শনিবার, ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০১:২৫ পূর্বাহ্ন
বশির আলমামুন, চট্টগ্রাম
মা ইলিশ রক্ষায় সরকারের দেওয়া ২২ দিনের নিষেধাজ্ঞা শেষ হচ্ছে আজ মধ্যরাতে। রাত ১২টা থেকে ইলিশ শিকারে নদীতে নামতে পারবেন জেলেরা। এজন্য আগ থেকেই তারা জাল-নৌকা নিয়ে কর্ণফুলী নদীর তীরে জড়ো হন সাগরে যেতে। নিষেধাজ্ঞার এই সময়ে নৌকা ও জাল মেরামতের কাজ সম্পন্ন করেছেন তারা। রাতে মাছ শিকার করে জেলেরা শনিবার (২৯ অক্টোবর) সকালেই বাজারে হাজির হবেন।
প্রজজনন মৌসুমে ইলিশের নিরাপদ প্রজননের লক্ষ্যে ৭ থেকে ২৮ অক্টোবর পর্যন্ত ইলিশ আহরণে নিষেধাজ্ঞা জারি করে সরকার। এই সময়ে ইলিশ পরিবহন, ক্রয়-বিক্রয়, মজুত ও বিনিময়ও নিষিদ্ধ। ২২ দিনের নিষেধাজ্ঞার মেয়াদ শেষ হওয়ায় জেলে পরিবারগুলোতে উৎসব বিরাজ করছে।
চট্টগ্রামের কাট্টলী গ্রামের জেলে কিরণ জলদাশ ও কৃষণ জলদাশ, বলেন ‘আমরা সরকারের নিষেধাজ্ঞা সবসময় পালন করি। মূলত আমরা বড় নৌকায় গুল্টিজাল বাই। নিষেধাজ্ঞার সময় নদী থেকে জাল ও নৌকা তুলে মেরামতে ব্যস্ত সময় পার করি।’ তারা আরও বলেন, ‘এই ২২ দিন পরিবার-পরিজন নিয়ে কষ্টে গেছে। সরকার এ বছর ২০ কেজির জায়গায় ২৫ কেজি চাল বরাদ্দ দিয়েছে। কিন্তু আমরা ২৫ কেজি পাইনি। আমাদের ২২-২৩ কেজি করে চাল দেওয়া হয়েছে। শুধু কি চাল দিয়েই সংসার চলে? সঙ্গে আরও অনেক কিছু দরকার।’ শুক্রবার (২৮ অক্টোবর) সকালে নগরের ফিশারিঘাট এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, মধ্যরাতেই অনেকেই পাড়ি দিয়েছেন সাগরে। আবার সকালেও সাগরে নামার প্রস্তুতি নিচ্ছেন অনেক জেলে। গত বৃহস্পতিবার রাতেই সব প্রস্তুতি সম্পন্ন করে কেউ মধ্যরাতে, কেউ কেউ ছুটেছেন ভোররাতে। সকালেও অনেকে রান্নার উপকরণ লাকড়ি যোগাড় করছেন। আবার কেউ কেউ শিকার করা মাছ সংরক্ষণ করতে ককশিটের বক্স ও বরফ প্রস্তুত করছেন। কেউবা ট্রলারগুলোর খন্দলে বরফ আর প্রয়োজনীয় বাজার-সদাই করে প্রস্তুতি নিচ্ছেন সাগরযাত্রার। তেল, ড্রাম, রশি ও সব ধরনের সামগ্রী বোঝাই করার পর পরখ করে নেওয়া হচ্ছে ফিশিং ট্রলার।
দীর্ঘদিন সাগরে মাছ না ধরায় জালে বিপুল মাছ ধরা পড়ার আশা করছেন জেলেরা। তারা বলছেন, ২২ দিন ধরে সাগরে নামায় নিষেধাজ্ঞা ছিল। এসময়ে ইলিশসহ অন্যান্য মাছ অবাধে বিচরণ ও বংশবিস্তার করেছে। ফলে এবার প্রচুর বড় আকারের ইলিশ পাওয়ার আশা করছি।
মহেশখালী থেকে আসা জেলে আলিম উদ্দিন বলেন, মাঝারি কিংবা বড় সাইজের ট্রলার নিয়ে সাগরে নামতে খরচ হয়ে থাকে দেড় থেকে দুই লাখ টাকা। এবার ২২ দিন বেকার থাকায় পুঁজি শেষ করে ধার-দেনায় জর্জরিত আমরা। বাড়ি থেকে এসেছি তিনদিন আগে। এসে জাল, নৌকা ঠিক করছি। সব ঠিকঠাক করে আজকেই রওনা দিব মাছ ধরতে।
কর্ণফুলী এলাকার জেলে মোহাম্মদ হাসান বলেন, ২২ দিন নিষেধাজ্ঞা থাকায় সাগরে যেতে পারিনি। নিষেধাজ্ঞা শেষ হয়েছে। সাগরে যেতে পারবো বলে খুশি লাগছে।
ঘুর্ণিঝড় সিত্রাংয়ের প্রভাবে জেলেদের কিছু মাছ ধরার ট্রলার ক্ষতি গ্রস্থ হয়েছে। যাদের ট্রলার ভালো আছে তারাই সাগরে নামার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। তবে অধিকাংশ ট্রলার ক্ষতিগ্রস্থ হওয়ায় সাগরে নামতে পারছেন না। তারাও ট্রলার মেরামতের কাজ করছেন পুরোদমে।
জেলেরা জানান, নিষেধাজ্ঞার ফলে তারা আর্থিক অভাব-অনটনের মধ্য দিয়ে পার করেছেন। অনেক জেলেই ঋণগ্রস্থও হয়ে পড়েছেন। সাগরে মাছ শিকারে গিয়ে ঋণমুক্ত হওয়ার চেষ্টা করতে হবে।
আরেক জেলে নেতা আশরাফ বলেন, ‘ট্রলারে এসে মন ভালো হয়েছে গেছে। ঋণ শোধের জন্য সাগরে যাবো। মাছ ধরবো আর অবতরণ কেন্দ্রে এসে বিক্রি করে ঋণ শোধ করবো’।
উত্তর চট্টলা উপকূলীয় জলদাস সমবায় কল্যাণ সমিতির সাধারণ সম্পাদক লিটন জলদাস বলেন, ‘উত্তর চট্টগ্রামে ৫ হাজার ৬০০ নিবন্ধিত জেলে রয়েছে। অনেক জেলে চাল পাননি। জেলেরা অভাবে পড়ে চড়া সুদে ঋণ নিচ্ছে। ’
জেলা মৎস্য কর্মকর্তা ফারহানা লাভলী বলেন, ‘চট্টগ্রামে নিবন্ধিত জেলের সংখ্যা ২৬ হাজার ৯৯২ জন। আমরা স্থানীয় ওয়ার্ড, ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানের দেওয়া তালিকা অনুযায়ী চাল দিয়েছি। তিনি আরও বলেন, জেলেরা ২২ দিনের সরকারি নির্দেশনা পালন করেছে। নিষেধাজ্ঞার সময় কোনো ট্রলার সাগরে যেতে দেওয়া হয়নি। তাই নিষেধাজ্ঞার পরপরই জেলেরা গভীর সাগরে মাছ শিকার করতে যাচ্ছেন।
ইলিশ উৎপাদনে বাংলাদেশ বিশ্বে প্রথম। বাংলাদেশের এ জাতীয় মাছ ভৌগোলিক নির্দেশক (জিআই) পণ্য হিসেবেও স্বীকৃতি পেয়েছে। ওয়ার্ল্ড ফিশের পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী, বিশ্বের মোট ইলিশের ৮৫ শতাংশই উৎপাদন হয় এ দেশে। আর মৎস্য অধিদপ্তর বলছে, ২০২০-২১ অর্থবছরে দেশের বিভিন্ন নদী ও সাগর থেকে ৫ লাখ ৬৫ হাজার টন ইলিশ আহরণ করা হয়েছে। এর আগের অর্থবছরে আহরণ করা হয়েছিল ৫ লাখ ৫০ হাজার টন। উৎপাদনের হিসাবে চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার জেলা রয়েছে যথাক্রমে চতুর্থ ও পঞ্চম অবস্থানে।
ভয়েস/জেইউ।