য দূর করার জন্য কত মিছিল-মিটিং-সেমিনার, কত শত সংস্থা-সংগঠন কাজ করে আসছে। কিন্তু কী হয়েছে? কতখানি হয়েছে? কোথায় হয়েছে? নারীর ক্ষমতায়ন হয়েছে, হচ্ছে। কিন্তু বৈষম্য ঘোচেনি। সামাজিক নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠা হয়নি। দুঃখজনক হলেও এটাই সত্যি। কারণ নারী-পুরুষের মিলিত যেকোনো ঘটনা যখন সমাজের প্রচলিত ধারণার বাইরে ঘটে তখনই দোষের শিকার হয় শেষমেশ নারীই। এমনকি নারীর জীবন হুমকির মুখে পড়ে। শেষ পর্যন্ত জীবননাশ। হত্যা অথবা আত্মহত্যা। এরকম কি দেখা যায় যে সামাজিক বিতর্কের কবলে পড়ে পুরুষরা আত্মহত্যা করছে? অন্যদিকে এহেন ঘটনায় নারীর আত্মহত্যা এবং হত্যার ঘটনা ভূরি ভূরি। হয়েই চলেছে। বাড়ছে বৈ কমছে না।

যথেষ্ট শিক্ষিত ও অর্থনৈতিকভাবে স্বাধীন হয়েও অনেক নারী নিজের অধিকারটুকু আদায় করতে পারছে না। সম-অধিকার দূরে থাকুক ন্যায্য অধিকার বলতে যেটুকু তাও পায় না। সত্যি বলতে, নারীরা এখনো পুরুষতান্ত্রিকতার পাতানো ফাঁদেই আটকা পড়ে আছে। ঘরে বাইরে, অফিসে, রাস্তায়, পরিবহনে, সবখানে। শিক্ষিত হয়েও নারী সঠিক আত্মমর্যাদা নিয়ে বাঁচতে পারছে না। সঠিক মূল্যায়ন নেই। পুরুষতান্ত্রিক সমাজের শেকলের মধ্যে আটকে আছে নারীর জীবন। অথচ নারী নিজের শ্রম, সময়, শরীর সবকিছু উজাড় করে দিয়েও অধিকার ও মর্যাদার প্রশ্নে সাম্যের সুযোগ পাচ্ছে না। সম-অধিকার চাইলেই নারী তখন বিরক্তিকর। নারী তখন প্রতিবাদী। নারী তখন বিদ্রোহী। অথবা বেপরোয়া এবং অহঙ্কারী।

দীর্ঘ ও অবিরাম সংগ্রামের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের নারীসমাজ ধীরে ধীরে সামনের দিকে এগিয়ে চলেছে; তবে অত্যন্ত জটিল ও পুরনো অনেক সমস্যা দূর করার ক্ষেত্রে এখনো বিভিন্ন গুরুতর প্রতিবন্ধকতা রয়ে গেছে। সেসবের মধ্যে সবচেয়ে গুরুতর হলো নারীর প্রতি সমাজের দৃষ্টিভঙ্গি। যার ফলে নারীর রাজনৈতিক, সামাজিক ও মানবিক অধিকারগুলো বাস্তবায়ন দুরূহ বলে প্রতিভাত হচ্ছে। নাগরিক হিসেবে পুরুষের সমান অধিকার থাকা সত্ত্বেও নারীরা অনেক ক্ষেত্রে বঞ্চিত হচ্ছে; নারী সহিংস অপরাধের শিকার হলে তার যথাযথ প্রতিকার পাওয়ার আইনি বিধান ও প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থা থাকা সত্ত্বেও ধর্ষণ থেকে শুরু করে অন্যান্য সহিংসতার শিকার নারীর জন্য ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা যায়নি। বিশেষত, ধর্ষণের অপরাধ আদালতে প্রমাণ করার ক্ষেত্রে আইন প্রয়োগকারী সংস্থাসহ সমাজের ক্ষমতাবান ও প্রভাবশালীদের পুরুষতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গি বাধা হিসেবে কাজ করে। ধর্ষণের শিকার নারীর ব্যক্তিগত চরিত্র সম্পর্কে সন্দেহ পোষণ ও প্রকাশ করার অতি আপত্তিকর প্রবণতা আইনের যথাযথ প্রয়োগে বিঘœ ঘটায়।

শিক্ষা, কর্মসংস্থান ও আর্থসামাজিক কর্মকাণ্ডে নারীর অংশগ্রহণ বেড়েছে। অনেক গুরুত্বপূর্ণ পদেও তারা অধিষ্ঠিত। স্থানীয় সরকার সংস্থাগুলোয় নারী প্রতিনিধিত্ব বেড়েছে। কিন্তু আমরা যদি ঘরে-বাইরে তাদের নিরাপত্তাই দিতে না পারি, তাহলে এই সংখ্যা বৃদ্ধি কিংবা রাজনীতির শীর্ষ পদে নারীর অবস্থান কেবল দৃষ্টান্ত হয়েই থাকবে, আর্থসামাজিক ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রে দৃশ্যমান পরিবর্তন কখনোই আনবে না।

ধর্ষণ, ধর্ষণের পরে খুন ছাড়াও অহরহ নারীর ওপর নানা ধরনের সহিংসতা চলছে। ৮৭ শতাংশ নারী নিজের ঘরেই নিগ্রহের শিকার; গণপরিবহনে যৌন নিপীড়নের শিকার ৯৪ শতাংশরও বেশি নারী। নারীর নিরাপত্তার অবস্থা যখন এমন হতাশাব্যঞ্জক, তখন অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডসহ নানা ক্ষেত্রে নারীর যে অংশগ্রহণ বেড়েছে সেটা সার্বিক বিবেচনায় কতটা অগ্রগতি, তা ভেবে দেখার বিষয়। তা ছাড়া অধিকার ভোগের ক্ষেত্রে নারী ও পুরুষের বৈষম্য এখনো রয়ে গেছে পারিবারিক ও উত্তরাধিকার আইনে। আইন প্রণয়ন করা হয়েছে কিন্তু বাস্তবায়ন নেই। নারী উন্নয়ন নীতি ঘোষণা করা হয়েছে, তা বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। বাস্তবে সেই পুরনো নীতিই চলমান। নারীর ক্ষমতায়নের চেয়ে বড় প্রয়োজন নারীর স্থিতিশীল জীবন। নিরাপত্তার জায়গায় ঠিক উল্টোটাই অধিক দেখা যাচ্ছে। নারীর নিরাপত্তাহীনতা বেড়েই চলেছে। সমাজ পরিবার এমনকি সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলেও। যারা প্রতিষ্ঠিত আছেন তাদের ব্যতিক্রমী উদাহরণ কিন্তু সামগ্রিক চিত্র নয়। নারীদের ‘নারী’ হিসেবেই চিহ্নিত করা হয়। নারী যেন আজও ব্যক্তি হতে পারেনি, বস্তু হয়েই রইল! মানুষ হতে পারেনি!

নারী ও পুরুষ সমান নাগরিক, সমান মানুষএটা শুধু সেøাগানই নয়, মানবসভ্যতার শোভন অগ্রগতির প্রাথমিক শর্ত। সমানভাবে ভাবলেই সমাজের চৌকসভাবে এগিয়ে চলার পথ প্রশস্ত হতে পারে, সমাজবদলের জন্য নতুন নতুন উদ্ভাবনের জানালা খুলে যেতে পারে। চাই শিক্ষা ও সংস্কৃতির জাগরণ, যা আমাদের সমাজকে সব ধরনের অন্ধত্ব, অনাচার ও কূপম-ূকতা থেকে মুক্ত করে সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাবে। যেখানে নারী-পুরুষের কোনো বৈষম্য থাকবে না। নারী নিজেকে অসহায় বা দুর্বল ভাববে না। আর নারীর দুশমন যেন সঙ্গের পুরুষটি না হন। পরিবারের ভাই, বাবা বা অন্য কেউই কাছের নারীটিকে একচুলও যেন বঞ্চিত না করেন। পুরুষের সহযোগিতার হাত যেন প্রসারিত থাকে সঙ্গের নারীটির জন্য। খেয়ালের একাংশ পাশের বা সঙ্গের নারীটির জন্য সজাগ থাকুক। মনোযোগ গড়ে উঠুক নারীর সমস্ত অসুবিধা বিনাশে। পৃথিবীর একজন নারীও সুবিধা বঞ্চিত না হোক। অধিকার বঞ্চিত না হোক। তাহলে সুবিধাপ্রাপ্তির লক্ষ্যে নারীদের বাড়তি সুবিধা চাইবার প্রয়োজন হবে না।

এই দেশে নারীর বিরুদ্ধে সিস্টেমিক অপ্রেশান জারি আছে। এই দেশের মিডিয়া, আইন, স্কুল-কলেজ, প্রশাসন সবই সেই নারীবিদ্বেষী সিস্টেমের ইডিওলজিক্যাল স্টেট এপারেটাসের অংশ হিসেবে কাজ করে। আইন-কানুন-রীতি-নীতি নামক যন্তর মন্তর মেশিনের ভেতর ভরে নারীর মানবাধিকার লঙ্ঘনকে নর্মালাইজ করার পক্ষে সম্মতি উৎপাদন করাই এই সিস্টেমের মূল কাজ। পুরুষের বিরুদ্ধেও এটা একটা রিপ্রেসিভ সমাজব্যবস্থা। কেননা পুরুষকে পটিয়ে-পিটিয়ে-শিখিয়ে-পড়িয়ে এখানে মিসোজিনিস্টিক ও সেক্সিস্ট বানানো হয়। দোলনা থেকে কবর পর্যন্ত নারীর জন্য এমন সমাজ একটা মধ্যযুগীয় কারাগার। একটা জেলখানা। এই কারাগারে নানামুখী নির্যাতন সইতে সইতে সইতে সইতে সইতে সইতে মুক্তির খোঁজে কেউ একদিন ঝুলে পড়ে কড়িকাঠে; কেউ একদিন মুঠো ভরে এক সঙ্গে খেয়ে ফেলে ৫০/৬০টা ঘুমের বড়ি; কেউ একদিন গায়ে দাউ দাউ আগুন নেয়; কেউ একদিন চলন্ত বাস থেকে লাফ দেওয়া ভুলে যাওয়া নাম; কেউ একদিন ফিল ইন দি ব্ল্যাঙ্ক-এর লম্বা টানা ব্ল্যাংক স্পেস। এই ফাঁকা জায়গায় যে কোনোদিন লেখা হতে পারে যে কারোর নাম। অথচ প্রতিটি নারীই প্রাণের যাবতীয় সৃজনশীলতায় মত্ত হয়ে নিজের জীবন, নিজের পরিবার, নিজের সমাজ আর এই পৃথিবীকে আরও পূর্ণ করতে পারত।

লেখক : কবি, সম্পাদক, ‘নান্দিক’

ismat7shilpi@gmail.com

Please Share This Post in Your Social Media

© All rights reserved © 2023
Developed by : JM IT SOLUTION