শুক্রবার, ০৩ অক্টোবর ২০২৫, ১০:৫০ অপরাহ্ন

দৃষ্টি দিন:
সম্মানিত পাঠক, আপনাদের স্বাগত জানাচ্ছি। প্রতিমুহূর্তের সংবাদ জানতে ভিজিট করুন -www.coxsbazarvoice.com, আর নতুন নতুন ভিডিও পেতে সাবস্ক্রাইব করুন আমাদের ইউটিউব চ্যানেল Cox's Bazar Voice. ফেসবুক পেজে লাইক দিয়ে শেয়ার করুন এবং কমেন্ট করুন। ধন্যবাদ।

‘ক্ষমা যথেষ্ট নয়’

মাসুদ কামাল হিন্দোল:

ক্ষমা মহৎ। এই মহৎ গুণটি অর্জন করতে হয়। বিভিন্ন ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে ক্ষমা চাওয়া বা ভুল স্বীকারের নিদর্শন রয়েছে। মাঝে মাঝে কোনো কোনো ক্ষমার দৃষ্টান্ত আন্তর্জাতিক মিডিয়ায় আলোড়ন সৃষ্টি করে। সেসব ঘটনার পরম্পরা নিয়ে অনেক তোলপাড় হয়। আমরা দেখেছি অনেক ব্যক্তি, পরিবার, প্রতিষ্ঠান, কিংবা রাষ্ট্রকেও ৫০, ১০০ বা তার চেয়েও বেশি পুরনো ভুল বা অপরাধের জন্য প্রকাশ্যে ক্ষমা চাইতে। কখনোবা ক্ষমা চাওয়ার দাবিতে আন্দোলন-বিক্ষোভ-মানববন্ধন করতে। আন্তর্জাতিক মিডিয়ায় নানা ধরনের ক্ষমা চাওয়ার সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে। খুনের দায়ে অভিযুক্ত ফাঁসির আসামি যেমন ক্ষমা চেয়েছে নিহত ও আহতদের পরিবারের কাছে, সাবেক স্বৈরশাসক ক্ষমা চেয়েছে, রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রী ক্ষমা চেয়েছেন। আমাদের দেশেও ব্যক্তি, পরিবার, প্রতিষ্ঠান ও রাজনৈতিক দলের অতীতের ভুলের জন্য ক্ষমা চাওয়ার উদাহরণ রয়েছে। ফেইসবুকের প্রতিষ্ঠাতা মার্ক জাকারবার্গ অসংখ্যবার ক্ষমা চেয়েছেন বিভিন্ন কারণে। ৫০ বছর পর অভিনেত্রী সাচিল লিটরফেদারের কাছে ক্ষমা চেয়েছে অস্কার কমিটি। দেশ-বিদেশে এমন উদাহরণ আরও আছে।

কানাডায় ঊনবিংশ ও বিংশ শতাব্দীতে গির্জায় শিশুদের নির্যাতন ও হত্যার ঘটনায় আদিবাসীদের কাছে ক্ষমা চেয়েছেন ক্যাথলিক গির্জার যাজকরা। সরকার ও ধর্মবিষয়ক কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে পরিচালিত এসব স্কুলে জোর করে আদিবাসী শিশুদের এনে রাখা হতো। পরে সেখানে শিশুদের শারীরিক, মানসিক নির্যাতনের পাশাপাশি যৌন হয়রানিও করা হতো। এভাবে নির্যাতনের মাধ্যমে কয়েকশ শিশুকে হত্যা করা হয়েছে। আলজাজিরার এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানানো হয়েছে। ১৮৬৩ থেকে ১৯৯৮ সাল পর্যন্ত এসব স্কুলে দেড় লাখের বেশি আদিবাসী শিশুকে পরিবারের কাছ থেকে জোর করে তুলে আনা হয়। এসব শিশুকে নিজেদের ভাষায় কথা বলতে এবং নিজেদের সংস্কৃতিচর্চা করতে দেওয়া হতো না। তাদের নানাভাবে নির্যাতন করা হতো। ২০০৮ সালে কানাডা সরকার এজন্য আনুষ্ঠানিকভাবে ক্ষমা চায়। এসব স্কুলে এখন পর্যন্ত ৪ হাজার ১০০ জনের মৃত্যু হয়েছে। এ ঘটনায় কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো শোক প্রকাশ করে এক টুইটে বলেন, ‘কামলুপস আবাসিক স্কুলে শিশুদের দেহাবশেষ পাওয়ার খবরে আমার হৃদয় ভেঙে গেছে।’

ফ্রান্সে ১৯৫০ সাল থেকে গত প্রায় ৭০ বছরে দুই লাখের বেশি শিশু চার্চের যাজকদের যৌন নির্যাতনের শিকার হয়েছে এবং নির্যাতনের শিকার হওয়া শিশুদের মধ্যে বেশির ভাগই ছিল ছেলেশিশু। দেশটির চার্চ-সংক্রান্ত এক স্বাধীন তদন্ত কমিশনের প্রতিবেদনে উঠে এসেছে এমন তথ্য। তদন্ত কমিশনের বরাত দিয়ে ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম বিবিসি এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে, ক্যাথলিক চার্চে দীর্ঘদিন ধরে এ ধরনের অপরাধ চলছে এবং কর্তৃপক্ষ বিষয়টিকে গুরুত্ব সহকারে দেখেনি। এদিকে প্রতিবেদনটি প্রকাশের পর রিমসের আর্চবিশপ ও ফ্রান্সের যাজক পরিষদের প্রধান এরিক দে মুলা-বুফো জানিয়েছেন, তিনি লজ্জিত। তিনি মানুষের কাছে ক্ষমা চেয়েছেন এবং ব্যবস্থা নেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন।

গর্ভধারণের প্রাথমিক পর্যায়ের শারীরিক জটিলতা কাটানোর ওষুধ থালিডোসাইড নিষিদ্ধ হওয়ার ৫০ বছর পর দুঃখ প্রকাশ করেছে ওষুধ প্রস্তুতকারক জার্মান কোম্পানি গ্রুনেনথান। পঞ্চাশের দশকে বাজারে আসা ওষুধটির কারণে ১০ হাজারেরও বেশি শিশু শারীরিক প্রতিবন্ধী হয়ে জন্ম নেয়। ১৯৬১ সালে ওষুধটি নিষিদ্ধ করা হয়। গ্রুনেনথানের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা হেরাল্ড স্টক ওই ওষুধের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোর কাছে ক্ষমা চেয়েছেন।

আবার দুনিয়ায় অনেক বড় মানবিক বিপর্যয় সৃষ্টিকারী ঘটনায় ক্ষমা না চাওয়ার দৃষ্টান্তও রয়েছে বিপুল। চাচার গাড়িতে করে যাচ্ছিল তিন বছর বয়সী মালিকা। কিন্তু ড্রোন হামলা এ ছোট্ট মেয়েটিকেও বাঁচতে দেয়নি। ২০২১ সালে আফগানিস্তানে যুক্তরাষ্ট্রের ড্রোন হামলায় তার সঙ্গে মারা গেছেন পরিবারের আরও ৯ জন। এদের মধ্যে সাতজনই ছিল শিশু। এ হামলার ঘটনায় ভুল স্বীকার করেছে যুক্তরাষ্ট্র। তারা গাড়িতে আইএসকের সদস্য রয়েছে ভেবে এ হামলা করেছিলে। কিন্তু এমন ঘটনায় শুধু ‘ভুল স্বীকার যথেষ্ট নয়’ বলে মন্তব্য করেছেন বেঁচে যাওয়া মালিকার বাবা আইমাল আহমাদি। ‘পরিবারের ১০ জনকে হারিয়েছি। আমি যুক্তরাষ্ট্র এবং বিভিন্ন সংস্থার কাছে বিচার চাই। আমরা নিরীহ, বড় কোনো ভুল করিনি। কে এটা করেছে তা খুঁজে বের করুন’।

ফিলিস্তিনের শিশু-কিশোরদের ইসরায়েলি বাহিনী নির্বিচারে হত্যা করছে। দিনের পর দিন বছরের পর বছর। কিন্তু এ ব্যাপারে বিশ্ব বিবেক নীরব। এই বর্বর হত্যাকা-ের জন্য তারা কখনো দুঃখ প্রকাশ করেনি বা ক্ষমা চায়নি। এত সব ঘটনার পরও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় ইসরায়েলি শাসকগোষ্ঠীকে দায়মুক্তি দিচ্ছে। ৫ বছরের আলা কাদুমের জীবনের মূল্য তাদের কাছে নেই। পশ্চিমা দুনিয়া বা মিডিয়ার কাছেও নেই। পশ্চিমা মিডিয়ার কাছে মানবিকতা আশা করাটাই ভুল। আমেরিকার সাবেক প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ বুশ বলেছেন, তার ইরাক আক্রমণ তথ্যভিত্তিক ছিল না। ভবিষ্যতে হয়তো রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভøাদিমি পুতিনও বলতে পারেন তার ইউক্রেন আক্রমণ সঠিক ছিল না। এজন্য হয়তো তিনি ভুলও স্বীকার করতে পারেন। জাপানের হিরোশিমার ক্ষত এখনো শুকায়নি। তুচ্ছ কারণে আমেরিকা আফগান বেসামরিক শিশু-কিশোর ও নাগকিদের হত্যা করেছে। পরে বলেছে ফ্রেন্ডলি ফায়ার।

যে ঘটনাগুলো তুলে ধরা হলো সেগুলোর শিকারদের কেউই দাগি আসামি বা ভয়ংকর অপরাধী ছিলেন না। তারা ছিলেন সম্ভাবনাময় অতি সাধারণ মানুষ। আর দশটা মানুষের মতো তাদের জীবনও হতে পারত সম্ভাবনার। এসব অপরাধের কারণে ব্যক্তি-পরিবার-সমাজ-রাষ্ট্র ক্ষতিগ্রস্ত হয়। প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম সে ক্ষত বয়ে বেড়ায়। ফুলের মতো শিশুদের অকারণে-অকাতরে হত্যা করেছে তারা। তাদের জীবনের বিপরীতে কি ক্ষমা চাওয়াই যথেষ্ট? এসব মারাত্মক ভুল ক্ষমার যোগ্য কি-না তা বিবেকবান মানুষের ভেবে দেখা উচিত।

তাই আইমাল আহমাদির সুরে সুর মিলিয়ে বিবেকবান মানুষের বলা উচিত‘ক্ষমা যথেষ্ট নয়।’ প্রকৃত অপরাধী বা দোষীকে খুঁজে বের করে শাস্তির আওতায় আনা জরুরি। একই সঙ্গে ক্ষতিপূরণও দেওয়া উচিত। যদিও জীবনের ক্ষতি কোনো কিছুর বিনিময়েই পূরণ করা সম্ভব না। তবুও অপরাধীকে সাজা দিয়ে দৃষ্টান্ত সৃষ্টি করা উচিত ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য। যাতে এ ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি না ঘটে। আমরা প্রায়ই প্রকাশ্যে নিঃশর্ত ক্ষমা চাওয়ার কথা শুনে থাকি বা এমন দাবি করা হয়। সবাইকে কি ক্ষমা করা যায়? সব অপরাধই কি ক্ষমার যোগ্য? সব অপরাধকে কি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখা যায়? ব্যক্তি, পরিবার, প্রতিষ্ঠান, রাষ্ট্র সবারই কি কৃতকর্মের জন্য প্রকাশ্যে ক্ষমা চাওয়া উচিত? না কি ক্ষতিপূরণ দিয়ে, নিজেদের সংশোধন করে এমন প্রতিজ্ঞা করা উচিত যাতে আর কেউই এমন অপরাধের শিকার না হয়?

লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট

hindol_khan@yahoo.com

Please Share This Post in Your Social Media

© All rights reserved © 2023
Developed by : JM IT SOLUTION