শুক্রবার, ০৩ অক্টোবর ২০২৫, ১০:৫০ অপরাহ্ন
মোস্তফা কামাল:
সপ্তাহখানেক আগ পর্যন্ত সরকারের তরফে আশ্বাস ছিল নির্বাচন পর্যন্ত বেগম খালেদা জিয়াকে আর জেলে নেওয়া হবে না। আইনমন্ত্রী অ্যাডভোকেট আনিসুল হক দিয়েছিলেন বার্তাটি। এর দু-তিন দিনের মাথায় প্রধান নির্বাচন কমিশনার জানিয়েছেন, বেগম খালেদা জিয়া আগামী নির্বাচনে প্রার্থী হতে পারবেন কি না, তা বলার সময় এখনো আসেনি। এর এক দিনের মাথায় বৃহস্পতিবারই প্রধানমন্ত্রীর হুঁশিয়ারি, বিএনপি বেশি বাড়াবাড়ি করলে তাদের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে আবার জেলে পাঠিয়ে দেওয়া হবে।
পুরনো বা প্রায় ফয়সালা হয়ে যাওয়া বিষয় এভাবে নতুন করে সামনে আসার মধ্যে নানান উপাদান স্পষ্ট। যোগ হয়েছে কূলকিনারাহীন কিছু প্রশ্নও। খালেদা জিয়াকী কী কারণে প্রধানমন্ত্রীনির্বাচনী মৌসুমে নানান ওয়াদার সঙ্গে ‘আল্লাহ ভরসার’ রাজনীতি বরাবরই জমে ওঠে বাংলাদেশে। এ নিয়ে টুকটাক সমালোচনা হলেও তা হালে পানি পায় না। বড় দুই দলের নেতাদের মসজিদে নামাজে শরিক হওয়া, বেশি বেশি জানাজায় ছুটে যাওয়া, পীর-পয়গম্বরের মাজার জিয়ারত, দোয়া-মাহফিলে ঢুকে পড়াসহ নিজেকে ধার্মিক প্রমাণের একটা প্রতিযোগিতা চলে।
জামায়াতের ‘যা করে আল্লায় ভোট দেব পাল্লায়, আওয়ামী লীগের ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ, নৌকার মালিক তুই আল্লাহ’ ধরনের সেমোস্তফা কামালগানের সুরকে মানুষ ভোটরঙ্গের তোড়ে সাম্প্রদায়িকতার মানদণ্ডে নিয়ে বিবেচনা করতে পারে না। যেভাবে বিএনপির সংবিধানে ‘বিসমিল্লাহ’ কায়েম বা জাতীয় পার্টির দেশকে ‘মুসলিম’ রাষ্ট্র ঘোষণার কৃতিত্বকেও বাধা দেওয়ার সাহস পায় না। এবার নির্বাচনের ঢের আগেই ‘ধর্মচর্চার’ জানান দেওয়া জমে গেছে। তা বেশি হচ্ছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ এবং ক্ষমতাহীন প্রধান দলক্ষণীয় বিষয়, খালেদা জিয়ার মতো একজন বয়স্ককে নাজেহাল করায় প্রধানমন্ত্রীর জাহান্নামি হওয়া মর্মে বিএনপির ওয়াজের বাজার বেশ গরম। ‘আল্লাহর রহমতে’ আগামীতে তাদের ক্ষমতার দখল পাওয়ার ‘জিন্দাবাদ আওয়াজ’ প্রতিটি সমাবেশে উচ্চারিত। এর কাউন্টার হিসেবে নিয়মিত নামাজ-রোজা, তাহাজ্জুদসহ নফল ইবাদতে এগিয়ে থাকার জানান দিচ্ছেন আওয়ামী লীগ নেতারা। ইসলামের খেদমতে বেশি অবদানের কৃতিত্ব প্রমাণসহ দাবিও করছেন তারা। সেই সঙ্গে বিএনপির চেয়েও বেশি করে ‘বিসমিল্লাহ’ জপছেন।
বড় দুই দলের ‘ইসলাম’ বা ‘ধর্মচর্চার’ তোড়ে আচানকভাবে মার খাচ্ছে এ কর্মে একসময়ের সোল এজেন্সি নেওয়া জামায়াতে ইসলাম। এমনিতেই তারা মাঠছাড়া। রাজনীতিতে নিষিদ্ধ না হলেও নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধন নেই। ডানে-বামে তাল মিলিয়ে কোনো মতে সময় পার করলেও ধর্মের দোহাই দিয়ে আর এগোতে পারছে না। বরং ধর্মের আওয়াজে কিছুটা পিছটান লক্ষণীয়। নতুন নামে ইসিতে নিবন্ধনের ধরনা দিতে গিয়ে তারা ইসলাম-জামায়াত দুই শব্দই লুকিয়ে ইংরেজি নামে ঝুঁকেছে। এক গ্রুপ বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট পার্টি (বিডিপি) নামে আবেদন করেছে ইসিতে।
এর আগে, ২০২০ সালের ২ মে জামায়াতে ইসলামী ও ছাত্রশিবিরের একটি গ্রুপ নিজেদের সংস্কারপন্থি ও স্বাধীনতার পক্ষের শক্তি দাবি করে ইংরেজি নাম ‘এবি’ পার্টির (আমার বাংলাদেশ পার্টি) ব্যানারে। তারাও নিবন্ধনের জন্য ইসিতে আবেদন করে রেখেছে। ‘এবি’ পার্টিকে সরকারি মহল থেকে মাঠে নামানোর গুঞ্জন ছিল মাঠে। ‘বিডিপি’ নিয়েও রয়েছে নানান কথা। বিডিপির সঙ্গে সম্পৃক্ততা স্বীকার করছে না জামায়াত। আবার বিডিপি নেতারাও জামায়াতের নাম মুখে নেয় না। যদিও ঘোষিত দলটির প্রায় সব শীর্ষ নেতাই শিবির-জামায়াত সম্পৃক্ত।
আন্দোলনের মাঠে দীর্ঘ বিচরণের জেরে জামায়াতও বড় দুই দলের পথঘাট চেনে। রাজনীতির প্রতিটি বক্রপথের সুযোগ নেওয়া জামায়াতের নাম পাল্টানো, নিষিদ্ধ হওয়া, পরে আবার সিদ্ধ হওয়ার দীর্ঘ অভিজ্ঞতা। এবারের প্রেক্ষিত ও প্রেক্ষাপটে আরও ভিন্নতা। ধর্মীয় নামের ধারে-কাছেও থাকছে না। পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশ পর্বে রাজনীতির নানা বাঁকে বেশ কয়েকবার বল-বোল দুটোই পাল্টিয়েছে দলটি। দলের নামও বদল হয়েছে বার-কয়েক। নিষিদ্ধ হয়েছে আগে আরও অন্তত দুবার। এবার ক্ষমতাসীন দল তথা সরকারের বিশেষ কয়েক পর্যায়ে যোগাযোগ করে জামায়াত বা ইসলাম ধরনের কোনো শব্দ ব্যবহার না করে তাদের এ এগিয়ে যাওয়ার মধ্যে অনেক বার্তা। আবার বিএনপির সঙ্গে সম্পর্কচ্ছেদের দাবি করলেও ভেতরে-ভেতরে তাদের সম্পৃক্ততা চলমান-বহমান। এতেও কি বিএনপির জন্য আল্লাহর কোনো ‘ওয়াস্ত’ থাকার সম্ভাবনা বা মন্ত্র লুকানো আছে বা থাকতে পারে?
বিএনপির জন্য ক্ষমতার আরেকটি ‘ওয়াস্ত’ মনে করা হয় জাতীয় পার্টিকে। কিন্তু সেখানেও ধোঁয়াশা। নানা নাটকীয়তা। সংসদে আর না যাওয়ার ঘোষণা। পরদিনই আবার একসঙ্গে ঢুকে পড়া। জাপায় এ ধরনের খেলা নতুন নয়। বিএনপির মতো রাজপথে শোডাউনের অবস্থা না থাকায় রাজনীতিতে ভিন্ন ধাঁচে ভ্যালু বাড়ায় তারা। জাপার এ ভূমিকাকে হালকাচ্ছলে নিয়ে সরকারি দল থেকে বলা হয়েছে, আগামী নির্বাচনের আগ পর্যন্ত এ ধরনের আরও কত কিছুই হবে। পদ্মা-মেঘনা-যমুনার পানি কতদিকেই গড়াবে। সরকারি দলের মতো বিএনপিও ভাবে না জাপাকে নিয়ে। এলে সঙ্গী করবে, না এলে ভাববেও না।
বিএনপির জোর প্রচারণা এবার আর তাদের রোখা যাবে না। নিজ গরজেই অনেকে তাদের সঙ্গী হবে। বিভাগীয় সমাবেশগুলোতে জনসমাগম এবং সরকারের তটস্থ হয়ে বাধাদান বিএনপি নেতাকর্মীদের বেশ আশাবাদী করে তুলেছে সত্য। কিন্তু, তা কি নির্বাচনে জিতে ক্ষমতার ফিটনেস বা রুট পারমিটের বার্তা দেয়?
লেখক: বাংলাভিশনের বার্তা সম্পাদক ও কলামিস্ট