রবিবার, ২৯ Jun ২০২৫, ১১:৩৭ অপরাহ্ন

দৃষ্টি দিন:
সম্মানিত পাঠক, আপনাদের স্বাগত জানাচ্ছি। প্রতিমুহূর্তের সংবাদ জানতে ভিজিট করুন -www.coxsbazarvoice.com, আর নতুন নতুন ভিডিও পেতে সাবস্ক্রাইব করুন আমাদের ইউটিউব চ্যানেল Cox's Bazar Voice. ফেসবুক পেজে লাইক দিয়ে শেয়ার করুন এবং কমেন্ট করুন। ধন্যবাদ।

রোহিঙ্গা নেতা মুহিবুল্লাহ হত্যা মামলার এক বছর: কমেনি অপরাধ

আবদুল আজিজ:

রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে সোচ্ছার হওয়া রোহিঙ্গাদের শীর্ষ নেতা মুহিবুল্লাহ হত্যা মামলার আজ এক বছর। গত বছরের আজকের এই দিনে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে নিজ অফিসে তাকে গুলি করে হত্যা করে পালিয়ে যায় সন্ত্রাসীরা। বর্তমানে মুহিবুল্লাহ হত্যা মামলাটি আদালতে সাক্ষ্যগ্রহন চলছে। কানাডায় আশ্রয় মিলেছে পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের। ক্যাম্পে দিনের পর দিন বাড়ছে অপরাধ।

গত ২০২১ইং সালের ২৯ সেপ্টেম্বর রাতে কক্সবাজারের উখিয়ার লম্বাশিয়া রোহিঙ্গা শিবিরের ডি ব্লকে বন্দুকধারীর গুলিতে নিহত হন রোহিঙ্গা মুহিবুল্লাহ। তিনি আরাকান রোহিঙ্গা সোসাইটি ফর পিস অ্যান্ড হিউম্যান রাইটস (এআরএসপিএইচ) নামের সংগঠনের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান। সংগঠনের কার্যালয়ে তাকে হত্যা করা হয়। এ ঘটনায় ওই বছরের ৩০ সেপ্টেম্বর মুহিবুল্লাহর ছোট ভাই হাবিবুল্লাহ বাদী হয়ে অজ্ঞাত পরিচয়ের সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে উখিয়া থানায় হত্যা মামলা করেন। মামলাটি তদন্তের দায়িত্ব পান উখিয়া থানার ওসি-তদন্ত সালাহ উদ্দিন। তদন্তে মুহিবুল্লাহ হত্যাকান্ডে ৩৬ জনের তথ্য পেলেও নাম-ঠিকানা না জানায় সাতজনকে বাদ দিয়ে ২৯ জনের বিরুদ্ধে চলতি বছরের গত ১৩ জুন আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করা হয়। সর্বশেষ উক্ত মামলায় ১২ সেপ্টেম্বর কক্সবাজার জেলা ও দায়রা জজ আদালতে ২৯ আসামির বিচার শুরু হয়েছে। কক্সবাজার জেলা ও দায়রা জজ মোহাম্মদ ইসমাইল তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করে বিচার শুরুর আদেশ দেন। বর্তমানে মামলাটি সাক্ষ্যগ্রহন চলছে।

কক্সবাজার জেলা ও দায়রা জজ আদালতের পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) অ্যাডভোকেট ফরিদুল আলম জানিয়েছেন, ‘রোহিঙ্গা নেতা মুহিবুল্লাহ হত্যা মামলার আজ এক বছর পূর্ণ হয়েছে। মামলাটি আদালতে দ্রুতভাবে সব প্রক্রিয়া চলছে। বর্তমানে মামলাটির অভিযোগপত্রের ওপর শুনানি শেষে আদালত ২৯ আসামির বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করে। আসামিদের মধ্যে ১৫ জন আদালতে হাজির ছিল। বাকি ১৪ আসামি পলাতক। মামলায় ৩১ জনকে সাক্ষী করা হয়েছে। পরবর্তী ধার্য দিনে সাক্ষ্যগ্রহণ শুরু হবে।

কে এই মুহিবুল্লাহ?
চল্লিশোর্ধ্ব মুহিবুল্লাহ মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের মংডু এলাকার স্কুলশিক্ষক ছিলেন। গত ২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট মিয়ানমারের সহিংসতার মুখে রাখাইন থেকে কক্সবাজারে সপরিবাওে পালিয়ে রোহিঙ্গা ক্যাম্পের বাসিন্দা হন তিনি। এরপর সাধারণ রোহিঙ্গাদের পাশে থেকে স্বদেশে প্রত্যাবাসনের জন্য কাজ করেন তিনি। একারণে মুহিবুল্লাহ বিদেশি বিশেষ করে পশ্চিমা সংবাদমাধ্যমে ‘রোহিঙ্গাদের কণ্ঠস্বর’ হিসেবে পরিচিত ছিলেন। কারণ রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে নেওয়া নানা উদ্যোগে মুহিবুল্লাহর ভূমিকা ছিল। বিশেষ করে মুহিবুল্লাহ কয়েক দফায় সৌদি আরব ও সংযুক্ত আরব আমিরাত সফর করেন। ইংরেজি ভাষা জানা ও রোহিঙ্গাদের অভ্যন্তরীণ যোগাযোগের দক্ষতা মুহিবুল্লাহকে ধীরে ধীরে বিদেশিদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ করে তোলে। জাতিসংঘ মহাসচিবসহ বিদেশি প্রতিনিধিরা যখনই রোহিঙ্গা ক্যাম্পে গেছেন, তাদের প্রত্যেকের সঙ্গেই রোহিঙ্গা প্রতিনিধি হিসেবে মুহিবুল্লাহ যোগ দিয়েছেন। গত ২০১৯ সালে যুক্তরাষ্ট্রের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে দেখা করে আলোচনায় আসেন তিনি। জেনেভায় জাতিসংঘ মানবাধিকার সংস্থায়ও রোহিঙ্গাদের প্রতিনিধিত্ব করেছিলেন তিনি।

মুহিবুল্লাহকে কেন হত্যা করো হয়?
হত্যাকান্ডের পর রোহিঙ্গা নেতা মুহিবুল্লাহর স্বজন ও অনুসারীরা দাবি করেন, প্রত্যাবাসনবিরোধী এক সশস্ত্র সংগঠন তাকে হত্যা করেছে। সংগঠনটি তাকে আগে থেকেই হুমকি দিয়ে আসছিল। কারণ তিনি রোহিঙ্গাদের দেশে ফিরে যাওয়ার জন্য উদ্বুদ্ধ করতেন। কিন্তু রোহিঙ্গাদের মধ্যেই একটা অংশ দেশে ফিরতে চায় না। সশস্ত্র দলটির সঙ্গে ‘মিয়ানমারের সরকারি বাহিনীর যোগাযোগ’ রয়েছে বলেও ক্যাম্পের অনেকের বিশ্বাস।

ক্যাম্প ছেড়ে কানাডায় মুহিবুল্লাহর পরিবার:
রোহিঙ্গাদের শীর্ষ নেতা মুহিবুল্লাহকে গুলি করে হত্যার পর নিরাপত্তাহীনতায় ছিল পরিবারের অন্যান্য সদস্যরা। তাই বাংলাদেশ সরকারের সহযোগিতায় কানাডা সরকার মুহিবুল্লাহর পরিবারকে কানাডায় আশ্রয়ের উদ্যোগ নেন। এরই অংশ হিসাবে গত ১ এপ্রিল তার পরিবারের ১১ সদস্য কানাডার উদ্দেশে ঢাকা ছাড়েন। সর্বশেষ ২৬ সেপ্টেম্বর দ্বিতীয় দফায় মুহিবুল্লাহর পরিবারের আরও ১৪জন সদস্য কানাডার উদ্দেশ্যে ক্যাম্প ছেড়েছেন।

অশান্ত রোহিঙ্গা ক্যাম্প:
রোহিঙ্গা নেতা মুহিবুল্লাহকে হত্যার পর থেকে অশান্ত হয়ে উঠে রোহিঙ্গা ক্যাম্প। বিশেষ করে রোহিঙ্গা ক্যাম্প কেন্দ্রিক সংঘবদ্ধ সন্ত্রাসী গোষ্ঠিরা ক্যাম্পের নেতা ও স্বেচ্ছাসেবকরা টার্গেটে পরিণত হয়। ফলে গত ৪ মাসে ক্যাম্পে টার্গেট কিলিং এ শিকার হয়েছে ১৬ জন নেতা ও স্বেচ্ছাসেবক। সচেতনমহল ও আইন শৃঙ্খলা রক্ষায় নিয়োজিত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, রোহিঙ্গাদের মধ্যে নেতৃত্ব না মানার প্রবণতা; অপরাধের প্রতিবন্ধকতা আধিপত্য বিস্তারের কারণে এসব খুন সংগঠিত হচ্ছে। রোহিঙ্গারা যাতে সংঘবদ্ধ হয়ে নিজের অধিকারের কথা বলতে না পারেন তার জন্য এসব টার্গেট খুন হচ্ছে।

কক্সবাজার জেলা পুলিশ কি বলছেন:
কক্সবাজারের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মো: রফিকুল ইসলামের দেয়া তথ্য অনুযায়ী ২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট থেকে ২০২২ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর রোহিঙ্গা ক্যাম্পে ১১৬ টি হত্যাকা- সংঘটিত হয়েছে। এর মধ্যে গত ৪ মাসে ১৬ টি খুনের ঘটনা ঘটেছে। আর এসব খুনের শিকার হওয়া রোহিঙ্গারা ক্যাম্প ভিত্তিক ব্যবস্থাপনা কমিটির নেতা (মাঝি) ও স্বেচ্ছায় পাহারারত স্বেচ্ছাসেবক। বর্তমানে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়ন (এপিবিএন) এর ৩টি ব্যাটালিয়ন আইনশৃংখলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে কাজ করছেন। জেলা পুলিশ এপিবিএনকে সহযোগিতা দিয়ে যাচ্ছেন বলে জানান পুলিশের ওই কর্মকর্তা।

এপিবিএনের তথ্যে কি আছে:
কক্সবাজারের উখিয়া-টেকনাফের ৩২ টি ক্যাম্পে আমর্ড পুলিশ ৩ টি ব্যাটালিয়নের (এপিবিএন) নিরাপত্তায় নিয়োজিত রয়েছে। তাদরে দেয়া তথ্য মতে, ২২ সেপ্টেম্বর মোহাম্মদ এরশাদ (২২) নামের একজন স্বেচ্ছাসেবক খুন হন। ২১ সেপ্টেম্বর খুন হন মোহাম্মদ জাফর (৩৫) নামের এক নেতা (মাঝি)। ১৮ সেপ্টেম্বর খুন হন আরেক স্বেচ্ছাসেবক মোহাম্মদ ইলিয়াস (৩৫)। ৯ আগস্ট দুই রোহিঙ্গা নেতা, ৮ আগস্ট টেকনাফের নয়াপাড়া রোহিঙ্গা ক্যাম্পের এক স্বেচ্ছাসেবক খুন হন। ১ আগস্ট একই ক্যাম্পে সন্ত্রাসীদের গুলিতে আহত হয়ে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় এক নেতা মারা যার। ১ আগস্ট উখিয়ার মধুরছড়া রোহিঙ্গা ক্যাম্পে রোহিঙ্গা স্বেচ্ছাসেবক, গত ২২ জুন কথিত আরসা নেতা মোহাম্মদ শাহ এবং ১৫ জুন একই গ্রুপের সদস্য মো. সেলিম (৩০) সন্ত্রাসীদের গুলিতে নিহত হন। ১৬ জুন রাতে উখিয়া ক্যাম্পে স্বেচ্ছাসেবক, ১০ জুন কুতুপালংয়ের চার নম্বর ক্যাম্পের আরেক স্বেচ্ছাসেবক, ৯ জুন এক রোহিঙ্গা নেতা, জুনের শুরুতে মে মাসে খুন হন রোহিঙ্গা নেতা সানা উল্লাহ (৪০) ও সোনা আলী (৪৬)।

স্থানীয়রা কি ভাবছে:
কক্সবাজারের উখিয়া কুতুপালং এলাকা স্থানীয় ইউপি সদস্য হেলাল উদ্দিন জানান, সম্প্রতি ক্যাম্পের পরিস্থিতি নিয়ে স্থানীয় জনগন নিরাপত্তাহীনতায় রয়েছে। ক্যাম্প ভিত্তিক মাঝি (নেতা), সাব-মাঝি, স্বেচ্ছাসেবকদের খুন করে সশস্ত্র সন্ত্রাসীরা তাদের অবস্থান ঘোষণা করে যাচ্ছে।

কক্সবাজার পিপলস্ ফোরামের সাধারণ সম্পাদক ফরহাদ ইকবাল জানান, রোহিঙ্গারা স্বাভাবিকভাবে নেতা মানতে চান না। কেউ নেতা হয়ে উঠবে বা তাদের নিয়ন্ত্রণ করতে তা না মানার প্রবণতা তাদের রয়েছে। এ সুযোগকে কাজ লাগিয়ে নেতৃশূণ্য করার কোন মিশন সশস্ত্র গোষ্ঠি বা ভিন্ন কোন মহল করছে কি না তা দেখা জরুরী।

খুনের দায় স্বীকার করে ভিডিও বার্তা:
রোহিঙ্গা ক্যাম্পে হত্যাকান্ডের ৪ মাঝিকে খুনের দায় স্বীকার কওে মো: হাসিম (২১) নামের এক রোহিঙ্গা যুবকের ভিডিও বার্তা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয়েছে। ভিডিও বার্তায় ক্যাম্পের দায়িত্বরত মাঝিদের কীভাবে কার ইন্ধনে খুন করেছে তার বর্ণনা দেয়া হয়েছে। গত ১ মাসে ৪ নেতা খুনের বিষয়টি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভিডিও আকারে প্রকাশ করেন তিনি। এতে একটি অস্ত্র হাতে কোন ক্যাম্পের কোন মাঝিকে কীভাবে হত্যা করেছিল তার বর্ণনা দিচ্ছেন। ভিডিওতে তাকে বলতে দেখা যায়, তার মতো ২৫ জন যুবককে অস্ত্র দিয়েছে ইসলামী সংগঠন মাহাজ সৃষ্টি করেছে ক্যাম্পের কতিপয় ব্যক্তি।

এব্যাপারে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে দায়িত্বরত ৮ আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নের (এপিবিএন) অতিরিক্ত পুলিশ সুপার ফারুক আহমেদ বলেন, ‘সামাজিত যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া ভিডিওটি যাচাই-বাচাই চলছে। একই সাথে ভিডিওতে এই যুবক যাদের নাম উল্লেখ করেছে, তদন্ত সাপেক্ষ তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এছাড়া ক্যাম্পের নিরাপত্তার জন্য আমরা সবসময় সজাগ রয়েছি।

ভয়েস/আআ

Please Share This Post in Your Social Media

© All rights reserved © 2023
Developed by : JM IT SOLUTION