শনিবার, ০৪ অক্টোবর ২০২৫, ০৩:১৮ পূর্বাহ্ন
রায়হান আহমেদ তপাদার:
বর্তমান বিশ্বের জনসংখ্যা ৮০০ কোটি এবং ২০৫০ সাল নাগাদ জনসংখ্যা হবে ৯০০ কোটি। এখনই প্রায় ৩৫ কোটি মানুষের খাদ্যের ঘাটতি রয়েছে বিশ্বে। বিশ্বের স্থলসম্পদ ব্যবহার করে এই ঘাটতি মোকাবিলা অসম্ভব প্রায়। তাই এই বিশাল জনগোষ্ঠীর খাবার জোগান দিতে সমুদ্রসম্পদ হতে পারে অন্যতম সহযোগী। বিশ্ব অর্থনীতিতে সমুদ্র অর্থনীতি বছরব্যাপী তিন থেকে পাঁচ ট্রিলিয়ন ডলারের কর্মকাণ্ড সংঘটিত করে যাচ্ছে, যা প্রায় ৬০ মিলিয়ন লোককে মৎস্য ও জলজ কার্যক্রমে নিযুক্ত করে। বিশ্বের ৪৩০ কোটি মানুষের ১৫ শতাংশ প্রোটিন জোগান দিচ্ছে সামুদ্রিক মাছ, উদ্ভিদ ও প্রাণী।
ভৌগোলিকভাবে বাংলাদেশের একটি প্রধান কৌশলগত অবস্থানে রয়েছে যেখান দিয়ে পশ্চিমারা এশিয়ায় প্রবেশ করে। যদিও এর কিছু ভূ-রাজনৈতিক ঝুঁকি রয়েছে, তবে এখনো এর জন্য শক্তিশালী সম্ভাবনা রয়েছে। বাংলাদেশ যদি ভূ-রাজনীতিকে সঠিকভাবে পরিচালনা করতে পারে, তাহলে দেশটি সম্মিলিত সুবিধার জন্য পরাশক্তিগুলোর মধ্যে একটি কৌশলগত সেতু হিসেবে আবির্ভূত হতে পারে। বাংলাদেশ একটি অনন্য ব-দ্বীপ যার একটি সুন্দর সামুদ্রিক অভিমুখ রয়েছে। এই সমুদ্র আমাদের জাতীয় অর্থনীতির একটি পাওয়ার হাউজ এবং যেখানে কমপক্ষে ২৬টি সামুদ্রিক কার্যক্রম হতে পারে। যথাযথ গুরুত্ব দিলে ব্লু-ইকোনমি বা সুনীল অর্থনীতি বাংলাদেশে অর্থনৈতিক বিপ্লব ঘটিয়ে দিতে পারে বলে বিশেষজ্ঞদের মত। বিশ্লেষকদের মতে, শুধু সামুদ্রিক মাছ ও শৈবাল রপ্তানি করেই বছরে আয় হতে পারে বিলিয়ন ডলারের সমপরিমাণ অর্থ। সুতরাং বাংলাদেশ একটি সামুদ্রিক দেশ হওয়ায় আর্থসামাজিক প্রবৃদ্ধির জন্য ব্লু-ইকোনমিকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার হিসেবে গ্রহণ করা প্রয়োজন। সেন্টমার্টিন দ্বীপের দক্ষিণ ও পশ্চিমে প্রবাল রয়েছে আর সেই সঙ্গে রয়েছে কচ্ছপ প্রজননোপযোগী পরিবেশ। এ ছাড়া বিপুল সামুদ্রিক শৈবালও এখানে রয়েছে। সুন্দরবন আবার রয়েল বেঙ্গল টাইগার ও কুমিরের লীলাভূমি। বঙ্গোপসাগরের অভ্যন্তরে, দেশের মোট মৎস্য উৎপাদনের ১৯ দশমিক ৪ শতাংশই আসে সামুদ্রিক মৎস্য থেকে। এটি পরিবহনেরও প্রধান মাধ্যম। এ ছাড়া দক্ষিণাঞ্চলের উপকূল এলাকায় বর্ধিত অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড দেশের সামগ্রিক আর্থসামাজিক বিকাশে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখছে। স্থানীয় পর্যটকদের মধ্যে গড়ে ৮১ শতাংশই কক্সবাজার ভ্রমণ করেন। এ উপাদানগুলো একসঙ্গে নীল অর্থনীতি গঠন করে, যা বোঝায় যে, দেশটির অবস্থাকে শক্তিশালী করার বিশাল সম্ভাবনা রয়েছে। বাংলাদেশের প্রায় ১.৮৫ মিলিয়ন মানুষ মৎস্য-সংক্রান্ত কর্মকাণ্ডের সঙ্গে সম্পূর্ণভাবে জড়িত।
সামুদ্রিক মাছের সঙ্গে বিশ্বের ৩৫০ মিলিয়ন মানুষের কর্মসংযোগ রয়েছে, যার ৯০ শতাংশ মৎস্যজীবী উন্নয়নশীল দেশে বসবাস করে। বঙ্গোপসাগরে প্রতি বছর প্রায় ৮০ মিলিয়ন টন মাছ ধরা হয়, যার মধ্যে মাত্র সাত মিলিয়ন টন বাংলাদেশি জেলেদের হাতে ধরা পড়ে। বাকি পরিমাণ প্রতিবেশী দেশের জেলেদের হাতে ধরা পড়ে। এ কারণে বিশ্বের শীর্ষ ২০টি সামুদ্রিক মাছ উৎপাদনকারী দেশের তালিকায় নেই বাংলাদেশ। তাই দেশের মাছ ও অন্যান্য সামুদ্রিক সম্পদ আহরণের জন্য দ্রুত ও পরিবেশবান্ধব মাছ ধরার ট্রলার এখন সময়ের দাবি। মেরিন বায়োটেকেরও খাদ্য, মানব স্বাস্থ্য, শক্তি, নিরাপত্তা ও প্রাকৃতিক প্রতিকারের মতো বৈশ্বিক সমস্যার মোকাবিলা করার সুযোগ রয়েছে। শিপিং ও পোর্ট সুবিধার ব্যবহার ব্লু-ইকোনমির মেরুদণ্ড হিসেবে বিবেচিত, যা পরিমাণের ভিত্তিতে বিশ্ব বাণিজ্যের ৮০ শতাংশ ও মূল্যের দিক থেকে ৭০ শতাংশেরও বেশি। ২০৩০ সাল নাগাদ বাংলাদেশের সম্ভাব্য মালামাল পরিবহনের ভাড়া হবে প্রায় ৪৩৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। এর বন্দরগুলোর হ্যান্ডেলিং ক্ষমতা বৃদ্ধি করে ও আধুনিক হ্যান্ডেলিং সরঞ্জামে সজ্জিত করে গভীর সমুদ্রবন্দর বিকাশের মাধ্যমে, বাংলাদেশ বন্দরশুল্ক হিসেবে অর্থ উপার্জনকে উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি করতে পারে। বাংলাদেশ এ পর্যন্ত ২৬টি গ্যাসক্ষেত্র আবিষ্কার করেছে, যেখানে সম্ভাব্য গ্যাসের পরিমাণ ২৭.১২ ট্রিলিয়ন ঘনফুট। কিন্তু ভূতাত্ত্বিকরা জানিয়েছেন, এই ব-দ্বীপ বাংলাদেশের জন্য একটি অত্যন্ত সমৃদ্ধ গ্যাস প্রদেশ গঠন করতে পারে। এ ছাড়া এ দেশটি সমুদ্রের তলদেশে ও নিচে খনিজ ভাণ্ডার অনুসন্ধান এবং উত্তোলনের জন্য প্রস্তুত হচ্ছে। বঙ্গোপসাগরের উপকূলীয় সমুদ্রতল প্রায় ৩৫৪ নটিক্যাল মাইল। এটি বিশ্বের দীর্ঘতম অবিচ্ছিন্ন সমুদ্র সৈকত, যেখান থেকে সূর্যোদয় ও সূর্যাস্ত উভয়ই দেখা যায়। এই এলাকায় অনেক সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য আছে, যা পর্যটকদের আকর্ষণ করে। গভীর সমুদ্রে ত্রুজ শিপের মাধ্যমে পর্যটনের ব্যবস্থা করা এবং দর্শনীয় সামুদ্রিক অ্যাকুরিয়াম গড়ে তুলে এসব এলাকায় পর্যটকদের আরও আকৃষ্ট করা যেতে পারে।
এ ছাড়া বিনোদনমূলক বৈশিষ্ট্য বৃদ্ধি ও উপকূলীয় অঞ্চলে বিদেশি পর্যটকদের জন্য পৃথক পর্যটন অঞ্চল স্থাপন বাংলাদেশের সমুদ্র সৈকতের সৌন্দর্য অন্বেষণে অবকাশ যাপনকারীদের অনুপ্রাণিত করতে পারে। এটি স্থানীয় অর্থনীতিতে সহায়তা করবে। একটি উন্নত অর্থনীতিতে পরিণত হওয়ার স্বপ্ন বাস্তবায়নে নীল অর্থনীতি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। এজন্য দেশকে বিভিন্ন ধরনের চ্যালেঞ্জ উত্তরণ, যেমন দেশের সার্বভৌমত্ব নিশ্চিত করা, উপকূলীয় অঞ্চলের নিরাপত্তা বজায় রাখা, ব্রুড-স্টক প্রজননের জন্য সামুদ্রিক জৈবপ্রযুক্তিতে সক্ষমতা বৃদ্ধি এবং অভিনব স্বাস্থ্যকর জলজপণ্য উৎপাদন করা, পর্যটনবান্ধব অবকাঠামো প্রতিষ্ঠা এবং গ্যাস ও তেল অনুসন্ধান পরিচালনার মতো কাঠামো গড়ে তুলতে হবে। এর জন্য বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশ গড়ে তোলা, জীববৈচিত্র্যের টেকসই ব্যবহার নিশ্চিত করা, ম্যানগ্রোভ ও সামুদ্রিক ঘাস সংরক্ষণ, প্রবাল ব্লিচিং থেকে সামুদ্রিক ও উপকূলীয় ইকোসিস্টেম রক্ষা, কার্বন নিঃসরণ ব্যবস্থাপনা, সমুদ্র এলাকাকে দূষণমুক্ত রাখা এবং বহুমুখী কারিগরি যোগ্যতাসম্পন্ন ডিগ্রিধারী লোক তৈরির পদক্ষেপ নেওয়া যেতে পারে।
স্বার্থান্বেষী দেশগুলোর দ্বারা তৈরি আন্তর্জাতিক আইন দেশগুলোর নীল অর্থনীতির পূর্ণ সম্ভাবনা অর্জনে অন্তরায় সৃষ্টি করে। ১০ বছর আগে বাংলাদেশের সমুদ্রসীমানা বিরোধ নিষ্পত্তি হলেও এখন পর্যন্ত এ বিজয়কে কাজে লাগানো যায়নি। মেরিটাইম ল’ এখন পর্যন্ত তৈরি হয়নি। দ্রুত এটি করা প্রয়োজন, তা না হলে সমুদ্রের গভীরে কেউ সীমানা মানবে না। ফলে সম্পদ চলে যেতে পারে অন্য দেশে। যুক্তরাষ্ট্র শুধু সমুদ্রের তলদেশের সৌন্দর্য দেখিয়ে বছরে ১০ বিলিয়ন ডলার আয় করে। বাংলাদেশেও এ ধরনের সুযোগ রয়েছে, কিন্তু আমরা তা কাজে লাগাতে পারছি না। আমরা যদি সঠিকভাবে মৎস্যসম্পদ, গ্যাসসম্পদ, খনিজসম্পদ ও স্কুবা ট্যুরিজমকে কাজে লাগাতে পারি, তাহলে বাংলাদেশের প্রতি অর্থবছরে যে বাজেট হয়, তা নীল অর্থনীতি দিয়েই জোগান দেওয়া সম্ভব।
টেকসই অর্থনীতির একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে উঠেছে নীল অর্থনীতি। এটি এসডিজির ১৪ নম্বর লক্ষ্য, যা ‘টেকসই উন্নয়নের জন্য মহাসমুদ্র, সমুদ্র ও সামুদ্রিক সম্পদ সংরক্ষণ এবং টেকসইভাবে ব্যবহার করতে চায়।’ আগামী বছরগুলোতে বিশ্বের সামুদ্রিক সেক্টরগুলো নাটকীয়ভাবে প্রসারিত হবে বলে আশা করা হচ্ছে এবং ২০৩০ সালের মধ্যে বেশির ভাগের আকার দ্বিগুণ থেকে চার গুণ হবে ও অনেকগুলো তাদের বর্তমান আকারের ১০ গুণ পর্যন্ত হবে। বাংলাদেশকেও সমুদ্রসম্পদ সুরক্ষায় টেকসই ভারসাম্য নিশ্চিত করার মাধ্যমে নীল অর্থনীতির বিকাশে আরও নজর দিতে হবে। এ খাতে নতুন বিনিয়োগের মাধ্যমে এ নীল অর্থনীতির ক্ষেত্র আরও বাড়ানো সম্ভব হলে ২০৪১ সালের আগেই আমাদের উন্নত দেশের তালিকায় পৌঁছানো সম্ভব বলেও অনেকে বলছেন।
লেখক : গবেষক ও কলামিস্ট/raihan567@yahoo.com