শনিবার, ০৪ অক্টোবর ২০২৫, ১২:৫৭ পূর্বাহ্ন
নাজমুল আহসান:
মহামারী, যুদ্ধ, দুর্ভিক্ষ সভ্যতার ইতিহাসের বাঁকে বাঁকে ঘটেছে। আবারও আমরা এই চক্রের বৃত্ত পূরণের ধারায় আছি। মহামারী যেতে না যেতেই শুরু যুদ্ধ এবং দুর্ভিক্ষের অশনি সংকেত বেজে চলছে। বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় ১৯৪৩-৪৪ সালের দুর্ভিক্ষপীড়িত বাংলার পটভূমি নিয়ে ‘অশনি সংকেত’ উপন্যাস লিখেছিলেন এবং পরবর্তী সময়ে প্রখ্যাত চলচিত্রকার সত্যজিৎ রায় একে সেলুলয়েডের পর্দায় তুলে এনেছিলেন। সাম্প্রতিক সময়ে সারা পৃথিবীতে খাদ্যসংকট নিয়ে বিস্তার আলোচনা হচ্ছে। বলা হচ্ছে, বিশ্বে ভয়াবহ রকমের খাদ্য সংকট ধেয়ে আসছে আর এর বড় ভুক্তভোগী হবে পৃথিবীর খেটে খাওয়া দরিদ্র মানুষ।
খাদ্য সংকটের একটি বড় কারণ প্রাকৃতিক বিপর্যয়। তবে দুর্ভিক্ষের বড় কারণ রাজনৈতিক ও ব্যবস্থাপনা সংকট। দার্শনিক ও অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন বলেছেন, দুর্ভিক্ষ যতটা না খাদ্যদ্রব্যের সংকটের কারণে তার থেকে অনেক বেশি দায়ী মানুষের অধিকারের স্বীকৃতি না থাকা এবং খাদ্য ব্যবস্থাপনা ও পরিকল্পনায় ত্রুটি। অন্যদিকে বিশ্বে এরকম দৃষ্টান্ত ভূরি ভূরি যেখানে প্রয়োজন থাকা সত্ত্বেও শুধুমাত্র রাজনৈতিক কারণে খাদ্য সরবরাহ করা হয়নি বা সরবরাহ মাঝপথে আটকে দিয়ে একটি দেশকে এবং তার জনগণকে শাস্তি দেওয়া হয়েছে। তবে মানব সভ্যতা ও সংস্কৃতি বিকাশের বড় নিয়ামক হচ্ছে এই সব প্রতিকূলতা অতিক্রমের সক্ষমতা।
যুদ্ধে খাদ্যসংকটের কারণ বহুবিদ, একটি হচ্ছে উৎপাদন করতে না পারা, মজুদ ও সরবরাহ ব্যবস্থা ভেঙে পড়া। এর সঙ্গে যদি প্রাকৃতিক দুর্যোগ দেখা দেয় তাহলে পরিস্থিতি চূড়ান্ত বিপর্যয়ের দিকে যায়। ইউক্রেন-রাশিয়া বিশ্বের খাদ্যভা-ার। এই অঞ্চলের খাদ্য উৎপাদন ও সরবরাহ ব্যবস্থা ভেঙে পড়া মানে হচ্ছে সারা বিশ্বের ওপর তার নেতিবাচক প্রভাব পড়া। এই দুটি দেশ মিলে পৃথিবীর ২৮ শতাংশ গম উৎপাদন করে এবং এর মধ্যে ১৫ শতাংশ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে রপ্তানি করে। তবে শুধুমাত্র উৎপাদন ও সরবরাহ ব্যবস্থার নিশ্চয়তা বিধানই যথেষ্ট নয়। জনগণের বিশেষ করে দরিদ্র মানুষের ক্রয়ক্ষমতা থাকাটাও খুব গুরুত্বপূর্ণ।
এবারের যুদ্ধের মূল সংকট হচ্ছে সরবরাহ ব্যবস্থা ভেঙে পড়া ও মুদ্রাস্ফীতির কারণে দরিদ্র মানুষের ক্রয়ক্ষমতা ব্যাপক মাত্রায় হ্রাস পাওয়া। বলা হয় বর্তমান পৃথিবীতে যত খাদ্য উৎপাদন করা হয় তা দিয়ে প্রায় দশ বিলিয়ন জনগোষ্ঠীর খাদ্য চাহিদা মেটানো সম্ভব, যা মোট বর্তমান জনগোষ্ঠীর প্রায় দেড়গুণ। বলা বাহুল্য উৎপাদিত খাদ্যদ্রব্যের প্রায় ত্রিশ থেকে চল্লিশ শতাংশ নষ্ট হয়। মূলত যথেষ্ট খাদ্য উৎপাদনের পরও খাদ্য সংকটের জন্য দায়ী মুনাফাভিত্তিক বণ্টনব্যবস্থা, কিছু মানুষের অতিরিক্ত ভোগ, পাশাপাশি বিপুল খাদ্যদ্রব্যের অপচয়। আর এ কারণেই সারা পৃথিবীতে কোটি কোটি মানুষ অভুক্ত থাকে, পুষ্ঠিহীনতায় ভোগে। সম্প্রতি জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি বিষয়ক সংস্থা (এফএও) এবং বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি অক্টোবর ২০২২ থেকে জানুয়ারি ২০২৩ এই সময়কালে বিশ্বের ১৯টি দেশকে হাঙ্গার হটস্পট হিসেবে চিহ্নিত করেছে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিশ্বের ৫৩টি দেশ বা অঞ্চলে প্রায় ১৯৩ মিলিয়ন মানুষ মারাত্মক খাদ্য নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে এবং ২০২৩ সালে পরিস্থিতি আরও খারাপ হতে পারে।
বাংলাদেশের ক্ষেত্রে এই সংকট বহুমুখী। আমাদের দেশের জনসংখ্যা বেশি, এখানে রয়েছে বিপুলসংখ্যক শরণার্থী, প্রয়োজনের তুলনায় কৃষিজমি অল্প এবং রয়েছে কিছু অত্যাবশ্যকীয় খাদ্যপণ্যের জন্য বিশ্ববাজারের ওপর নির্ভরশীলতা। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে অভ্যন্তরীণ প্রাকৃতিক দুর্যোগ, রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা, সরবরাহ সংকট ও খাদ্য অধিকারকে ন্যায্যতার দৃষ্টিভঙ্গিতে না দেখা। এক শ্রেণির মানুষের অতিরিক্ত লোভ ও ভোগের কারণে বণ্টনে ন্যায্যতার অভাবে বিশে^ লাখ লাখ মানুষ অনাহারে থাকে। খাদ্যদ্রব্য ক্রয়ে দরিদ্র জনগোষ্ঠীর ওপর চাপ কমানোটাও খাদ্য ন্যায্যতার গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ। বিশ্বে খাদ্য ঘাটতি মোকাবিলায় বিভিন্ন ধরনের আন্তর্জাতিক ও জাতীয় উদ্যোগ আছে। কোনো অঞ্চলে দুর্ভিক্ষ বা মারাত্মক খাদ্য সংকট তৈরি হলে সেসব ক্ষেত্রে জরুরি খাদ্য সরবরাহ নিশ্চিত করার জন্য বিভিন্ন ধরনের উদ্যোগ লক্ষ করা যায় কিন্তু বিশ্বব্যাপী খাদ্যবণ্টন প্রক্রিয়ায় ন্যায্যতা প্রতিষ্ঠার জন্য প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নেই। আর এর মূল কারণ খাদ্য সম্পর্কিত ব্যবসাকে টিকিয়ে রাখা এবং ক্ষেত্রবিশেষে খাদ্যকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করা।
মূলত শাসক শ্রেণির অবহেলা, অবজ্ঞা ও লুটপাটই দুর্ভিক্ষের জন্য দায়ী। যেমনটা হয়েছিল ছিয়াত্তরের মন্বন্তর (বাংলা ১১৭৬ সালে), এটি বাংলার ইতিহাসে সবচেয়ে ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ নামে পরিচিতি। এই দুর্ভিক্ষে বাংলার প্রায় তিনভাগের একভাগ মানুষ মারা যায়। এর পেছনে দায়ী ছিল প্রাকৃতিক বিপর্যয় এবং একই সঙ্গে কোম্পানির দুঃশাসন। স্বাধীন নবাবদের পতনের পর, বাংলায় তখন দ্বৈত শাসন। নবাবের ওপর শাসনভার কিন্তু রাজস্ব আদায়ের দায়িত্ব ব্রিটিশদের হাতে। আর এই দুই পেরেশানির মধ্যে জনগণ চিড়েচ্যাপ্টা। অন্যদিকে পঞ্চাশের মন্বন্তরে (১৯৪৩-৪৪) বাংলায় আবার ২০ লাখ মানুষ মৃত্যুবরণ করে। একদিকে জাপান অধিকৃত মিয়ানমার থেকে চাল আমদানি বন্ধ, অন্যদিকে ব্রিটিশ সৈন্যদের জন্য বিপুল পরিমাণ খাদ্যশস্য মজুদকরণ বাজারের খাদ্যশস্যের দাম বাড়িয়ে দেয়। পাশাপাশি ব্রিটিশ রাজের ভুল নীতির কারণে সরবরাহ ব্যবস্থা ভেঙে পড়ে। অনেকে এই দুর্ভিক্ষের জন্য তৎকালীন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী চার্চিলের ভুল নীতিকে দায়ী করে থাকেন। অন্যদিকে চার্চিল উল্টো ‘নেটিভদের’ ওপর দায় চাপানোর চেষ্টা করেছিলেন। তবে, এই দুর্ভিক্ষ কোনো প্রাকৃতিক কারণে ছিল না, মানুষের জীবনকে নিয়ে অবহেলা ও অমানবিক আচরণই ছিল এর কারণ।
আমাদের জনগণের খাদ্য নিরাপত্তা মূলত উৎপাদন, আমদানি, সরবরাহ, ব্যবস্থাপনা ও নজরদারির ওপর নির্ভর করে। বর্তমান সংকট মোকাবিলায় প্রয়োজন সীমিত সম্পদের সর্বোচ্চ ব্যবহার। পাশাপাশি শক্ত নজরদারি যাতে কোনোভাবেই খাদ্য উৎপাদন প্রক্রিয়া ব্যাহত না হয়। কিন্তু এখানেই শেষ না, সরবরাহ প্রক্রিয়ায় মজুদদারির যেন কোনো সুযোগ না থাকে এবং যে যে খাদ্যপণ্যের চাহিদা মেটানোর জন্য আন্তর্জাতিক বাজারের ওপর নির্ভরশীল সেসব ক্ষেত্রে পর্যাপ্ত আমদানির উদ্যোগ আগেভাগেই গ্রহণ করতে হবে।
বেশ কিছুদিন ধরে বাংলাদেশে খাদ্য অধিকার আইন প্রণয়নের দাবি উঠলেও এ ব্যাপারে কোনো কার্যকর উদ্যোগ দেখা যাচ্ছে না। খাদ্য সংকটে ধনী ও দরিদ্র দেশগুলোর ওপর যেমন একই প্রভাব ফেলে না, তেমনি এর প্রভাবও দরিদ্র দেশগুলোর ধনী ও দরিদ্র জনগোষ্ঠীর মধ্যে একরকম নয়। ধনী দেশগুলো তার নাগরিকদের নানা ধরনের প্রণোদনা প্রদানের মাধ্যমে এই সমস্যা উত্তরণের চেষ্টা করে, তাদের সেই সক্ষমতা আছে। পাশাপাশি প্রভাব খাটিয়ে তারা সরবরাহ সংক্রান্ত সমস্যা দ্রুত সমাধান করতে পারে। কিন্তু দরিদ্র দেশগুলোকে অনেক সময়ে অন্যের ইচ্ছা-অনিচ্ছা বা কৌশলগত স্বার্থের কাছে বন্দি থাকতে হয় যেমনটা থাকতে হয় এর প্রান্তিক ও দরিদ্র জনগোষ্ঠীকে।
লেখক : উন্নয়নকর্মী ও কলামিস্ট
psmiraz@yahoo.com