শনিবার, ০৪ অক্টোবর ২০২৫, ০৫:১৯ পূর্বাহ্ন
রফিকুল বাহার:
পৌনে সাত বছর আগে ২০১৬ সালের ৫ জানুয়ারি পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (পিবিআই) যাত্রা শুরু হয়েছিল। অনেক বছরের পুরনো অনুদঘাটিত রহস্য উদঘাটন ও অমীমাংসিত মামলার আসামি গ্রেপ্তারে বেশ সফলতা পায় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অধীন পিবিআই। বর্তমানে এই সংস্থার প্রধান হলেন পুলিশের অতিরিক্ত মহাপরিদর্শক বনজ কুমার মজুমদার। রাজশাহী থেকে তড়িৎ, ইলেকট্রিক্যাল প্রকৌশল বিষয়ে পড়াশোনা করে তিনি এখন পুলিশ কর্মকর্তা। দীর্ঘদিন চট্টগ্রামে চাকরি করেছেন। পেশাগত জীবনে কোনো ধরনের বিতর্ক কিংবা সমালোচনায় জড়াননি তিনি।
পুলিশ সুপার বাবুল আক্তার তার স্ত্রী মিতু হত্যা মামলায় আসামি হিসেবে গ্রেপ্তারের পর পিবিআইয়ের হেফাজতে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। এর প্রায় ১৪ মাস পর নির্যাতনের অভিযোগ তুলে বনজ কুমার মজুমদারসহ পিবিআইয়ের ৭ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে আদালতে আবেদন জানায় বাবুল আক্তারের আইনজীবী। আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে আদালত সোমবার এই বিষয়ে শুনানি করে সিদ্ধান্ত জানাবে। এই নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম থেকে শুরু করে বিভিন্ন গণমাধ্যমে বিভিন্ন ধরনের আলোচনা-সমালোচনা চলছে। চাকরিচ্যুত বাবুল আক্তার এখন স্ত্রী হত্যা মামলার আসামি হিসেবে ফেনী কারাগারে বন্দি। প্রশ্ন উঠছে, জিজ্ঞাসাবাদের এত মাস পর কেন এই আবেদন?
কর্মসূত্রে বাবুল আক্তারও চট্টগ্রামে ছিলেন। চট্টগ্রাম মহানগর পুলিশের (সিএমপি) সহকারী কমিশনার পদে থেকে তার চট্টগ্রাম যাত্রা। বাবুল আক্তারের সিনিয়র বনজ কুমার মজুমদারও একই পদে চট্টগ্রামে চাকরি করেছেন। সংবাদকর্মী হিসেবে দুজনের সঙ্গেই কমবেশি যোগাযোগ ছিল আমার। পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার স্ত্রী হত্যার পর বিভিন্ন আলোচনায় আমার বন্ধুবান্ধব, আত্মীয়স্বজন থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষের প্রশ্ন ছিল কারা এই নৃশংস হত্যাকাণ্ড চালিয়েছে। তাদের কোনো ধারণা দেওয়া সম্ভব হয়নি আমার পক্ষে। সম্ভব না হওয়ার পেছনে যুক্তিও আছে। খুব সাধারণ যুক্তি সেটি। এত নাটকীয় ঘটনা ঘটেছে এই হত্যাকাণ্ড নিয়ে যে সংবাদকর্মী হিসেবে কোনো ধরনের আগাম ধারণা না করায় ছিল যুক্তিযুক্ত কারণ। আবার এটাও ঠিক, সংবাদকর্মীদের অনেকেই প্রকৃত ঘটনা না জানা পর্যন্ত বাবুল আক্তারের পক্ষেই সংবেদনশীল ছিলেন। সাতসকালে সন্তানকে স্কুলে নেওয়ার পথে ও আর নিজাম রোডের বাসার অনতিদূরে দুষ্কৃতকারীরা গুলি করে হত্যা করে মিতুকে। পাশে দাঁড়িয়ে ছেলেটি দেখছিল মায়ের নির্মম হত্যাকাণ্ড। বর্বর এই ঘটনা পুরো দেশে আলোড়ন সৃষ্টি করে।
কেন এই হত্যাকাণ্ড? কারা কী উদ্দেশ্যে মাসুম বাচ্চার সামনে মাকে হত্যা করল? প্রথমে আলোচনায় আসে জঙ্গিদের সংশ্লিষ্টতা। সেভাবেই নানামুখী তদন্ত চলতে থাকে। সংবাদকর্মীদের কেউ কেউ এই ঘটনায় ধনাঢ্য এক ব্যক্তির কথাও অপ্রাসঙ্গিকভাবে আলোচনা করতে থাকে, যদিও সংবাদমাধ্যমে সাহস করে ঝুঁকি নিয়ে কেউ এ-সংক্রান্ত ইঙ্গিত দেননি। অনেক পরে জানা যায়, ধনাঢ্য ব্যক্তির কথা আলোচনায় নিয়ে আসে বাবুলের কিছু অনুসারী। মিতুর কথিত পরকীয়ার বিষয়টিও আলোচনায় আসছিল। কিন্তু নম্বরপ্লেটবিহীন যে মোটরসাইকেলে করে খুনিরা পালিয়েছিল সেটি সড়কের পাশ থেকে পরিত্যক্ত উদ্ধারের পর যে তথ্য প্রকাশ পায়, তাতে সাধারণ মানুষসহ পুলিশের শীর্ষপর্যায়ের কর্মকর্তা ও সরকারের নীতিনির্ধারকরা হতবাক হয়ে যান। কারণ হত্যাকাণ্ডের ‘মাস্টারমাইন্ড’ হিসেবে স্বয়ং বাবুল আক্তারের নাম চলে আসে। সাক্ষ্য-প্রমাণে বাবুল আক্তার নিজেও বিস্মিত হয়ে যান অথবা বিস্ময়ের ভান করেন। কর্মকর্তাদের সামনে হাউমাউ করে বাবুলকে কাঁদতেও দেখা যায়। তবে বাবুলের সেই কান্নাকে অনেকে অভিনয় হিসেবে দেখছেন। তারপর চাকরি ছাড়তে বাধ্য হন। তদন্তে দাবি করা হয়, বাবুল আক্তার এই ঘটনা ঘটিয়েছেন তার বিশ^স্ত ও ঘনিষ্ঠজন হিসেবে পরিচিত মুসাকে দিয়ে। পুলিশের ভাষায় যাকে বলা হয় ‘সোর্স’। এই সোর্সদের টাকাসহ বিভিন্ন সুবিধা দিয়ে পালতে হয় পুলিশ কর্মকর্তাদের।
দেশ-বিদেশে আলোচিত এই হত্যাকাণ্ডের উল্লিখিত মোটিভ জনসাধারণের সামনে প্রচার বা প্রকাশ করতে সরকারের নীতিনির্ধারকরা একটু দ্বিধাগ্রস্ত ও সংশয়ে ছিল বলে অনুমান করা যায়। ২ লাখ ৩০ হাজার পুলিশ পরিবারসহ সমগ্র দেশের সামাজিক বন্ধনের ক্ষেত্রে সন্দেহ ও অবিশ্বাস যাতে তৈরি না হয় সেই বিবেচনাও ছিল এই ক্ষেত্রে। ২০১৯ সালে আদালত স্বপ্রণোদিত হয়ে এই মামলার তদন্তভার দিয়েছিল পিবিআইকে। এর আগে দীর্ঘ তদন্ত করেও ডিবি পুলিশ কোনো কূলকিনারা করতে পারছিল না। কর্ণফুলী নদীর তীর থেকে ১০ ট্রাক অস্ত্র উদ্ধার মামলায়ও একইভাবে আদালত উচ্চতর তদন্তের জন্য নির্দেশ দিয়েছিল। দেশ-বিদেশে আলোচিত সেই অস্ত্র উদ্ধার মামলার প্রকৃত রহস্য উদঘাটন করে পুলিশ আদালতে চার্জশিট দাখিলের পরে বিচার সম্পন্ন হয়েছে।
মাঠপর্যায়ে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা পুলিশ সুপার বাবুল আক্তারের স্ত্রী হত্যা মামলায় তার সম্পৃক্ততা প্রকাশ পেলে প্রথম এবং শেষ স্পর্শকাতর বিষয়টি ছিল সমাজে এর কী প্রতিক্রিয়া হবে? পুলিশ কর্মকর্তা পরিকল্পিতভাবে হত্যা করেছেন তার স্ত্রীকে এই ঘটনার ডালপালা মেলতে মেলতে মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়েছেন অনেক পুলিশ কর্মকর্তার স্ত্রী। বাধ্য হয়ে তারা মনোরোগ চিকিৎসকের চিকিৎসাও নিয়েছেন। ‘আমাকেও কি এভাবে মেরে ফেলবা’ পুলিশ কর্মকর্তাদের স্বামীকে এ রকম প্রশ্নবাণে জর্জরিত করেছেন অনেকের স্ত্রী। শুধু পুলিশ পরিবারে নয়, অনেক স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে এ নিয়ে কমবেশি আলোচনা, তর্ক-বিতর্ক হয়েছে বিশ^স্ততা নিয়ে। দেশে প্রতিদিনই কমবেশি হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়। কিন্তু বাবুল আক্তারের স্ত্রী মিতু হত্যাকাণ্ডের ঘটনাটি বড় ধরনের সামাজিক বিপত্তি তৈরি করেছে। মিতুর সঙ্গে ঘনিষ্ঠ পুলিশের এক ওসির স্ত্রীকে এই বিষয়ে সাক্ষ্য দেওয়ার জন্য তদন্ত কর্মকর্তারা নোটিস দিলে তিনিও কৌশলে এড়িয়ে যান।
আদালতে বাবুল আক্তারের আইনজীবীর আবেদনের আগে বিদেশে বসে কেউ একজন ইউটিউবে ৪৬ মিনিটের এক ভিডিও কনটেন্ট তৈরি করেন। এই ভিডিওতে অনেকগুলো তথ্য উপস্থাপন করা হয়, যা পরিস্থিতি ভিন্ন খাতে প্রবাহিত হতে পারে। এতে অনেকের ছবি ব্যবহার করা হয় অযৌক্তিক ও অকারণে। এই কনটেন্টে বাবুল আক্তারের স্ত্রী হত্যার পেছনে কিছু পুলিশ কর্মকর্তার প্রতিহিংসা, চোরাচালানের স্বর্ণ আটক ও ভারতীয় চর বানানোর নাটকীয় কাহিনী প্রচার করা হয়। প্রশ্ন উঠেছে, বিদেশে আত্মগোপনে থাকা কথিত সাংবাদিক ভিউ বাড়িয়ে নিজের চ্যানেল থেকে টাকা আয়ের সুযোগ নিয়েছেন কি না। এ নিয়ে ভুক্তভোগীরা মামলা করলে বিদেশে রাজনৈতিক আশ্রয় প্রার্থনার সুযোগ তৈরি হওয়ারও সম্ভাবনা রয়েছে তার।
এ ছাড়া, ভিডিও কনটেন্টে যেসব তথ্য উপস্থাপন করা হয়েছে, সেখানে বাবুল আক্তারকে নির্দোষ প্রমাণের একটি প্রবণতা লক্ষ করা যাচ্ছে। এই ভিডিও কনটেন্ট ইউটিউবে ছাড়ার কয়েক দিনের মধ্যে আদালতে বাবুল আক্তারকে জিজ্ঞাসাবাদে নির্যাতনের অভিযোগ তোলা হয়। প্রশ্ন হলো বিদেশে বসে এত তথ্য কীভাবে কার স্বার্থে প্রচার করা হচ্ছে? এর সঙ্গে বাবুল আক্তারের সংযোগ কী?
পৃথিবীর অন্যান্য উন্নত দেশের মতো আমাদের দেশের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর প্রযুক্তিও বেশ উন্নত। একজন কারাগারে অন্তরীণ। আরেকজন সুদূর পরবাসী। এই দুজনের তথ্য আদান-প্রদানের বিষয়টি কোনো স্বাভাবিক ইস্যু নয়। কারা বিধি অনুযায়ী বিদেশে অবস্থানরত কারও সঙ্গে যোগাযোগ করার কোনো সুযোগ নেই। কোন অস্বাভাবিক মাধ্যমে তারা দুজন সংযোগ স্থাপন করেছে সেটিও তদন্ত বা অনুসন্ধান হওয়া দরকার। এই বিষয়ে পিবিআইয়ের প্রধান বনজ কুমার মজুমদার জানান, পরে কোনো একসময়ে এসব বিষয়ে ব্যাখ্যা দেবেন তিনি।
২০৮৪ পৃষ্ঠার নথিসহ যে চার্জশিট আদালতে উপস্থাপন করা হয়েছে তাতে প্রধান আসামি হলেন মিতুর স্বামী সাবেক পুলিশ সুপার বাবুল আক্তার। সন্তানের মাকে হত্যা করে বাবুল আক্তার বাঙালির পারিবারিক জীবনে স্বামী-স্ত্রীর বন্ধনে এক ধরনের সামাজিক বিপত্তি তৈরি করেছেন। এখন রাষ্ট্রযন্ত্র ও সরকারের বিরুদ্ধে অন্যরকম প্রোপাগান্ডা চালিয়ে কি উদ্দেশ্য হাসিল করতে চান তারা? লেখক : আবাসিক সম্পাদক, একুশে টেলিভিশন, চট্টগ্রাম
rafiqul_bahar@yahoo.com