শুক্রবার, ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০৪:১২ পূর্বাহ্ন

দৃষ্টি দিন:
সম্মানিত পাঠক, আপনাদের স্বাগত জানাচ্ছি। প্রতিমুহূর্তের সংবাদ জানতে ভিজিট করুন -www.coxsbazarvoice.com, আর নতুন নতুন ভিডিও পেতে সাবস্ক্রাইব করুন আমাদের ইউটিউব চ্যানেল Cox's Bazar Voice. ফেসবুক পেজে লাইক দিয়ে শেয়ার করুন এবং কমেন্ট করুন। ধন্যবাদ।

অনাদরে সম্ভাবনার পর্যটন

ভয়েস নিউজ ডেস্ক:

পর্যটন খাতকে দাঁড় করাতে হিমশিম খাচ্ছে পর্যটনবিষয়ক প্রশাসন। কক্সবাজার, বান্দরবান, রাঙ্গামাটি, খাগড়াছড়িসহ দেশের বেশিরভাগ পর্যটন কেন্দ্র নানা সমস্যায় জর্জরিত। চুরি, ছিনতাই প্রভৃতি অপরাধ থামাতে কার্যকরী পদক্ষেপ নেই। পর্যটকরা ভ্রমণে গিয়ে সমস্যায় পড়ছে। হোটেল-মোটেলের ভাড়া আকাশচুম্বী। বিদেশি পর্যটকদের সংখ্যা ক্রমেই কমছে। পর্যটন খাতে চলছে মন্দাবস্থা। বিপুল সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও পর্যটন করপোরেশনের উদাসীনতায় খুঁড়িয়ে চলছে পর্যটনশিল্প খাত।

কর্তৃপক্ষ যদিও আশার বাণী শুনিয়ে বলছে, পর্যটন খাতকে ঘুরিয়ে দাঁড় করাতে ২০ বছরের পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। পর্যটন করপোরেশনের পাশাপাশি ট্যুরিস্ট পুলিশ এ নিয়ে কাজ করছে। পর্যটন কেন্দ্রগুলোতে কঠোর নিরাপত্তাবলয় গড়ে তুলতে বিশেষ নির্দেশনা দিয়েছে পুলিশ সদর দপ্তর।

পর্যটন বিশেষজ্ঞদের মতে, গত ২০ বছরে এক ইঞ্চিও এগোয়নি এই খাত। পর্যটন করপোরেশনের কাছে একটি ছাদখোলা বাসও নেই। সাফ ফুটবলজয়ী নারীদের ঘোরানোর জন্য বিআরটিসির বাস কেটে পরিস্থিতি সামাল দিতে হয়েছে। এমনই দৈন্যদশার মধ্যে আজ পালিত হচ্ছে বিশ্ব পর্যটন দিবস।

বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন প্রতিমন্ত্রী মাহবুব আলী বলেন, ‘পর্যটন খাতকে শক্তিশালী করতে নানা পরিকল্পনা করা হয়েছে। এগুলো কার্যকর হলে বাংলাদেশের পর্যটন শিল্প নতুন যুগে প্রবেশ করবে এবং পুুরোপুরি বদলে যাবে। করোনার কারণে দীর্ঘদিন বাংলাদেশে বিদেশিদের ভিসা দেওয়া বন্ধ ছিল। আজ (গতকাল সোমবার) বাংলাদেশে বিদেশি পর্যটক আসার ব্যাপারে বিধিনিষেধ তুলে নেওয়া হয়েছে। যেসব স্থানে নিরাপত্তার ঘাটতি রয়েছে সেসব স্থানে নিরাপত্তা বাড়াতে বলা হয়েছে। পুলিশও এ বিষয়ে কাজ করছে। পর্যটকদের জন্য যা যা করা দরকার তাই করা হবে।’ ওয়ার্ল্ড ট্রাভেল অ্যান্ড ট্যুরিজম কাউন্সিলের সর্বশেষ তথ্যানুযায়ী, করোনার কারণে পর্যটন খাত ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার পরও ২০২১ সালে বিদেশি পর্যটকদের কাছ থেকে ভারত ৮ হাজার ৮০০ মিলিয়ন ডলার, থাইল্যান্ড ৩ হাজার ৯০০ মিলিয়ন ডলার, মালদ্বীপ ২ হাজার ১৬০ মিলিয়ন ডলার, শ্রীলঙ্কা ৩০৫.২ মিলিয়ন ডলার আয় করেছে। বাংলাদেশ আয় করেছে মাত্র ১৬৭.২ মিলিয়ন ডলার, যা মিয়ানমারের আয়ের (২১২.৫ মিলিয়ন ডলার) থেকেও কম। তবে দেশি পর্যটকদের কাছ থেকে ২০২১ সালে বাংলাদেশের পর্যটন খাত পেয়েছে ৬ হাজার ৭৩৯.৪ মিলিয়ন ডলার সমমূল্যের টাকা।

করোনার আগে ২০১৯ সালে বাংলাদেশ বিদেশি পর্যটকদের কাছ থেকে আয় করে ৩৬৯.৬ মিলিয়ন ডলার। তখন থাইল্যান্ডের আয় ছিল ৬২ হাজার ৬০০ মিলিয়ন ডলার। জিডিপিতে অবদানের ক্ষেত্রেও পিছিয়ে আছে পর্যটন খাত। ২০১৯ সালে বৈশ্বিক জিডিপির ১০.৩ শতাংশ (৯ হাজার ৬৩০ বিলিয়ন ডলার) এসেছিল পর্যটন খাত থেকে। করোনার কারণে ২০২০ সালে সেটা কমে দাঁড়ায় ৫.৩ শতাংশে (৪ হাজার ৭৭৫ বিলিয়ন ডলার)। ২০২১ সালে বৈশ্বিক জিডিপির ৬.১ শতাংশ (৫ হাজার ৮১২ বিলিয়ন ডলার) আসে পর্যটন থেকে। ২০২১ সালে জিডিপিতে বাংলাদেশের পর্যটন খাতের অবদান ছিল মাত্র ২.২ শতাংশ অথচ মালদ্বীপে ছিল ৪৪.৬ শতাংশ, ভারতে ৫.৮ শতাংশ, থাইল্যান্ডে ৫.৮ শতাংশ, নেপালে ৪.৩ শতাংশ ও শ্রীলঙ্কায় ছিল ৩.১ শতাংশ।

বাংলাদেশের জিডিপিতে পর্যটন খাতের অবদান ছিল ২০১৯ সালে ৯ হাজার ৮১৩ দশমিক ৭ মিলিয়ন ডলার। ২০২০ সালে তা কমে দাঁড়ায় ৬ হাজার ২২৭ দশমিক ৮ মিলিয়ন ডলারে। ২০২১ সালে কিছুটা বেড়ে হয় ৭ হাজার ৮৩৩ দশমিক ৪ মিলিয়ন ডলার। তবে আয়ের সিংহভাগ আসে দেশি পর্যটকদের কাছ থেকে। ২০২১ সালের পর্যটন থেকে আয়ের মাত্র ২ শতাংশ এসেছিল বিদেশি পর্যটকদের কাছ থেকে। ২০১৯ সালে সেটা ছিল ৪ শতাংশ। ২০২১ সালে বিদেশি পর্যটকের ৫৯ ভাগই আসে ভারত থেকে। তা ছাড়া চীন থেকে ১৪, যুক্তরাষ্ট্র থেকে ৯, পাকিস্তান থেকে ৮, দক্ষিণ কোরিয়া থেকে ৭ ও অন্যান্য দেশ থেকে আসে ৩ ভাগ। পর্যটনের লীলাভূমি হওয়া সত্ত্বেও পশ্চিমা বিশ্বের খুব কমসংখ্যক পর্যটক পা রাখছেন বাংলাদেশে। অথচ এ সময়ে ভারত, শ্রীলঙ্কা, থাইল্যান্ড, ইন্দোনেশিয়া, মালদ্বীপ ভ্রমণকারী পর্যটকের একটা বড় অংশ ছিল ইউরোপের।

পর্যটন করপোরেশনের চেয়ারম্যান মো. আলী কদর বলেন, ‘আমাদের কাছে ছাদখোলা বাস নেই। জার্মানি থেকে ছয়টি অত্যাধুনিক মানের ছাদখোলা বাস কেনার উদ্যোগ নিয়েছি। পর্যটনের ব্র্যান্ডিং বা ভবিষ্যৎ উদ্যোগ নিয়ে আমরা কাজ করছি। ইতিমধ্যে ট্যুর প্রোগ্রাম শুরু করেছি। ঢাকা থেকে পদ্মা সেতু, পটুয়াখালী, রাঙ্গামাটি, সুন্দরবন ও অন্যান্য এলাকায় ট্যুর অপারেট করা হচ্ছে। রিভার ক্রুজ চালুর জন্য বিআইডব্লিউটিসির কাছ থেকে শিপ নেওয়ার চুক্তি করতে যাচ্ছি। এভাবেই অগ্রসর হতে হচ্ছে আমাদের।’

সংশ্লিষ্টরা দেশ রূপান্তরকে জানায়, বাংলাদেশের পর্যটনশিল্পে অপার সম্ভাবনা রয়েছে। পরিকল্পিতভাবে সেই সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে না পারায় দর্শনীয় স্থানগুলোতে দেশি-বিদেশি পর্যটকের আগমন ঘটানো যাচ্ছে না।

জানা গেছে, স্বল্প, মধ্যম ও দীর্ঘমেয়াদি পর্যটন পরিকল্পনা প্রণয়নের উদ্যোগ নিয়েছে বাংলাদেশ ট্যুরিজম বোর্ড। উন্নয়নের প্রকল্পগুলো বাস্তবায়ন করা হলে দেশিদের পাশাপাশি বিদেশি পর্যটকদের দেখা মিলবে বলে আশা। কক্সবাজার, রাঙ্গামাটি, বান্দরবান, খাগড়াছড়ি, কুয়াকাটাসহ বেশিরভাগ পর্যটন স্থানে নিরাপত্তার বালাই নেই। নানা সমস্যায় পড়তে হয় পর্যটকদের। ছিনতাইয়ের ঘটনা, পাশবিক নির্যাতনের ঘটনাও ঘটছে কোনো কোনো স্থানে। হোটেল-মোটেলে গলাকাটা ভাড়া নেওয়া হচ্ছে। পর্যটকরা প্রতিবাদও করতে পারেন না। দর্শনীয় স্থানগুলোতে নিরাপত্তা বাড়ানো হচ্ছে বলে জানিয়েছেন পুলিশ সদর দপ্তরের এক কর্মকর্তা। তিনি বলেন, ‘আমরা চেষ্টা করছি পর্যটকদের নিরাপত্তা দিতে। এ নিয়ে ট্যুরিস্ট পুলিশ কাজ করছে।’

টোয়াবের সাবেক নেতা তৌহিদুর রহমান বলেন, ‘পৃথিবীর দীর্ঘতম সমুদ্রসৈকত, বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ বন, লেক-পাহাড়ের মিশেলে পার্বত্য তিন জেলার অপরূপ নিঃসর্গ, চা বাগান, অসংখ্য ঐতিহাসিক ধর্মীয় স্থাপনা রয়েছে বাংলাদেশে। পর্যটনের অপার সুযোগ থাকার পরও বিদেশি পর্যটক টানতে ব্যর্থ হয়েছি আমরা। শুধু অভ্যন্তরীণ পর্যটক দিয়ে টিকে আছে এই খাত। বিদেশি পর্যটকের অভাবে আসছে না কাক্সিক্ষত বৈদেশিক মুদ্রা।’

হোটেল আগ্রাবাদের স্বত্বাধিকারী হাকিম আলী বলেন, ‘পর্যটন সবসময়ই আশাব্যঞ্জক ছিল। সরকারি-বেসরকারি উভয় উদ্যোগেই পর্যটন প্রসারিত হচ্ছে। করোনার পরও আমরা ঘুরে দাঁড়াচ্ছি। আগামী দুই বছরের মধ্যে অবশ্যই তা চোখে পড়বে। আমাদের সবচেয়ে বেশি দরকার বিদেশি পর্যটক। তার জন্য অন-অ্যারাইভাল ভিসা আরও সহজ করতে হবে।’

ট্যুর অপারেটর নজরুল ইসলাম বলেন, ‘বাংলাদেশে ভালো ভালো পর্যটন স্পট থাকলেও সেবায় আমরা পিছিয়ে। বিদেশি পর্যটক আকৃষ্ট হচ্ছে না। যারা আসেন তারাও জমানো টাকা খরচ করে যেতে পারেন না। পর্যটন করপোরেশনের কাছে ছাদখোলা বাস নেই। পর্যটন বিষয়ে তেমন প্রচার-প্রচারণা নেই। বিদেশি পর্যটকদের লাইফস্টাইল, তারা কোন সুবিধাগুলো চায়, তা মাথায় রেখে পর্যটন খাতকে সাজাতে হবে। আকর্ষণ করতে যেসব উপকরণ লাগে, তা আমাদের নেই। নেই কাঠামোও। আমাদের যেসব প্রাকৃতিক সম্পদ আছে, আমাদের যে সৈকত আছে, ম্যানগ্রোভ বন আছে সেগুলোকে যদি আকর্ষণীয় করতে চাই তবে ন্যাচার-ওরিয়েনটেট ট্যুরিস্টদের আকৃষ্ট করার ব্যবস্থা দরকার। সেভাবেই প্রোমো তৈরি করে আকৃষ্ট করতে হবে বিদেশিদের। তৈরি করতে হবে প্রয়োজনীয় অবকাঠামোও।’

সূত্র জানায়, বাংলাদেশ ট্যুরিজম বোর্ডের মহাপরিকল্পনার প্রথম পর্যায়ে বিশ্লেষণ করা হবে দেশের পর্যটন শিল্পের বর্তমান শক্তি কতটুকু, দুর্বলতা কোথায়, সম্ভাবনা কেমন এবং কোন ধরনের সংকট রয়েছে। দ্বিতীয় পর্যায়ে নির্ধারণ করা হবে পর্যটনের ভিশন, মিশন, স্ট্র্যাটেজিক অবজেকটিভস, প্রায়োরিটিস এবং লিংকেজ। তৃতীয় পর্যায়ে জোন বা এরিয়া নির্দিষ্ট করে অঞ্চলভিত্তিক পরিকল্পনা করতে হবে। প্রোডাক্ট উন্নয়নের পরিকল্পনা, অর্থায়ন ও বিনিয়োগের কৌশল অন্তর্ভুক্ত করে কর্মপরিকল্পনা প্রস্তুত এবং বিপণন ও প্রমোশনাল কৌশল নির্ধারণ করা হবে। এ ছাড়া মেলা, ফেস্টিভাল, কার্নিভাল, কালচারাল অনুষ্ঠান, ব্র্যান্ডিং, সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রচারণা, ভিডিও নির্মাণ, ডিজিটাল স্ক্রিনে প্রদর্শনী ও ওশান ট্যুরিজমকে বেসরকারি উদ্যোগে চালুর পরিকল্পনাও রয়েছে তাদের। দর্শনীয় স্থানের মধ্যে তিন পার্বত্য জেলা, নিঝুম দ্বীপ, হাতিয়া, সোনাদিয়া, পতেঙ্গা, মৌলভীবাজার, মহেশখালী, চট্টগ্রামের ফয়’স লেক, চাঁপাইনবাবগঞ্জসহ ইতিহাস-ঐতিহ্যে সমৃদ্ধ স্থান, পাহাড়পুর বিহার, শালবন বিহার, মহাস্থানগড়, রানী ভবানীর কীর্তি, বিভিন্ন মসজিদ, মন্দির, গির্জা, ময়নামতি, রামসাগর, সোনারগাঁ, নাটোর, রাজবাড়ী, দীঘাপাতিয়া জমিদার বাড়ি, তাজহাট জমিদার বাড়ি, কক্সবাজারের বৌদ্ধমন্দির, ঢাকার লালবাগ দুর্গ, আহসান মঞ্জিল, গৌড় লক্ষ্মণাবতী শহর, বাগেরহাটের অযোধ্যা মঠ, সিলেটের জাফলং, মৌলভীবাজারের মাধবকু- জলপ্রপাত, সাজেক, বাঘাইছড়ি, বরকল, বিলাইছড়ি, লংগদু, নানিয়ারচর প্রভৃতি স্থানে কঠোর নিরাপত্তাবলয় গড়ে তোলা হবে।

জাতিসংঘের বিশ্ব পর্যটন সংস্থার (ইউএনডব্লিউটিও) উদ্যোগে ১৯৮০ সাল থেকে ২৭ সেপ্টেম্বর বিশ^ পর্যটন দিবস পালন করা হয়। প্রতি বছরের মতো এবারও বিভিন্ন অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে। দিবসটি উপলক্ষে রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বাণী দিয়েছেন।

ভয়েস/আআ

Please Share This Post in Your Social Media

© All rights reserved © 2023
Developed by : JM IT SOLUTION