শনিবার, ০৪ অক্টোবর ২০২৫, ০৫:১৯ পূর্বাহ্ন
মুফতি এনায়েতুল্লাহ:
বিশ্বে ক্ষুধা ও দারিদ্র্য আগের তুলনায় বেড়েছে, সেই সঙ্গে বেড়েছে মৃত্যুর হার। বর্তমান বিশ্বে প্রতি চার সেকেন্ডে একজন ক্ষুধার্ত মানুষের মৃত্যু হচ্ছে। এই পরিস্থিতিতে এসব মৃত্যু ঠেকানো ও ক্ষুধামুক্ত পৃথিবী গড়তে দ্রুত কার্যকর উদ্যোগ নেওয়ার জন্য বিশ্বনেতাদের কাছে আবেদন জানানো হয়েছে। গত মঙ্গলবার বিশ্বনেতাদের উদ্দেশে একটি খোলাচিঠি প্রকাশ করেছে ৭৫ দেশের মানব উন্নয়নকাজে জড়িত ২৩৮টি বেসরকারি সংস্থা (এনজিও)।
চিঠির ভাষ্য, বর্তমান বিশ্বের প্রায় ৩৪ কোটি ৫০ লাখ মানুষ চরম ক্ষুধার সঙ্গে লড়ছে। এই সংখ্যা ২০১৯ সালের তুলনায় দ্বিগুণের বেশি। বিশ্বে চরম ক্ষুধা নিয়ে প্রতিদিন মারা যাচ্ছে ১৯ হাজার ৭০০ মানুষ। সেই হিসাবে, প্রতি চার সেকেন্ডে একজনের মৃত্যু হচ্ছে। এ ছাড়া বিশ্বজুড়ে ৪৫টি দেশের ৫ কোটি মানুষ অনাহারের মুখে রয়েছে। সংকটময় এই পরিস্থিতি একটি দেশ, অঞ্চল কিংবা মহাদেশে সীমাবদ্ধ নয়। এটা পুরো মানবতার জন্যই অন্যায়। চিঠিতে আরও বলা হয়, অতিদ্রুত ক্ষুধার্ত মানুষের জীবন বাঁচাতে খাবার সরবরাহ করতে হবে।
ইসলাম অভাবের সময় দরিদ্র-অসহায়, ক্ষুধার্ত, শরণার্থী ও দুর্ভিক্ষপীড়িত মানুষের পাশে দাঁড়ানোর নির্দেশ দিয়েছে। যারা নিজেদের চাহিদা থাকা সত্ত্বেও অন্যকে আহার করায় কোরআন মাজিদে তাদের প্রশংসা করে ইরশাদ হয়েছে, ‘খাবারের প্রতি আসক্তি থাকা সত্ত্বে তারা অভাবগ্রস্ত, এতিম ও বন্দিদের খাবার দান করে এবং বলে, কেবল আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য আমরা তোমাদের খাবার দান করি। আমরা তোমাদের কাছ থেকে প্রতিদান চাই না, কৃতজ্ঞতাও নয়।’ -সুরা দাহর : ৮-৯
অনাহারীর আহারের ব্যবস্থা করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কাজ। খাদ্য মানুষের মৌলিক অধিকারগুলোর একটি। যারা আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য নিঃস্বার্থভাবে মানুষের কল্যাণে কাজ করে, অভাবীদের খাবারের ব্যবস্থা করে, পবিত্র কোরআনে মহান আল্লাহ তাদের জন্য উত্তম প্রতিদানের ঘোষণা দিয়েছেন। তাই অন্নহীনকে অন্ন দেওয়া অতি বড় পুণ্যকর্ম। সহানুভূতি ও মানবিকতার বড় পরিচয়। বিবেকবান মানুষমাত্রই তা উপলব্ধি করেন।
হাদিস শরিফে ক্ষুধার্ত ব্যক্তিকে তৃপ্তির সঙ্গে আহার করানোকে ‘শ্রেষ্ঠ সদকা’ বলা হয়েছে। কোরআন-হাদিসে অভাবীদের খাদ্য দানের বহু মর্যাদা ও পুরস্কারের বর্ণনা এসেছে। অভাবীকে খাবার খাওয়ানো ভালো মানুষের বৈশিষ্ট্য। এর মাধ্যমে জাহান্নাম থেকে মুক্তি মেলে। হাদিসে এই কাজকে আল্লাহর পছন্দনীয় বলে ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। এ কাজের দ্বারা মানুষ জান্নাতের পথে এগিয়ে যায়। সামর্থ্য থাকার পরও কেউ যদি খাদ্য দান না করে তবে কিয়ামতের দিন আল্লাহর কাছে জবাবদিহি করতে হবে এবং পরকালে তারা শাস্তির মুখোমুখি হবে। পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘আপনি কি তাকে (তার পরিণতি) দেখেছেন? যে দ্বীন অস্বীকার করে। সে তো এতিমদের রূঢ়ভাবে তাড়িয়ে দেয় এবং সে অভাবগ্রস্তদের খাদ্যদানে উৎসাহ দেয় না।’ -সুরা মাউন : ১-৩
তবে মানুষকে খাওয়াতে হবে শুধুমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য। এর বিনিময়ে পার্থিব কোনো প্রতিদানের আশা করা যাবে না। ইসলাম মনে করে, মানুষকে খাওয়ানোর ক্ষেত্রে পরিপূর্ণ তাকওয়া (আল্লাহভীতি) থাকতে হবে। তবেই আল্লাহ উত্তম প্রতিদান দান করবেন। অনেকেই মনে করেন, আমার সামর্থ্য নেই, আমি কোত্থেকে খাওয়াব? আমি নিজেই তো অভাব-অনটনে আছি। তারা দানশীল ব্যক্তিকে দান করতে উৎসাহ প্রদান ও সুপরামর্শ দিতে পারেন, প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নিতে পারেন। সহমর্মিতা ও আন্তরিকতা দিয়ে মানুষের সহযোগিতা করাও সওয়াবের কাজ। ইরশাদ হয়েছে, ‘অথবা খাদ্য দান করা দুর্ভিক্ষের দিনে। এতিম আত্মীয়-স্বজনকে। অথবা ধূলি-মলিন মিসকিনকে। অতঃপর সে তাদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যায়, যারা ইমান এনেছে এবং পরস্পরকে উপদেশ দেয় ধৈর্যধারণের, আর পরস্পরকে উপদেশ দেয় দয়া-অনুগ্রহের। তারাই সৌভাগ্যবান।’ -সুরা বালাদ : ১৪-১৮
ইসলামের শুরু থেকেই আল্লাহর রাসুল (সা.) মুসলমানদের এই বিষয়ে প্রয়োজনীয় শিক্ষা দান করেছেন। এমনকি হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.) মদিনায় গমন করে সর্বপ্রথম যে নির্দেশনাগুলো দিয়েছেন, তার মধ্যে একটি ছিল মানুষকে খাওয়ানো! হজরত আবদুল্লাহ ইবনে সালাম (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.) যখন মদিনায় এসে পৌঁছলেন, মানুষ তখন দলে দলে তার কাছে দৌড়ে গেল। বলাবলি হতে লাগল যে, রাসুলুল্লাহ (সা.) এসেছেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) এসেছেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) এসেছেন। অতএব, তাকে দেখার জন্য আমিও লোকদের সঙ্গে উপস্থিত হলাম। আমি হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর চেহারার দিকে তাকিয়ে দেখে বুঝতে পারলাম যে এই চেহারা কোনো মিথ্যুকের চেহারা নয়। তখন তিনি সর্বপ্রথম যে কথা বললেন তা এই- হে মানুষ! তোমরা সালামের প্রসার ঘটাও, খাদ্য দান করো এবং মানুষ ঘুমিয়ে থাকা অবস্থায় (তাহাজ্জুদ) নামাজ আদায় করো। তাহলে নিশ্চয়ই তোমরা সহি-সালামতে জান্নাতে প্রবেশ করবে। -সুনানে তিরমিজি : ২৪৮৫
হাদিসে কুদসিতে এসেছে, কিয়ামতের দিন আল্লাহতায়ালা বান্দাকে বলবেন- ‘… হে আদম সন্তান! আমি তোমার কাছে আহার চেয়েছিলাম তুমি আমাকে আহার করাওনি। সে বলবে, হে আমার প্রতিপালক আমি আপনাকে কীভাবে আহার করাব অথচ আপনি জগৎগুলোর প্রতিপালক! আল্লাহ বলবেন, তুমি কি জানতে না আমার অমুক বান্দা তোমার কাছে আহার চেয়েছিল তুমি তাকে আহার করাওনি। তুমি কি জানতে না! যদি তুমি তাকে আহার করাতে তবে তার কাছে আমাকে পেতে।’ -সহিহ মুসলিম : ২৫৬৯
ইসলাম কখনো কারও অবদান কিংবা দানকে ছোট করে দেখে না, পরিমাণে যা-ই হোক না কেন। সামান্য পরিমাণ দানকেও ইসলামে উৎসাহিত করা হয়েছে। তাই সক্ষমতা ও সামর্থ্য নিয়ে হীনম্মন্যতায় না ভুগে নিজের সামর্থ্য অনুযায়ী অভাবী মানুষের খাবারের ব্যবস্থা করা উচিত। এর অসিলায় আল্লাহ আমাদের সামর্থ্য বাড়িয়ে দিতে পারেন। তা ছাড়া উপার্জনের একটি নির্দিষ্ট অংশ, যদি নিয়ম করে আল্লাহর রাস্তায় খরচ করা যায়, এর উপকারিতা খুব দ্রুতই টের পাওয়া যায়। এর মাধ্যমে উপার্জনে বরকত হয়, নানা ধরনের বিপদ কেটে যায়। সবচেয়ে বড় কথা, আল্লাহতায়ালা সন্তুষ্ট হন। আর আল্লাহর সন্তুষ্টিই মুমিন-মুসলমানের একমাত্র লক্ষ্য।
লেখক : শিক্ষক ও ইসলামবিষয়ক লেখক/muftianaet@gmail.com
ভয়েস/আআ/সূত্র: দেশ রূপান্তর