শুক্রবার, ০৩ অক্টোবর ২০২৫, ০৭:২৪ অপরাহ্ন
শাহাদাৎ হোসাইন:
রোহিঙ্গা শরণার্থীদের নিয়ে আমাদের বেশিরভাগ বিশ্লেষণ বা মতামত হয়ে থাকে সেকেন্ডারি ডেটার ভিত্তিতে। প্রথমবারের মতো প্রাইমারি ডেটার ভিত্তিতে ‘হোস্ট কমিউনিটির সঙ্গে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের মিশে যাওয়ার’ প্রক্রিয়া নিয়ে একটি অ্যাকাডেমিক গবেষণার সুযোগ হয়েছিল ২০১৮ সালে আন্ডার গ্র্যাজুয়েশনে থাকতে। এর প্রায় ৪ বছর পর ২০২২ সালে একটি স্বনামধন্য গবেষণা প্রতিষ্ঠানের হয়ে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে ফের গবেষণা করার একটি সুযোগ পাই। প্রতিষ্ঠানটির হয়ে গবেষণা করতে গিয়ে কিছু রোহিঙ্গা কিশোর ভলান্টিয়ার খুব সহযোগিতা করছিল। কাজের ফাঁকে তাদের সঙ্গে কথা হয় তাদের যাপিত জীবন নিয়ে। নিজ ভূমি ছেড়ে পরভূমিতে আশ্রিত কিশোরদের যাপিত জীবনেও স্বপ্ন থাকে, তবে সেখানে কোনো আশা থাকে না। কুতুপালং ক্যাম্পের ১৭ বছরের এক কিশোর নিজের নাম রেখেছে নেইমার। জাহাঙ্গীর আলম নামে এই কিশোর দুর্দান্ত ফুটবল খেলে। কিন্তু ভিনদেশের মাটিতে অতটা স্বাধীনতা মানুষের থাকে না যতটা সে চায়। সাম্প্রতিক সময়ে উখিয়া উচ্চ বিদ্যালয়ের মাঠে ফুটবল খেলায় ৫০ জন রোহিঙ্গাকে আটক করা হয়।
প্রিয় ও পরিচিত শহর কক্সবাজারে মোড়ে মোড়ে চায়ের টং। এমন একটি চায়ের দোকানে কাজ করে রোহিঙ্গা ক্যাম্প থেকে পালিয়ে আসা আবদুল্লাহ (ছদ্মনাম)। তার বয়স ৮ বছর। জিজ্ঞেস করতেই স্বতঃস্ফূর্তভাবে বলে উঠল, তার বাড়ি ক্যাম্পে, কিন্তু তার ক্যাম্পে ভালো লাগে না। চায়ের দোকানে সে দৈনিক ১০০ টাকা মজুরি ভিত্তিতে কাজ করে। কয়েকদিন কাজ করে কয়েকশ টাকা হলে আবার ক্যাম্পে ফিরে যাবে। জিজ্ঞেস করলাম, তার কি বার্মার (মিয়ানমার) কথা মনে পড়ে? আবদুল্লাহ উত্তর দেয়, ‘আইঁ তো বর্মা ন দেহি’ (আমি তো বার্মা দেখিনি)। আবদুল্লাহর পরিবার যখন রাখাইন সন্ত্রাসী ও বার্মিজ আর্মির গণহত্যার মুখে নাফ নদী সাঁতরে বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছিল তখন তার বয়স ছিল ৩ বছর। আবদুল্লাহর হয়তো সে বিভীষিকাময় দিনের কথা মনে নেই, মিয়ানমারের কোনো স্মৃতি হয়তো তার নেই। সে বড় হচ্ছে বাংলাদেশে। তার শৈশব-কৈশোরের সমস্ত অনুভূতি তৈরি হচ্ছে বাংলাদেশে। সে কখনো মিয়ানমার দেখেনি, মিয়ানমারকে তার দেশ বলে বিশ্বাস করানো কঠিন কাজই। দেশ একটি চিন্তা, আবেগ ও অভিজ্ঞতার সমষ্টি, যেখানে আবদুল্লাহর এসব অনুভূতি তৈরি হচ্ছে বাংলাদেশে। আবদুল্লাহর বন্ধুত্ব, সম্পর্ক সবকিছু তৈরি হচ্ছে এপারে, কোনোদিন মিয়ানমারে ফিরে গেলেও এসব সম্পর্কের টানে আবদুল্লাহ বাংলাদেশে ফিরে আসতে চাইবে। কারণ সে দেশ হিসেবে দেখেছে বাংলাদেশকে। এই সংস্কৃতি, সভ্যতায় তার বড় হওয়া। ২০১৭ সালের একটি টিভি রিপোর্টে আবদুল্লাহর মতোই এক শিশুর কাছে সাংবাদিক জানতে চেয়েছিলেন, সে কেন বাংলাদেশে এসেছে। তখন চোখের পানি ছেড়ে দিয়ে বলেছিল, ‘আঁরা পরান বাঁচাইতে আস্সিদি’ (আমরা জীবন বাঁচাতে আসছি)। সেদিন বাংলাদেশ তার সাধ্যমতো আবদুল্লাহদের জীবন বাঁচালেও আজ আবদুল্লাহদের যেমন সংকট কাটেনি তেমনি আবদুল্লাহরাই নানা সংকটের কারণ হয়ে উঠছে।
ক্যাম্পে গবেষণার ফাঁকে কথা হয় এক কিশোরের সঙ্গে। ১৭ বছরের এই কিশোরের নাম নাইম (ছদ্মনাম)। রোহিঙ্গা মূল্যবোধে একজন ছেলের জন্য ১৭ বছর বিয়ের জন্য উপযুক্ত বয়স। নাইমের কাছে বিয়ে নিয়ে জানতে চাইলে সে বলে সে অবিবাহিত। ক্যাম্পে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার নানা কর্মসূচির কারণে রোহিঙ্গাদের সাংস্কৃতিক বোঝাপড়ায় বেশ পরিবর্তন এসেছে। বাল্যবিবাহ, স্বাস্থ্য সচেতনতা, গর্ভবতী নারীর সেবা এসব নিয়ে তাদের জ্ঞান বেড়েছে। নাইমের হাতে ফোন। সে ইউটিউবে হিন্দি গানের ভিডিও দেখছিল। পরনে জিন্স ও শার্ট। জানতে চাইলাম সে এই পোশাক ও ফোন কোথায় পেয়েছে। নাইম জানায়, টেকনাফে তার এক পরিচিত ও দূর সম্পর্কের আত্মীয় থাকে। তার মাধ্যমে সে টেকনাফে কাপড়ের দোকানে চাকরি করেছিল। সে টাকা দিয়ে পোশাক ও ফোন কেনা। ক্যাম্পের মধ্যে পর্যাপ্ত রসদ পাওয়ার পরও কেন ক্যাম্পের বাইরে চাকরি করতে যায় রোহিঙ্গারা, জানতে চাইলে নাইম বলে, ‘এখন মানুষের চাহিদা বেড়েছে, ভালো-মন্দ খেতে চায়। ছেলে বা ছোট ভাইদের পড়াশোনা করাতে চায়। পড়াশোনা করালে মাসে ৫০০-১০০০ টাকা খরচ হয়। পোশাক লাগে। আগে রেশন বাইরে বিক্রি করা যেত সেখান থেকে একটি বাড়তি আয় আসত। পুলিশ এখন এটা বন্ধ করে দিয়েছে। ফলে মানুষ বাইরে যায় আয়ের জন্য। এছাড়া ক্যাম্পের মধ্যে অনেকে আয় করে তাদের দেখে বাকিরাও আয় করতে চায়। নাইম আরও জানায় সে ফোন কেনার জন্য একবার বাইরে গিয়েছিল কিন্তু আরও একবার বাইরে যেতে চায়। সে এবার বের হতে পারলে ২০-৩০ হাজার টাকা মতো ইনকাম করেই ক্যাম্পে ঢুকবে। এই টাকা নিয়ে সে ছোট একটি স্বর্ণ কিনতে চায়। রোহিঙ্গা কমিউনিটিতে স্বর্ণ ছাড়া বিয়ে অকল্পনীয়। বিয়ের পূর্বশর্ত হচ্ছে মেয়ে পক্ষকে স্বর্ণ দিয়ে তারপর বিয়ে করতে হবে। নাইমের বিয়ের সময় কাছে চলে এসেছে তাই স্বর্ণ আয় করা তার জন্য গুরুত্বপূর্ণ।
নাইমের সঙ্গে গল্প করতে করতেই পাশে আসে তারেক আজিজ। তারেক আজিজ বয়সে নাইমের বড়। সে মিয়ানমারে পড়াশোনা করেছে ক্লাস ফোর পর্যন্ত, এখানে অষ্টম সমমান পড়েছে। আপাতত আর পড়ছে না। কিন্তু সে পড়ালেখার জন্য কোনো অনুপ্রেরণাও পায় না। এই বন্দি ক্যাম্প তার ভালো লাগে না। তারেক আজিজ স্পষ্টত শুদ্ধ বাংলা, রোহিঙ্গা ও বার্মিজ ভাষায় কথা বলতে পারে। নাইম বিয়ের কথা ভাবলেও তারেক আজিজ বলছে সে বার্মা গিয়েই বিয়ে করবে। এই ক্যাম্পে সে কোনো স্বপ্ন দেখে না। সে তার দেশে ফিরতে চায়। একটা স্টেশনারির দোকান দিতে চায়, তারপর বিয়ে করবে। এখানে কোন দিন কোথায় যেতে হয় কোনো ঠিক নেই। এখানে সে বিয়ে করবে না। তারেক জানায় তার স্বপ্ন সে দেশে ফিরে যাবে কিন্তু সে স্বপ্নপূরণের কোনো আশা দেখে না। তবুও বিশ্বাস করে আজ বা কাল তারা দেশে ফিরবেই। এখানেই পার্থক্য আবদুল্লাহ ও তারেকের স্বপ্নের মধ্যে। মানুষ যা কখনো দেখেনি তা নিয়ে স্বপ্ন দেখতে পারে না। তাই আবদুল্লাহর স্বপ্নেও বার্মা নেই। আমি তো বার্মা দেখিনি বয়ান দিয়ে আবদুল্লাহ তার ‘দেশ পরিচয়’ কী হবে তা নিয়ে বিশ্বের কাছে বড় ধরনের একটি প্রশ্ন এঁকে দিচ্ছে, এর উত্তর হয়তো বাংলাদেশের কাছে নেই। কিন্তু জাতিসংঘ এই প্রশ্নের কী উত্তর দেবে? আবদুল্লাহর মতো যারা একবার ক্যাম্পের বাইরে এসেছে, বাইরের উন্মুক্ত দুনিয়া দেখেছে তারা কখনো স্বেচ্ছায় ক্যাম্পের জীবন বেছে নিতে চাইবে না।
তারেকের সঙ্গে হাঁটতে হাঁটতে ক্যাম্পের খোলা জায়গায় এসে দাঁড়ালাম। তারেক বলে, তারা এখানে যে পড়াশোনা করে তার সার্টিফিকেটের কোনো মূল্য নেই। সার্টিফিকেটে শুধু লেখা থাকে ‘এই ব্যক্তি এই ক্যাম্পের ঐ শিক্ষকের কাছে দশম শ্রেণি পর্যন্ত পড়েছে’ আর শিক্ষকের একটি স্বাক্ষর থাকে। তারেক বলে তাদের এই সার্টিফিকেট বিষয়ে যদি ইউনিসেফ বা জাতিসংঘ একটা স্বীকৃতির ব্যবস্থা করে তাহলে শরণার্থী কোটায় বিদেশে পড়তে যাওয়ার সুযোগ পেত।
তারেকের সঙ্গে কথা শেষ করে যখন ক্যাম্প থেকে বের হব সে মুহূর্তে পাশের একটি ঘরে দেখি কান্নার রোল। জানা গেছে, গত রাতে ২৩ বছরের এক যুবক রোহিঙ্গা অস্ত্রধারীদের হাতে নিহত হয়েছে। শুনে আমি চমকে গেলেও তারেকের এসব নিয়ে ভ্রুক্ষেপ নেই। সে আমাকে তার স্বপ্নের কথা বলেই যাচ্ছে। নদীতে যার ঘর গেছে সে কয়েকটা ইটের জন্য কী আক্ষেপ করবে! ঢাকা ফিরেই পত্রিকায় রোহিঙ্গা নিহতের খবর পেলাম। জানা যায়, মাদক ব্যবসার টাকা ভাগাভাগি ও আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে আশ্রয় শিবিরে হত্যাকান্ডের ঘটনা বেড়েই চলছে। ক্যাম্পের মধ্যে এক তরুণ নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলছিল, রোহিঙ্গারা ক্যাম্পে থাকলেও সুযোগ বুঝে কেউ কেউ আরাকান ঘুরে আসছে, আর এই আসা-যাওয়ার খরচ জোগাতে প্রায় সবাই মাদকের বাহক হিসেবে কাজ করে।
জানা যায়, রোহিঙ্গা ক্যাম্পে গত ৪ মাসে কুপিয়ে এবং গুলি করে অন্তত ১২ জন রোহিঙ্গাকে হত্যা করা হয়েছে (দৈনিক প্রথম আলো, ১২ ডিসেম্বর, ২০২২)। ক্যাম্পে থাকতেই কয়েকজন বলছিল গবেষক ও এনজিওকর্মীদের বিকেল পর্যন্ত থাকার অনুমতি আছে। এই সময়ের পরিবেশ একরকম। কিন্তু এরপরই রোহিঙ্গা শিবিরের চিত্র বদলে যায়। ক্যাম্পের নিয়ন্ত্রণ চলে যায় রোহিঙ্গা অস্ত্রধারী সংগঠনের হাতে। বিভিন্ন দলে-উপদলে বিভক্ত দলগুলো আসলে কী চায় খুব একটা স্পষ্ট নয়। কিন্তু তারা যে নিরাপত্তা সংকট তৈরি করছে তা বাংলাদেশের জন্য বোঝা বাড়াচ্ছে।
এক মিলিয়নের বেশি রোহিঙ্গা শরণার্থী বহন করার সক্ষমতা রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের নেই, সেটা আর্থিক, কারিগরি ও ভৌগোলিকভাবেও। ২০১৭ সালে যারা শিশু ছিল তারা আজ কিশোর। তারা স্বপ্ন সাজাচ্ছে কিন্তু আশা দেখে না। অঘোর অন্ধকারে যখন ক্যাম্পের আকাশ ঢেকে যায়, মাথার ওপর তারা ঝিলমিল করে, তখন তারা আরাকানের কথা ভাবে, নিজেদের স্বপ্নের কথা ভাবে। তাদের স্বপ্নের আকাশে আশার চাঁদ নেই। এসব আশাহত কিশোর একদিন যুবক হবে, তাদের আশাহতের সুযোগ নিতে পারে অস্ত্রধারী গ্রুপগুলো, যা ভবিষ্যতে ক্যাম্পকে কেন্দ্র করে বড় নিরাপত্তা সংকট তৈরি হতে পারে।
লেখক: কলামিস্ট
psmiraz@yahoo.com