শনিবার, ০৪ অক্টোবর ২০২৫, ০৭:২৭ পূর্বাহ্ন
মুফতি এনায়েতুল্লাহ:
মানুষের প্রতি আল্লাহতায়ালার অফুরন্ত নিয়ামতের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো আমাদের সন্তানেরা।নিঃসন্তান দম্পতি কিংবা সন্তানহারা বাবা-মাকে জিজ্ঞেস করুন, বুঝতে পারবেন, সন্তান কত বড় নিয়ামত! আল্লাহতায়ালা ইরশাদ করেন, ‘আল্লাহ তোমাদেরই মধ্য থেকে তোমাদের জন্য স্ত্রী সৃষ্টি করেছেন এবং তোমাদের স্ত্রীদের থেকে তোমাদের জন্য পুত্র ও পৌত্রাদি সৃষ্টি করেছেন।’সুরা নাহল : ৭২
আল্লাহতায়ালা যাকে দান করেন সেই কেবল অধিকারী হতে পারে এ নিয়ামতের। কোরআন মাজিদে ইরশাদ হয়েছে, ‘আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবীর রাজত্ব আল্লাহরই। তিনি যা চান সৃষ্টি করেন। যাকে চান কন্যা দেন এবং যাকে চান পুত্র দেন। অথবা দান করেন পুত্র ও কন্যা উভয়ই। আবার যাকে ইচ্ছা বন্ধ্যা করে দেন। নিশ্চয়ই তিনি সর্বজ্ঞ, সর্বশক্তিমান।’সুরা শুরা : ৪৯-৫০
সন্তান দয়াময় আল্লাহর দান ও আমানত, এর মাধ্যমে আল্লাহ বান্দাকে পরীক্ষা করেন; বান্দা এই আমানতের যথাযথ হেফাজত করে কি না। সন্তানসন্ততির মাধ্যমে আল্লাহ বান্দাকে দুইভাবে পরীক্ষা করেন। এক. সন্তানের কারণে বান্দা আল্লাহর হুকুম লঙ্ঘন করে কি না। দুই. বান্দা সন্তানকে আমানত মনে করে তা হেফাজতে যতœবান হয় কি না। মহান আল্লাহ বলেন, ‘জেনে রেখো, তোমাদের সম্পদ ও তোমাদের সন্তানসন্ততি তোমাদের জন্য এক পরীক্ষা। আর মহাপুরস্কার রয়েছে আল্লাহরই কাছে।’সুরা আনফাল : ২৮
ইমাম ইবনে জারি তাবারি (রহ.) বলেন, আল্লাহ মুমিনদের লক্ষ করে বলছেন, ‘হে মুমিনরা! জেনে রেখো, তোমাদের যে ধন-সম্পদ ও সন্তানাদি দান করেছি এসব তোমাদের জন্য পরীক্ষার বস্তু। এর মাধ্যমে তোমাদের আমি পরীক্ষা করব। এটা দেখার জন্য যে, সন্তানসন্ততি ও অর্থকড়ির ক্ষেত্রে তোমরা আল্লাহর হক কতটুকু আদায় কর এবং দ্বীনের বিধিনিষেধ কী পরিমাণ মান্য করো।’তাফসিরে তাবারি : ১১/১২৬
হজরত রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, ‘শুনে রাখো, তোমাদের প্রত্যেকেই দায়িত্বশীল এবং প্রত্যেককেই তার দায়িত্ব সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হবে। … পুরুষ তার পরিবারের ব্যাপারে দায়িত্বশীল। তাকে সে সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হবে। নারী তার পরিবার, সন্তানসন্ততির বিষয়ে দায়িত্বশীল, তাকে তার দায়িত্ব সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হবে। তাকে সে সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হবে।… জেনে রাখো, প্রত্যেক ব্যক্তিই দায়িত্বশীল এবং প্রত্যেকেই তার অধীনস্তদের ব্যাপারে জিজ্ঞাসিত হবে।’সহিহ বোখারি : ৭১৩৮
যেহেতু সন্তানাদি পিতা-মাতার কাছে আল্লাহর পক্ষ থেকে আমানত এবং পিতা-মাতার কাছে আমানত। তাই তাদের ইমান-আকিদা, বোধ-বিশ্বাস, চিন্তা-চেতনা, আমল-আখলাক, জীবন-যাপন প্রভৃতি ব্যাপারে দায়িত্বশীলতার পরিচয় দেওয়া মাতা-পিতার কর্তব্য। এক্ষেত্রে পিতা-মাতার কর্তব্য হলো, সন্তানকে আল্লাহর অনুগত বান্দা হিসেবে গড়ে তোলা, শয়তানের যাবতীয় প্রভাব তথা সব ধরনের মন্দ কাজকর্ম থেকে দূরে রাখা। শয়তান চায়, প্রত্যেকটা মানবশিশুকে অঙ্কুরে ধ্বংস করতে। জান্নাত থেকে বিতাড়িত হওয়ার সময় তার অঙ্গীকার ছিল, আদম সন্তানকে বিপথগামী করা। সে কারণে শয়তান সর্বদা চায় মানুষকে ধন-সম্পদ দিয়ে বিভ্রান্ত ও সন্তানকে বিপথে পরিচালিত করতে। কিন্তু মানুষকে আল্লাহতায়ালা সে সম্পর্কে আগেই সতর্ক করে দিয়েছেন। অভিভাবকের কর্তব্য পালনের মূল পর্বটা এখানে এসেই আবর্তিত হয়।
আমরা জানি, শিশুরা যেকোনো জিনিস খুব সহজে ধারণ করতে পারে। সুতরাং সন্তানকে সুসন্তান হিসেবে গড়ে তোলার মূল সময় হচ্ছে শৈশবকাল। তাই সন্তানের জন্য, আল্লাহর কাছে বেশি বেশি দোয়া করা। পিতা-মাতার দোয়া মহান আল্লাহ কবুল করেন। হাদিসে ইরশাদ হয়েছে, ‘তিন ব্যক্তির দোয়া কবুল হয়, এতে কোনো সন্দেহ নেই। পিতা-মাতার দোয়া, মুসাফিরের দোয়া ও মজলুমের দোয়া।’সুনানে আবু দাউদ : ১৫৩৬
সন্তান মানুষ হওয়ার ক্ষেত্রে মা-বাবার দোয়ার বড় ভূমিকা রয়েছে। এজন্য নবীরাও তাদের সন্তানদের জন্য দোয়া করতেন। কোরআন মাজিদে হজরত ইবরাহিম (আ.)-এর একাধিক দোয়ার বিবরণ এসেছে। যেমন‘হে আমার প্রতিপালক! আমাকেও নামাজ কায়েমকারী বানিয়ে দিন এবং আমার আওলাদের (সন্তানাদিদের) মধ্য থেকেও (এমন লোক সৃষ্টি করুন, যারা নামাজ কায়েম করবে)।’ সুরা ইবরাহিম : ৪০
সন্তানের জন্য নেক দোয়া করা নেককার মুমিনের একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য। আল্লাহতায়ালা মুমিনদের এই গুণ সম্পর্কে বলেন, তারা বলে ‘হে আমাদের প্রতিপালক! আমাদের জন্য এমন স্ত্রী ও সন্তানসন্ততি দান করো, যারা হবে আমাদের জন্য নয়নপ্রীতিকর এবং আমাদের করো মুত্তাকিদের জন্য অনুসরণযোগ্য।’সুরা ফুরকান : ৭৪
সন্তান বড় হলে, তাকে ভালো ও সুন্দর উপদেশ দিতে হবে। উত্তম আখলাকে দীক্ষিত করতে হবে। এরপর যে বিষয়টি বিশেষ মনোযোগের দাবি রাখে তা হলোসন্তানকে ভালো কাজের অনুপ্রেরণা প্রদানের সঙ্গে সঙ্গে ওই কাজের লাভের বিবরণ দেওয়া। যাতে নিজ আগ্রহে সে কাজটি করতে আগ্রহবোধ করে। তদ্রুপ শিশুসন্তানকে মন্দ কাজ থেকে দূরে থাকার নির্দেশ দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে এ কাজের ক্ষতির দিকটাও আলোচনা করা। এতে করে শিশুর মনে মন্দ কাজ ও স্বভাবের প্রতি ঘৃণাবোধ জাগ্রত হবে। ফলে সে ওই কাজ থেকে বিরত থাকবে।
শিশুসন্তানকে বিভিন্ন উপলক্ষে সৃষ্টিকর্তা আল্লাহর কথা স্মরণ করিয়ে দিন। শিশুর মধ্যে সৎ স্বভাব জাগ্রত করতে তাকে বলুনসত্য কথা বলো, আল্লাহ খুশি হবেন। মন্দ স্বভাব থেকে দূরে রাখার লক্ষ্যে বলতে পারেনমিথ্যা বলো না, কারণ আল্লাহ মিথ্যুককে পছন্দ করেন না। ঝগড়া-বিবাদ করো না, তাহলে আল্লাহ নারাজ হবেন। সন্তান কোনো ভালো কাজ করলে তাকে বলুন, মাশাআল্লাহ! তুমি একটা ভালো কাজ করেছ। এভাবে তার মনে আল্লাহর প্রতি ভয় ও ভালোবাসা সৃষ্টির চেষ্টা করা। আশা করা যায়, সন্তান সত্যিকারের মুমিন ও ভালো মানুষ হিসেবে গড়ে উঠবেইনশাআল্লাহ।
লেখক : শিক্ষক ও ইসলামবিষয়ক লেখক