শনিবার, ০৪ অক্টোবর ২০২৫, ০৩:১৯ পূর্বাহ্ন

দৃষ্টি দিন:
সম্মানিত পাঠক, আপনাদের স্বাগত জানাচ্ছি। প্রতিমুহূর্তের সংবাদ জানতে ভিজিট করুন -www.coxsbazarvoice.com, আর নতুন নতুন ভিডিও পেতে সাবস্ক্রাইব করুন আমাদের ইউটিউব চ্যানেল Cox's Bazar Voice. ফেসবুক পেজে লাইক দিয়ে শেয়ার করুন এবং কমেন্ট করুন। ধন্যবাদ।

মিয়ানমারের মোকাবিলায় বন্ধুহীন বাংলাদেশ

মাহবুবুল আলম তারেক:

গত মাসে মিয়ানমারের রাখাইন প্রদেশের বিদ্রোহীদের সঙ্গে দেশটির সেনাবাহিনীর সংঘর্ষের সময় একাধিকবার বেশ কিছু গোলা বাংলাদেশ সীমান্তের ভেতরেও এসে পড়েছে। এ ছাড়া মিয়ানমারের যুদ্ধবিমান বাংলাদেশের আকাশসীমাও লঙ্ঘন করেছে। ধারণা করা হচ্ছে, এই গোলা ছুড়েছে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী। এমনকি গোলাগুলোর কয়েকটি ইচ্ছাকৃতভাবেই ছোড়া হয়েছে। এর মাধ্যমে তারা হয়তো বাংলাদেশকে বিশেষ কোনো বার্তা দিতে চায়। হতে পারে রাখাইনের বিদ্রোহী গোষ্ঠী আরাকান আর্মির ব্যাপারে বাংলাদেশকে সাবধান করতে চায় এবং রাখাইন ও চীন প্রদেশের গৃহযুদ্ধে বাংলাদেশকে কঠোরভাবে নিরপেক্ষ থাকার জন্য বলছে। কারণ, সম্প্রতি আরাকান আর্মি ইঙ্গিত দিয়েছে, বাংলাদেশ যদি তাদের স্বীকৃতি দিয়ে সহযোগিতা করে তাহলে তারাও রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিতে সহায়তা করবে।

তবে, মিয়ানমারের রাখাইন প্রদেশের গৃহযুদ্ধে বাংলাদেশ নিরপেক্ষই রয়েছে। এমন কোনো সাক্ষ্য-প্রমাণ নেই যে, রাখাইনের ভেতরের ঘটনাবলিতে বা চীন প্রদেশের বিদ্রোহেও বাংলাদেশ কোনো পদক্ষেপ বা ভূমিকা নিয়েছে। ১১ লাখ রোহিঙ্গা শরণার্থীর বোঝা চাপিয়ে দেওয়ার পরও বাংলাদেশ রাখাইন থেকে দূরে এবং নিরপেক্ষ অবস্থানেই রয়েছে। তার পরও মিয়ানমারের সেনাবাহিনী এমন উসকানিমূলক আচরণ করছে। এ থেকে স্পষ্ট যে, মিয়ানমারের গৃহযুদ্ধের উত্তাপ বাংলাদেশেও এসে পড়বে। আর এখন শুধু বাংলাদেশ সীমান্তবর্তী রাখাইন বা চীন প্রদেশেই নয় বরং পুরো মিয়ানমারেই রীতিমতো গৃহযুদ্ধ চলছে। সেনা শাসনের বিরুদ্ধে গণতন্ত্রপন্থিদের সঙ্গে দেশটির বিভিন্ন প্রদেশের বিচ্ছিন্নতাবাদীরাও একটি জাতীয় ঐক্যের সরকার গড়ার জন্য এক হয়ে লড়াই শুরু করেছে।

অনেক বিশ্লেষক আবার বলছেন, এই উসকানির পেছনে চীন দেশের হাতও থাকতে পারে। একদিকে ভারত এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশকে কোয়াড জোটে যোগ দেওয়ার জন্য চাপ দিচ্ছে। অন্যদিকে, চীন চায় বাংলাদেশ যেন তাদের নেতৃত্বাধীন গ্লোবাল ডেভেলপমেন্ট ইনিশিয়েটিভ (জিডিআই) এবং গ্লোবাল সিকিউরিটি ইনিশিয়েটিভে (জিএসআই) যোগ দেয়। এখন মিয়ানমারকে দিয়ে বাংলাদেশে গোলাবর্ষণের মাধ্যমে চীন হয়তো ইঙ্গিত দিচ্ছে, অবাধ্য হলে তারা চাইলে বাংলাদেশের জন্য আরও বড় সমস্যাও তৈরি করতে পারে।

তবে চলমান এই ভূরাজনৈতিক খেলার আরও বহু বছর আগে থেকেই মিয়ানমার ভূ-অর্থনৈতিক দিক থেকেও বাংলাদেশের জন্য বড় ধরনের হুমকি হয়ে উঠছিল। এমনকি ভারত মহাসাগর এবং বঙ্গোপসাগরে চীন, ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রের আধিপত্য বিস্তারের লড়াইয়ে মিয়ানমার বাংলাদেশের স্বার্থের বিপরীতে ব্যবহৃত হওয়ার ক্ষেত্র প্রায় প্রস্তুত। ফলে মিয়ানমার ইস্যুতে আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে আমরা এখন অনেক বেশি নাজুক অবস্থার মধ্যে রয়েছি। কারণ মিয়ানমারের মোকাবিলায় বাংলাদেশ প্রায় বন্ধুহীন হয়ে পড়েছে।

রাখাইন প্রদেশসহ পুরো মিয়ানমারেই চীন ও ভারতের বিশাল বিনিয়োগ রয়েছে। রাখাইন প্রদেশে গভীর সমুদ্র বন্দর প্রকল্পে চীন হাজার হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ করছে। ভারতও এর ভাগীদার হতে চায়। ভারত অবশ্য, ২০১৬ সালেই রাখাইনের রাজধানী সিত্তের উপকূলে একটি সমুদ্র বন্দর নির্মাণ করেছে। চীন ও ভারত উভয় দেশই বঙ্গোপসাগর এবং ভারত মহাসাগর হয়ে রপ্তানি ও আমদানি বাণিজ্যের জন্য মিয়ানমারের বন্দরগুলো ব্যবহার করছে। রাখাইন প্রদেশে তেল, গ্যাস, বিদ্যুৎ, সড়ক এবং বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলসহ বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পেও তারা বিপুল পরিমাণ অর্থ বিনিয়োগ করেছে। এ ছাড়া, জাপান, থাইল্যান্ড, দক্ষিণ কোরিয়া, সিঙ্গাপুরেরও মিয়ানমারে বিশাল বিনিয়োগ রয়েছে। সম্প্রতি মিয়ানমার রাশিয়ার সঙ্গেও সম্পর্ক গভীর করেছে। ফলে জাতিসংঘের মতো বৈশ্বিক বা আসিয়ানের মতো আঞ্চলিক কোনো বহুজাতিক ফোরামের কাছ থেকেও বাংলাদেশ সামান্যতম সাহায্যও আশা করতে পারে না।

মিয়ানমারের সবচেয়ে বড় শক্তির জায়গা চীনের সঙ্গে তাদের গভীর সম্পর্ক। ১৯৪৮ সালে স্বাধীনতার আগে থেকেই মিয়ানমার ও চীন পরস্পরকে ‘সহোদর’ ভাই বলে সম্বোধন করত; যা থেকে তাদের সম্পর্কের ঘনিষ্ঠতা অনুমান করা যায়। মিয়ানমারের দিক থেকে ঐতিহাসিকভাবেই চীন তার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রতিবেশী। কারণ চীনের সঙ্গে দেশটির রয়েছে ১৩৪৮ মাইলের এক বিশাল সীমান্ত। মিয়ানমারে সামরিক সরকার ক্ষমতায় আসার পর যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, জাপান ও অন্যান্য বহুমুখী দাতা প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের উন্নয়ন সহযোগিতা প্রত্যাহার করে নেয় এবং পশ্চিমা দেশগুলো মিয়ানমারের ওপর অর্থনৈতিক অবরোধও আরোপ করে। ফলে মিয়ানমার তার টিকে থাকার জন্য আরও বেশি চীনমুখী নীতি গ্রহণ করতে বাধ্য হয়।

চীনের সঙ্গে মিয়ানমারের দুই লাইনের সম্পর্ক ছিল, দ্বিরাষ্ট্রিক সম্পর্ক এবং চীনা কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে বার্মিজ কমিউনিস্ট পার্টির সম্পর্ক। চীনে ১৯৪৯ সালে কমিউনিস্ট বিপ্লবের পর চীন মিয়ানমারেও কমিউনিস্টদের ক্ষমতায় আনতে চাইলে দেশ দুটির দ্বিরাষ্ট্রিক সম্পর্কে অবনতি ঘটে। তবে ১৯৮৫ সালে চীন মিয়ানমারের কমিউনিস্টদের সহায়তা দেওয়ার নীতি ত্যাগ করে এবং ১৯৮৯ সালে এক অভ্যন্তরীণ কোন্দলে বার্মিজ কমিউনিস্ট পার্টিও খণ্ড-বিখণ্ড হয়ে যায়। এই সুযোগে মিয়ানমারের সামরিক সরকার চীন সীমান্তবর্তী কমিউনিস্ট গ্রুপগুলোর সঙ্গে একটি সমঝোতায় পৌঁছাতে সমর্থ হয়। রাস্তাঘাট নির্মাণ, বিদ্যুৎকেন্দ্র, স্কুল, হাসপাতাল তৈরি, বাণিজ্যিক সুবিধা প্রদান এবং সীমান্ত-বাণিজ্য প্রভৃতি উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে সহযোগিতার বিনিময়ে কমিউনিস্টরাও তাদের সহযোগিতার নীতি গ্রহণ করে। এরপর মিয়ানমারের সামরিক জান্তা থান শুয়ে ১৯৮৯ সালের অক্টোবরে চীন ভ্রমণ করেন এবং চীনের সঙ্গে গভীর ও অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক স্থাপন করেন।

তারপর থেকেই মূলত মিয়ানমার পরাশক্তিগুলোর কাছ থেকে অস্ত্র আমদানি না করে নিরপেক্ষ থাকার নীতি ত্যাগ করে এবং চীনের অস্ত্র দিয়ে শক্তিশালী সেনাবাহিনী গড়ে তোলে। একই সঙ্গে চীনের কাছ থেকে অর্থনৈতিক ও কৌশলগত সহায়তাও আদায় করে নেয়। অল্প কিছুদিনের মধ্যেই মিয়ানমার চীনের সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ মিত্রে পরিণত হয়। চীনের সঙ্গে সুদৃঢ় অর্থনৈতিক সম্পর্কের ফলেই মিয়ানমারের বর্তমান সেনা সরকারও পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞার মুখেও টিকে থাকতে পারছে। এমনকি মাঝখানের অং সান সু চির কথিত বেসামরিক সরকারও টিকে থাকার জন্য সম্পূর্ণতই চীনের ওপরই নির্ভরশীল ছিল। কারণ পর্দার আড়ালে সেনাবাহিনীই সব কলকাঠি নাড়ছিল।

চীন মিয়ানমারের তিনটি ক্ষেত্রে অর্থনৈতিক সহায়তা দেয়Ñ অবকাঠামো উন্নয়ন, রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন অর্থনৈতিক উদ্যোগ এবং জ্বালানি খাত। এর মধ্যে ‘আইয়েয়াওয়াদ্দা সড়ক প্রকল্প’ খুবই গুরুত্বপূর্ণ। চীনের ইউনান থেকে মিয়ানমারের ইয়াঙ্গুনের থিলওয়া বন্দর পর্যন্ত যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন এই প্রকল্পের লক্ষ্য। এর অধীনে ভামো পর্যন্ত নদী পথের ড্রেজিং, ভামোতে একটি কনটেইনার পোর্ট নির্মাণ এবং সেখান থেকে চীনের সীমান্ত বন্দর মুজে বা লিউজেল পর্যন্ত রাস্তা নির্মাণ। যার মূল উদ্দেশ্য, মিয়ানমারের ওপর দিয়ে সরাসরি বঙ্গোপসাগর এবং আন্দামান সাগরের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করা। এতে দক্ষিণ এশিয়া, মধ্যপ্রাচ্য ও ইউরোপের সঙ্গে চীনাদের বাণিজ্যের পরিবহন খরচ ও সময় অনেক বেঁচে যাবে এবং মালাক্কা প্রণালির সংঘাত এড়িয়ে চলা যাবে। তা ছাড়া বঙ্গোপসাগর হয়ে ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চলেও সহজেই প্রবেশ করা যাবে। সমুদ্রসীমা নিয়ে মিয়ানমারের সঙ্গে বাংলাদেশের বিরোধের ক্ষেত্রে চীন যেই কৌশলগত অবস্থান নিয়েছে, তার পেছনে এটি এবং রাখাইনের গভীর সমুদ্র বন্দর প্রকল্পটিও অতিশয় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে।

এদিকে, বঙ্গোপসাগর এবং ভারত মহাসাগরের নিয়ন্ত্রণ এখনো মূলত যুক্তরাষ্ট্র-ভারতের হাতেই রয়েছে। চীনও সেখানে ভাগীদার হতে চায়। ফলে এক মহাপ্রতিদ্বন্দ্বিতা শুরু হয়ে গেছে। এখন এই তিন শক্তির কার কী অবস্থান এবং কার স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়গুলো কী সেসবের ওপর আমাদের অবিলম্বে গভীরভাবে মনোযোগ দিতে হবে। আমাদের রাজনীতিক বিশ্লেষণে অতিসরলীকরণ আর গৎবাঁধা সূত্র দিয়ে সবকিছু বোঝাপড়ার চেষ্টার যে ধরাবাঁধা একটা প্রকট প্রবণতা আছে, সেখান থেকেও বের হয়ে এসে বাস্তব তথ্য-উপাত্তনির্ভর বিশ্লেষণের সঙ্গে পরাশক্তিগুলোর প্রতিযোগিতা এবং দ্বন্দ্বের মধ্যে উদ্ভূত পরিস্থিতি থেকে নিজেদের বিপদগুলো কী তা নির্মোহভাবে শনাক্ত করাটাও জরুরি।

এ ছাড়া পরাশক্তিগুলোর সম্পর্কে মোড় বদল বা নতুন উপাদান যুক্ত হলে কী ধরনের পরিস্থিতির সৃষ্টি হতে পারে তাও আগাম আন্দাজ করতে না পারলে আমাদের নিরাপত্তা ভাবনা এবং পররাষ্ট্রনীতির সঠিক অভিমুখ নির্ণয় করা অসম্ভব হয়ে পড়বে। অনেকেই প্রতিরক্ষা এবং পররাষ্ট্রনীতির ভারসাম্য আর ভরকেন্দ্রের জায়গাগুলো গুলিয়ে ফেলছেন। বাস্তব স্বার্থগত সম্পর্কের জড়াজড়ি আর শক্তির মেরুকরণের গতি প্রক্রিয়ায় নতুন যে উপাদানগুলো যুক্ত হতে পারে বা হচ্ছে তার দিকেও নজর রাখছেন না। একই সঙ্গে সম্ভাব্য মিত্র অনুসন্ধান ও নিরাপত্তা ভারসাম্যের অনুকূল পররাষ্ট্রনীতি নির্ধারণের কাজও করতে হবে এই বাস্তব পরিস্থিতির নিরিখেই। আর কূটনীতির পাশাপাশি সবচেয়ে জরুরি বিষয় হলো, জনগণকে সমগ্র পরিস্থিতি জানিয়ে এবং জনগণকে সঙ্গে নিয়ে গণপ্রতিরক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তোলার প্রস্তুতি শুরু করা। কারণ, দিন শেষে নিজের ন্যায্য হিস্যা আদায়ের লড়াইটা বাংলাদেশকে একাই লড়তে হবে।

লেখক: সাংবাদিক ও লেখক

jr.tareq@gmail.com

Please Share This Post in Your Social Media

© All rights reserved © 2023
Developed by : JM IT SOLUTION