শনিবার, ০৪ অক্টোবর ২০২৫, ০৫:১৯ পূর্বাহ্ন
মেসবাহ্ উদ্দিন চৌধুরী:
বিশ্বে জ্বালানি ও খাদ্যদ্রব্যের পর তৃতীয় বৃহৎ অর্থনৈতিক খাত হলো পর্যটন। বর্তমানে বিশ্বের ৪৪টি দেশের প্রধান আয়ের উৎস পর্যটনশিল্প, যা দেশগুলোর মোট জিডিপির প্রায় ৩০ শতাংশ। মালদ্বীপ, অ্যান্টিগুয়া অ্যান্ড বারমুডা, সিচেলিস, ম্যাকাও-এর মতো দেশগুলোতে পর্যটনের অবদান ৬৫ শতাংশেরও বেশি। পর্যটনশিল্প প্রত্যক্ষভাবে বৈশ্বিক জিডিপিতে প্রায় ৩.৬ শতাংশ এবং পরোক্ষভাবে ১০.৩ শতাংশ অবদান রাখে। গবেষণায় দেখা যায়, আন্তর্জাতিক পর্যটকরা শুধু ২০১৯ সালেই ভ্রমণ বাবদ ব্যয় করেছেন ১.৮ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার। ২০২০ সালে করোনাভাইরাসের কারণে পর্যটনশিল্পের গ্রাফে ঋণাত্মক গতিপথ দেখা গেলেও ২০২১ সাল থেকে তা আবার ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করে। বৃহৎ এ পর্যটনশিল্পের ধারাবাহিক উন্নয়ন, নিত্যনতুন পর্যটন ধারণা তৈরি ও পর্যটন সম্ভাবনাময় দেশগুলোকে উৎসাহ দিতে প্রতি বছর ২৭ সেপ্টেম্বর পালিত হয় বিশ্ব পর্যটন দিবস। বিশ্ব পর্যটন সংস্থার উদ্যোগে দিবসটি উপলক্ষে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে নানা কর্মসূচির আয়োজন করা হয়। এ দিবসে দেশগুলো নিজ নিজ ইতিহাস, ঐতিহ্য ও দর্শনীয় স্থানসমূহ ব্র্যান্ডিং করে পর্যটক আকর্ষণ করতে চেষ্টা চালায়। মূলত পর্যটন সম্পর্কে সচেতনতা, সামাজিক, সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক উপযোগিতাকে বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে দেওয়ার লক্ষ্যে জাতিসংঘের বিশ্ব পর্যটন সংস্থার তত্ত্বাবধানে ১৯৮০ সাল থেকে প্রতি বছরের ২৭ সেপ্টেম্বর বিশ্বব্যাপী পালিত হয়ে আসছে বিশ্ব পর্যটন দিবস। এ বছর দিবসটির প্রতিপাদ্য নির্বাচন করা হয়েছে ‘জবঃযরহশ ঞড়ঁৎরংস’।
বাংলাদেশে বিপুল সম্ভাবনাময় পর্যটন খাত আন্তর্জাতিক পর্যটকদের আকর্ষণের চেষ্টা করে যাচ্ছে। এর মধ্যেই বৈশ্বিক করোনা মহামারী ও অর্থনৈতিক মন্দার প্রভাবে দেশের পর্যটনশিল্প অনেকটাই হোঁচট খেয়েছে। বিআইডিএসের তথ্যানুযায়ী, ২০২০ সালে কভিডের প্রভাবে বাংলাদেশের পর্যটন খাতে ক্ষতির পরিমাণ প্রায় ৬০ হাজার কোটি টাকা। এ সময়ে পর্যটনের সঙ্গে সম্পৃক্ত ১ লাখ ৪১ হাজার মানুষ তাদের কাজ হারিয়েছে। কভিড পরিস্থিতিতে লকডাউন, শাটডাউন ও ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞার ফলে জীবন-জীবিকা নিয়ে অনিশ্চয়তার মধ্যে ছিলেন পর্যটনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট প্রায় ৭০ শতাংশ জনবল। ব্যবসা পরিচালনা খরচ, ব্যাংকের সুদ, কর্মচারীদের বেতন, বিদ্যুৎ-গ্যাস বিলের কারণে অনেকে ব্যবসা গুটিয়েছেন আবার কেউ কেউ পেশা বদলিয়েছেন।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর এক প্রতিবেদনে বলা হয় জিডিপিতে পর্যটন খাতের অবদান ৩.০২ শতাংশ, পাশাপাশি মোট কর্মসংস্থানের ৮.০৭ শতাংশ সুযোগ তৈরি করছে এই খাত। পর্যটনশিল্প বর্তমান বিশ্বের আর্থসামাজিক উন্নয়নের অন্যতম প্রধান হাতিয়ার হিসেবে বিবেচিত। ধারণা করা হচ্ছে, এ বছর প্রায় ১৩৯ কোটি ৫৬ লাখ ৬০ হাজার পর্যটক বিশ^ময় ভ্রমণ করবেন। এ বছরের প্রথম পাঁচ মাসে এ পর্যন্ত ২৫০ মিলিয়ন পর্যটক দর্শনীয় স্থানগুলো ভ্রমণ করেছেন, যা ২০১৯ সালের করোনা-পূর্ববর্তী সময়ের তুলনায় প্রায় ৪৬ শতাংশ কম। তাই আশা করা যাচ্ছে ২০২২ সালে পর্যটনশিল্প আলোর মুখ দেখবে। কিন্তু বিশ্বের তুলনায় বাংলাদেশ এ শিল্পে কিছুটা পিছিয়ে রয়েছে।
দেশে পর্যটন খাতে এখন পর্যন্ত মোট কর্মসংস্থান হয়েছে প্রায় ৪০ লাখ লোকের। ২০১৯ সালে দেশের জাতীয় আয়ে পর্যটন খাতের অবদান ছিল ৯৫০.৭ বিলিয়ন টাকা, যা জিডিপির ৪.৩০ শতাংশ। অদূর ভবিষ্যতে তা ৬ শতাংশে পরিণত হবে। ‘ইনডেক্স মান্ডি’র তথ্য অনুযায়ী, পর্যটনশিল্পে বিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থান ১৪১তম, এশিয়ার মধ্যে ৪২তম এবং দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে ৪র্থ। বিবিএসের জরিপ অনুযায়ী, ২০১৮-১৯ অর্থবছরেই ২৯ লাখ ২১ হাজার ৫২০ বাংলাদেশি পর্যটক বিদেশ ভ্রমণ করেছেন, যাদের মধ্যে ৬০.৪ শতাংশ গিয়েছেন ভারতে। সব মিলিয়ে এতে ব্যয় হয়েছে ৩ লাখ ৩৬ হাজার ৮৬৮ মিলিয়ন টাকা।
বাংলাদেশ পর্যটনের অপার সম্ভাবনাময় একটি দেশ, যার রয়েছে হাজার বছরের ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি। ভৌগোলিকভাবেও বাংলাদেশ দারুণ সুবিধাজনক অবস্থানে রয়েছে। বিশ্বের সর্ববৃহৎ বালুকাময় সমুদ্রসৈকত কক্সবাজার, নয়নাভিরাম তিন পার্বত্য অঞ্চল, বিশ্বখ্যাত ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চল সুন্দরবন, হাজার বছরের পুরনো মৌর্য, পাল, সেন, সুলতানি ও মুঘল সাম্রাজ্যের প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন, যার সবকিছুই বিদেশি পর্যটক আকর্ষণের মূল উপাদান হতে পারে। দেশীয় ও বিদেশি পর্যটক আকর্ষণের জন্য আরেক সম্ভাবনা হতে পারে আমাদের নৈসর্গিক সুন্দর গ্রামগুলো। গ্রামীণ জনগোষ্ঠীকে অন্তর্ভুক্ত করে এর উন্নয়ন, পর্যটন সুবিধাদি বৃদ্ধি ও প্রচারণার মাধ্যমে অন্তর্ভুক্তিমূলক প্রবৃদ্ধি সম্ভব। হাওর বাংলাদেশের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যভিত্তিক অন্যতম পর্যটন আকর্ষণ, উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সাত জেলায় মোট ৪২৩টি হাওর নিয়ে বিশাল অঞ্চল জুড়ে পর্যটনের ব্যাপক সম্ভাবনা রয়েছে। তা ছাড়া সৌন্দর্যে ভরপুর সিলেটের চা বাগান, জাফলং, লালাখাল, বিছনাকান্দি, রাতারগুল সোয়াম্প ফরেস্ট হতে পারে আন্তর্জাতিক মানের পর্যটনকেন্দ্র।
বিশ্বব্যাপী ২০২১ সালে ইকো-ট্যুরিজমের বাজার ছিল ১৮৫.৮৭ বিলিয়ন ডলার, যা ২০২২ থেকে ২০৩০ সাল নাগাদ আরও ১৫.২ শতাংশ বৃদ্ধি পাবে। যে উপাদানগুলো দিয়ে ইকো-ট্যুরিজম তৈরি করা হয়, তার সবই বাংলাদেশের রয়েছে। উদাহরণস্বরূপ পাহাড়-পর্বত, নদী-নালা, সাগর-সৈকত, জীববৈচিত্র্য, বৃক্ষ-বনানী, প্রাণিকুল, সংস্কৃতি-সভ্যতা, ইতিহাস-ঐতিহ্য ও জীবনধারণ পদ্ধতি। বিশ্বের একক বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ বন সুন্দরবনকে ইকো-ট্যুরিজম হিসেবে গড়ে তোলা গেলে বাংলাদেশের পরিচিতি বহির্বিশ্বে আরও বিস্তৃত হবে। আমরা প্রায়ই আমাদের দেশের বিভিন্ন ঐতিহাসিক স্থান ও ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর বসবাস স্থানে ঘুরতে যাই, সেগুলোও আমাদের ইকো-ট্যুরিজমে পরিণত হতে পারে। দেশীয় সংস্কৃতিকে অগ্রাধিকার দিয়ে ট্যুরিজম পার্ক নির্মাণ করা যেতে পারে। অন্যতম ইকো-ট্যুরিজম পার্ক সাবরাংকে দেশি-বিদেশি পর্যটকদের সব ধরনের চাহিদা পূরণ করার লক্ষ্যে ‘বাংলাদেশের জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ ও ইকো-ট্যুরিজম উন্নয়ন’ নামে একটি প্রকল্প চলমান আছে। নির্মাণাধীন নাফ ট্যুরিজম পার্ক, সাবরাং ট্যুরিজম পার্ক এবং সোনাদিয়া ইকো-ট্যুরিজম পার্ক আগামী এক দশকে কমপক্ষে দুই লাখ লোকের কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করবে।
স্বপ্নের পদ্মা বহুমুখী সেতু উদ্বোধনের পর বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলের ২১ জেলার সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ স্থাপনে পর্যটনশিল্পে নতুন মাত্রা যোগ হয়েছে। এ সেতুটি নিজেই একটি প্রধান পর্যটনকেন্দ্রে পরিণত হয়েছে। মানুষ এ অঞ্চল দিয়ে দ্রুততম সময়ে যেতে পারবে ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট সুন্দরবন ও সাগরকন্যা কুয়াকাটায়। দক্ষিণাঞ্চলের বিভিন্ন চরগুলো ভারত ও মালদ্বীপের ন্যায় পর্যটনকেন্দ্র তৈরি করা গেলে প্রচুর পরিমাণ আন্তর্জাতিক পর্যটক আকর্ষণ করা সম্ভব। ফলে বলা যায়, দেশের পর্যটনের মানচিত্র পাল্টে দেবে পদ্মা সেতু। এ ছাড়া, যদি দেশের অভ্যন্তরে ভারতের গোয়া কিংবা কর্ণাটক রাজ্যের মতো পর্যটন এলাকা গড়ে তোলা যায় তাহলে আমাদের পর্যটকরা বিদেশের পরিবর্তে দেশকেই বেছে নেবেন। এতে দেশের অর্থনীতি যেমন শক্তিশালী হবে, তেমনি কর্মসংস্থান হবে আরও কয়েক লাখ মানুষের।
যোগাযোগ ও অবকাঠামোগত সমস্যা এবং নিরাপত্তার ঘাটতি নিয়ে পর্যটকরা উদ্বিগ্ন থাকেন। তা ছাড়া পর্যটনশিল্প খাতটির সঠিক উপলব্ধি ও আন্তর্জাতিক ভাষা জ্ঞানসহ এ খাতের উপযোগী সমৃদ্ধ জনবলের অপর্যাপ্ততার কারণে আমাদের পর্যটন খাত আশানুরূপ বিকাশ লাভ করতে পারেনি। তবে আমাদের অপার সম্ভাবনার পর্যটন খাতকে উন্নয়নের অগ্রগামী খাতে পরিণত করতে যুগোপযোগী পদক্ষেপ গ্রহণ করা দরকার।
লেখক : সামরিক বাহিনীতে কর্মরত
ভয়েস/আআ/সুত্র: দেশরূপান্তর