সোমবার, ০৬ অক্টোবর ২০২৫, ০৬:০৭ অপরাহ্ন
মাওলানা আবদুল জাব্বার:
আল্লাহতায়ালার ক্ষমাপ্রাপ্তির বড় সুযোগ হলো তার বান্দাদের ক্ষমার মাধ্যমে। হাদিসের ভাষাটি খুবই স্মরণযোগ্য, ‘যে তার ভাইয়ের ত্রুটি-বিচ্যুতি ক্ষমা করবে, দয়াময় আল্লাহ কিয়ামতের দিন তার দোষত্রুটি ক্ষমা করবেন।’ হাদিসে আরও বলা হয়েছে, ‘যে তার ভাইয়ের ত্রুটি-বিচ্যুতি গোপন করবে, আল্লাহ কিয়ামতের দিন তার দোষত্রুটি গোপন করবেন।’ এত বড় সুসংবাদ শোনার পরও আমরা মানুষকে ক্ষমা করতে পারি না, তাদের দোষত্রুটি গোপন করতে পারি না।
আমাদের দুর্ভাগ্য, আমরা পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রে ক্ষমা, সহনশীলতা ও উদারতার পরিবর্তে হিংসা ও বিদ্বেষের চাষ করি। তাই আজ শান্তি যেন সোনার হরিণ। স্বামী-স্ত্রী, পিতা-পুত্র, ভাই-ভাই, পাড়া-প্রতিবেশী, সমাজ ও রাষ্ট্র কোথাও শান্তি নেই। পরস্পরে গোলমাল-ফ্যাসাদ, মান-অভিমান, ঝগড়া-ঝাঁটি, বিবাদ থাকতেই পারে। আল্লাহর রাসুল (সা.)-এরও তার স্ত্রীদের সঙ্গে মনোমালিন্য, কথা বন্ধ করে থাকার অবস্থা সৃষ্টি হয়েছিল। খলিফা হজরত ওমর (রা.) ছিলেন তেজস্বী পুরুষ, মানুষ তাকে ভয় করে চলত। খলিফা থাকাকালীন এক লোক তার স্ত্রীর বিরুদ্ধে অভিযোগ নিয়ে খলিফার দরবারে এসে দেখেন, বাড়ির ভেতর থেকে খলিফার স্ত্রী তার সঙ্গে জোরে কথা বলছেন। সে সময় খলিফার বাসভবন কোনো প্রাসাদ ছিল না। বাইরে থেকে সবই শোনা যেত। খলিফা বের হয়ে এসে দেখেন, লোকটি চলে যাচ্ছেন। ডেকে জিজ্ঞেস করলে তিনি বলেন, ‘আমার চেয়ে আপনি বেশি অসহায়।’ জবাবে খলিফা বললেন, দেখুন, সন্তানের লালন-পালনসহ তারা আমাদের কত খেদমত করে থাকেন, একটু জোরে কথা বললে সহ্য করতে হয়। এই হলো একজন মুসলিম পুরুষের তার স্ত্রীর সঙ্গে আচরণ। আবার স্ত্রী সম্পর্কেও বলা হয়েছে কর্মক্লান্ত স্বামী ঘরে ফিরে স্ত্রীকে দেখে তার হৃদয় যদি প্রশান্ত হয়, তাহলে সেই স্ত্রীই সর্বোত্তম।
এ প্রসঙ্গে আল্লাহ বলেছেন, ‘তোমাদের স্বামী-স্ত্রী ও সন্তান-সন্ততির মধ্যে কতিপয় শত্রু, তাদের ব্যাপারে সতর্ক থেকো, তাদের সঙ্গে ক্ষমা ও সহনশীলতার ব্যবহার করো ও তাদের অপরাধ মাফ করে দাও। আল্লাহ ক্ষমাশীল ও করুণাময়।’ অনেক স্ত্রী আছে স্বামীর হালাল ও স্বল্প উপার্জনে সন্তুষ্ট নয়, আবার অনেক স্বামী রয়েছে স্ত্রীর তাকওয়া ও পর্দা মেনে চলাটা পছন্দ করে না। আবার অনেক সন্তানও আছে তার পিতার তাকওয়াপূর্ণ জীবন পছন্দ নয়। আল্লাহতায়ালা দুশমন উল্লেখ করার পরও সদয় আচরণ ও দোষত্রুটি ক্ষমা করার কথা বলেছেন। ক্ষমার মধ্যেই রয়েছে প্রশান্তি।
প্রতিশোধ গ্রহণের সুযোগ রয়েছে। আল্লাহর ভাষায়, ‘অন্যায়ের প্রতিবিধান সমপরিমাণ অন্যায়, তবে কেউ যদি ক্ষমা করে দেয় ও সংশোধন করে নেয়, তাহলে তার পুরস্কার আল্লাহর জিম্মায়।’ কত বড় সুসংবাদ আল্লাহর পক্ষ থেকে। আখেরাতের ভয়াবহ দিনে আল্লাহর ক্ষমা, এটা কি কোনো সহজ ব্যাপার? পরকালে জান্নাতের প্রত্যাশী যে কেউ সহজে অপরকে ক্ষমা করতে পারে। পরকালবিমুখরাই প্রতিশোধপরায়ণ হয়ে থাকে। দুর্ভাগ্যই আমাদের! আমরা ক্ষমা করতে জানি না, মানুষের দোষত্রুটি গোপন করতে পারি না। আল্লাহপাক মানুষের দোষত্রুটি তালাশ করতে নিষেধ করেছেন। অথচ আমরা মাইক্রোস্কোপ নিয়ে মানুষের ত্রুটিবিচ্যুতি তালাশ করি। অনেক সময় নির্দোষ মানুষের ওপর মিথ্যা দোষারোপ করে থাকি। এ যে কত ভয়াবহ জুলুম কল্পনাও করা যাবে না। উদারতা, সহনশীলতা ও ক্ষমার পরিবর্তে আমরা অপরকে হিংসা করি। হিংসাবিদ্বেষ পোষণ শুধু গোনাহই নয়, অতীতের নেক আমলও ধ্বংস করে দেয়। হাদিসের ভাষায়, ‘আগুন যেমন শুকনো কাঠ জ্বালিয়ে ধ্বংস করে দেয়, তেমনি হিংসা মানুষের নেক আমল ধ্বংস করে দেয়।’ হিংসুটে মানুষের জন্য জান্নাতে কোনো স্থান নেই।
ইসলামের দৃষ্টিতে মিথ্যা বলা কবিরা গোনাহ অর্থাৎ বড় গোনাহ। হাদিসের ভাষায় ‘মিথ্যা সকল পাপের মা।’ এটা মুনাফিকের লক্ষণ। অথচ পরস্পরের বিবাদ-বিসংবাদ মিটিয়ে দেওয়ার ক্ষেত্রে মিথ্যা বলা জায়েজ। ভাইয়ে-ভাইয়ে বা স্বামী-স্ত্রী বা পাড়া-প্রতিবেশী বা কারও ক্ষেত্রে বিরোধ বাড়ানোর লক্ষ্যে উসকানিদান মারাত্মক অপরাধ। মীমাংসা করার ক্ষেত্রে নানাভাবে উৎসাহদান করা হয়েছে। দেখা গেল, দুই ভাইয়ের মধ্যে বিরোধ। এ ক্ষেত্রে মীমাংসার লক্ষ্যে একজন এসে বড় ভাইকে বলল, তোমার ছোট ভাইয়ের সঙ্গে কথা বলে দেখলাম, তোমার প্রতি তার অসম্ভব শ্রদ্ধা, তোমার সহযোগিতার কথা খুব কৃতজ্ঞতার সঙ্গে স্মরণ করল; আবার ছোট ভাইয়ের কাছে গিয়ে বলল, তোমার প্রতি তোমার বড় ভাইয়ের দরদ ভাষায় প্রকাশ করতে পারব না। এ মিথ্যা আর মিথ্যা নয়, এটি একটি সওয়াবের কাজ। হিংসা-বিদ্বেষ ও গোলমালে উসকানি নয়, বরং মিটিয়ে ফেলারই তাগিদ দেওয়া হয়েছে।
ভয়েস/আআ