শুক্রবার, ০৩ অক্টোবর ২০২৫, ০৩:৪০ অপরাহ্ন
রাজেকুজ্জামান রতন:
শ্রমিকদের বিশেষত গার্মেন্টস শ্রমিকদের মজুরি বিতর্ক আবার শুরু হয়েছে। শ্রমিকদের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় তার মজুরি। এই প্রশ্ন সব সময়ই উঠে থাকে, যুক্তিসংগত অথবা মানবিক মর্যাদা রক্ষা করার মতো মজুরি নির্ধারণ করা হবে কীভাবে? একটু ভেবে দেখা যাক! একটি শ্রমিক পরিবারে কী কী দরকার হয়? অন্তত তিনবেলা খাবার, পোশাক, মাথা গোঁজার ঠাঁই, অসুস্থ হলে চিকিৎসা, সন্তানের শিক্ষা, বৃদ্ধ বয়সের জন্য সঞ্চয়, অতিথি আপ্যায়ন ও বিনোদন ছাড়া মানবিক জীবন কীভাবে হয়? তাই এসব বিবেচনায় নিয়ে ন্যূনতম মজুরি নির্ধারণ করা উচিত। পৃথিবীর অন্তত, ৯০টি দেশে ন্যূনতম মজুরি আইন করে নির্ধারণ করা হয়। ন্যূনতম মজুরি আইন প্রথম করা হয় নিউজিল্যান্ডে ১৮৯৬ সালে। এরপর অস্ট্রেলিয়ায় ১৮৯৯ সালে, ব্রিটেনে ১৯০৯ সালে, শ্রীলঙ্কায় ১৯২৭ সালে এবং ১৯৩৬ সালে ভারতে, ১৯৬৯ সালে পাকিস্তানে প্রবর্তন করা হয়। দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধিকে বিবেচনায় নিয়ে ফ্রান্স, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, বেলজিয়াম, পর্তুগাল, স্পেন, মরিশাস, মেক্সিকো, কম্বোডিয়াসহ বিভিন্ন দেশে প্রতি বছর মজুরি পুনর্নির্ধারণ করা হয়। কানাডায় করা হয় প্রতি দুই বছর পরপর। বাংলাদেশে পাঁচ বছর পরপর মজুরি পুনর্নির্ধারণের আইন করা হয়েছে। কিন্তু পাঁচ বছর দ্রব্যমূল্য তো এক জায়গায় থাকে না, তাই শ্রমিক প্রতি বছর হারাতে থাকে তার প্রকৃত মজুরি।
বাংলাদেশের শ্রম আইনে মজুরি নির্ধারণের ক্ষেত্রে কী বলা আছে? শ্রম আইনের ১৪১ ধারায় বলা আছেজীবনযাপন ব্যয়, জীবনযাপনের মান, উৎপাদন খরচ, উৎপাদনশীলতা, উৎপাদিত দ্রব্যের মূল্য, মুদ্রাস্ফীতি, কাজের ধরন, ঝুঁকি ও মান, ব্যবসায়িক সামর্থ্য, দেশের ও সংশ্লিষ্ট এলাকার আর্থসামাজিক অবস্থা এবং অন্য প্রাসঙ্গিক বিষয় বিবেচনা করতে হবে। শ্রম আইনে উল্লিখিত মানদন্ডসমূহ একটু বিশ্লেষণ করে দেখা যাক সে হিসেবে মজুরি কত হতে পারে।
১. জীবনযাপন ব্যয় : শ্রমিকের প্রধান সম্পদ তার কর্মক্ষমতা। তার কর্মক্ষমতা কাজে লাগিয়ে সে যা আয় করে তা দিয়ে তার সংসার চালাতে হয়। কর্মক্ষম মানুষ, শিশু, বৃদ্ধ, সন্তানসম্ভবা মাসবার কথা বিবেচনা করে প্রতিদিন একজন মানুষের গড়ে ২৮০০ থেকে ৩০০০ কিলো ক্যালরি তাপ উৎপাদনের উপযোগী খাবার খেতে হয়। বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) গবেষকরা সাম্প্রতিক সময়ে বলেছেন, বর্তমান বাজারদর অনুযায়ী ঢাকায় বসবাসরত চার সদস্যের একটি পরিবারের খাবার খরচের জন্য মাসিক ২২ হাজার ৪২১ টাকা প্রয়োজন হচ্ছে। আর কোনো মাছ-মাংস না খেলেও খাবার বাবদ খরচ হচ্ছে ৯ হাজার ৫৯ টাকা।
আর জাতিসংঘের পাঁচটি প্রতিষ্ঠানের সম্মিলিত মত, বাংলাদেশে একজন মানুষের স্বাস্থ্যকর খাবারের জন্য দৈনিক প্রয়োজন ২৭৬ টাকা। অর্থাৎ ৪ সদস্যের পরিবারের খাবার খরচ বাবদ মাসে প্রয়োজন হবে ৩৩,১২০ টাকা। জ্বালানি তেলের সর্বশেষ মূল্যবৃদ্ধির দুই মাস আগে নিত্যপণ্যের বাজারমূল্য বিবেচনায় নিয়ে সিপিডি বলেছিল খাবারের সঙ্গে এক কক্ষের ঘরভাড়া, গ্যাস-বিদ্যুতের বিল, চিকিৎসাব্যয়, স্বাস্থ্য সুরক্ষার পণ্য ক্রয়, সন্তানের পড়ালেখার খরচ, যাতায়াত, মোবাইল ফোন ও ইন্টারনেটের বিল হিসাব করলে ঢাকার আশপাশের এলাকায় চার সদস্যের এক পরিবারের মাসিক খরচ গিয়ে দাঁড়ায় ৪২ হাজার ৫৪৮ টাকা। বর্তমানে দ্রব্যমূল্য বিবেচনায় নিলে এ খরচের পরিমাণ আরও বেশি হবে।
২. সরকারি হিসাবে মাথাপিছু আয় ২৮২৪ ডলার। তাদের ঘোষণা, ২০২২-২৩ অর্থবছরে দেশের মাথাপিছু আয় ৩০০৭ ডলারের বেশি হবে। সে হিসেবে ৪ সদস্যের পরিবারের বার্ষিক আয় ১১ লাখ ৫২ হাজার টাকার বেশি। এই আয়কে মাসিক আয়ে পরিণত করলে তার পরিমাণ হবে ৯৯ হাজার টাকার বেশি (১ ডলার = ১০৬ টাকা হিসাবে)। পরিবারের দুজন সদস্য আয় করলেও একজন কর্মক্ষম মানুষের গড় মাসিক আয় ৪৯ হাজার টাকার বেশি হতে হবে। প্রশ্ন উঠতে পারে, মাথাপিছু আয় মানে কি সবার আয় সমান হবে নাকি? কিন্তু যদি পাল্টা প্রশ্ন করা হয়, যারা দেশের প্রধান রপ্তানি পণ্য উৎপাদন করে তারা কি অন্তত মাথাপিছু আয়ের সমান মজুরি পাওয়ার অধিকার রাখে না?
৩. শ্রমিক কাজ করতে আসে দারিদ্র্য দূর করার জন্য। বিশ্বব্যাংকের হিসাব অনুযায়ী বাংলাদেশের মতো দেশে দারিদ্র্যসীমার ওপরে উঠতে প্রতিদিন প্রতিজনের কমপক্ষে দুই ডলার আয় করতে হয়। সে হিসেবে মাসে ২৫ হাজার টাকার কম আয় হলে ৪ সদস্যের একটি পরিবার দারিদ্র্যসীমার ওপরে উঠতে পারবে না। তাহলে একটি উন্নয়নশীল দেশে উৎপাদনের প্রধান চালিকাশক্তি শ্রমিকরা মজুরি পেয়ে দারিদ্র্যসীমার ওপরে উঠবে না, এটা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না।
৪. সরকার ঘোষিত বেতন কাঠামো অনুযায়ী ২০১৫ সালে পে-স্কেলের সর্বনিম্ন ধাপে বেতন ৮২৫০ টাকা বেসিক ধরে ১৪ হাজার ৫০০ টাকার বেশি নির্ধারণ করা হয়েছিল। গত আট বছরের বার্ষিক বেতন বৃদ্ধির হার বিবেচনা করলে বর্তমানে তা ২৩ হাজার টাকার বেশি দাঁড়ায়। এ ছাড়া তারা নববর্ষ বোনাস, ভ্রমণ-ভাতা, অবসর প্রস্তুতিকালীন সবেতন ছুটি ইত্যাদিসহ নানা রকম সুবিধা পেয়ে থাকেন। পে-স্কেলের সর্বনিম্ন ধাপের কর্মচারী একজন পিয়ন তার ৫৯ বছর বয়সে চাকরি অবসানের পর আজীবন পেনশন পাবেন। কিন্তু বেসরকারি খাতের শ্রমিকরা পেনশনসহ এসব অধিকার পান না। তাই ন্যায্যতার প্রশ্নে তাদের মজুরি সরকারি খাতের চেয়ে বেশি না হলে তা কোনোভাবেই ন্যায়সংগত হবে না।
৫. ২ জুলাই ২০১৮ তারিখে মন্ত্রিসভার বৈঠকে রাষ্ট্রায়ত্ত কারখানার শ্রমিকদের মজুরি অনুমোদিত হয়। সে অনুযায়ী ২০১৫ সাল থেকে কার্যকর মজুরির মূল বেতন ৮৩০০ টাকা, যা প্রতি বছর ৫ শতাংশ হারে বৃদ্ধি করার নিয়ম কার্যকর আছে। এই বৃদ্ধিপ্রাপ্ত মূল বেতনের সঙ্গে বাড়িভাড়া, চিকিৎসা-ভাতা, টিফিন-ভাতা, যাতায়াত-ভাতা, ধোলাই-ভাতা, ঝুঁকি-ভাতা, শিক্ষা সহায়তা-ভাতা যুক্ত করলে বর্তমান মজুরি হয় প্রায় ২৪ হাজার টাকা। সরকারি প্রতিষ্ঠানের বেতন কাঠামোকে জাতীয় মানদণ্ড ধরা উচিত।
৬. বাংলাদেশ ব্যাংক বিভিন্ন ব্যাংকের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের প্রারম্ভিক বেতন-ভাতা নির্ধারণ করে দিয়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক নিরাপত্তাকর্মী, বার্তাবাহক, পরিচ্ছন্নতাকর্মীসহ কর্মচারীদের প্রারম্ভিক বেতন-ভাতা সর্বনিম্ন ২৪ হাজার টাকা নির্ধারণ করে গত এপ্রিল ২০২২ থেকে বাস্তবায়নের নির্দেশনা দিয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের এই নির্দেশনা প্রমাণ করে যে মাসে ২৪ হাজার টাকার কম মজুরিতে ন্যূনতম মানসম্পন্ন জীবনযাপনের সুযোগ নেই।
৭. গার্মেন্টস পণ্য যে দেশেই তৈরি হোক না কেন এর বাজার আন্তর্জাতিক। গার্মেন্টস পণ্য রপ্তানিকারক ৭টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের শ্রমিকদের মজুরি সবচেয়ে কম। চীন, ভারত, শ্রীলঙ্কা, মালয়েশিয়া, কম্বোডিয়া, ইন্দোনেশিয়া ও বাংলাদেশ নিয়ে জরিপ চালিয়ে অক্সফাম এই তথ্য জানায়। ২১ জানুয়ারি ২০১৮ তারিখে প্রকাশিত আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান অক্সফামের গবেষণা জরিপ ‘রিওয়ার্ড ওয়ার্ক নট ওয়েলথ’ নামে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, বাংলাদেশে শ্রমিকদের জন্য শোভন মজুরি হতে হলে তা মাসে ২৫২ ডলার বা ২৪ হাজার ৬৯৬ টাকা হতে হবে। এটা তো ৪ বছর আগের হিসাব। শোভন কাজ, পরিবেশ এবং এসডিজি নিয়ে সারা পৃথিবীর মতো বাংলাদেশেও অনেক আলোচনা এবং পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে। কিন্তু শোভন মজুরি ছাড়া শোভন কাজ এই কথার কোনো অর্থ কি আছে?
৮. মজুরি নির্ধারণে একটি প্রধান বিষয় শ্রমিকের শ্রমে উৎপাদিত পণ্যে মূল্য সংযোজন কত হয়? এবং কী দামে তা বিক্রি হয়? পৃথিবীর যেকোনো দেশেই তা উৎপাদিত হোক না কেন গার্মেন্টস পণ্যের টার্গেট প্রধানত ইউরোপ, আমেরিকা, কানাডা, রাশিয়ার বাজার। গার্মেন্টসশিল্পে মূল্য সংযোজন কী পরিমাণ হচ্ছে, প্রধান গার্মেন্টস রপ্তানি দেশ যেমন চীন, তুরস্ক, ভিয়েতনাম, কম্বোডিয়া, শ্রীলঙ্কা, ভারতের শ্রমিকদের তুলনামূলক মজুরি কত এ বিষয়গুলোও বিবেচনা করা উচিত।
গার্মেন্টস বাংলাদেশের রপ্তানি আয়ের প্রধান উৎস। বাংলাদেশের রপ্তানির ৮৩ শতাংশের বেশি আসে গার্মেন্টস খাত থেকে। ২০১৭-১৮ অর্থবছরে গার্মেন্টস পণ্য রপ্তানি হয়েছিল ৩০.৬২ বিলিয়ন ডলার আর ইপিবির তথ্যবিশ্লেষণে দেখা যায়, ২০২১-২২ অর্থবছরে তৈরি পোশাক রপ্তানি থেকে আয় হয়েছে ৪২ দশমিক ৬১ বিলিয়ন ডলার। এই বাড়তি উৎপাদনের জন্য নিযুক্ত শ্রমিকের সংখ্যা বাড়ার পরিবর্তে কমেছে, অর্থাৎ শ্রমিকের উৎপাদনশীলতা প্রায় দ্বিগুণ বেড়েছে। অথচ আমরা দেখছি সেই গার্মেন্টসের শ্রমিকদের মজুরি পৃথিবীর মধ্যে সর্বনিম্ন। শ্রমিকের আয় না বাড়ায় তাদের জীবনমান বাড়ছে না। নিম্ন মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত বাংলাদেশে শ্রমিকরা মানসম্পন্ন জীবনযাপন করার মতো মজুরি পাবেন না এটা হতে পারে না। আবার অর্থনীতির সাধারণ নিয়ম অনুযায়ী শ্রমিকের ক্রয়ক্ষমতা বাড়লে দেশের অর্থনীতির সামগ্রিক গতিশীলতা বাড়ে। মানসম্পন্ন মজুরি যেমন শ্রমিকদের জীবনমান উন্নত করে, তেমনি দেশের অর্থনীতিকে শক্তিশালী করে। বাংলাদেশকে যদি উন্নত দেশের কাতারে উন্নীত করতে হয় তাহলে শ্রমজীবী মানুষের আয় বাড়াতেই হবে। ন্যায্য মজুরির নির্ধারণ তাই বাংলাদেশের শ্রমিক এবং অর্থনীতির বিকাশের জন্যই প্রয়োজন। গার্মেন্টস শ্রমিকদের উৎপাদিত পণ্য আমেরিকা, ইউরোপের বাজারে বিক্রি হয়। ৫-১০ সেন্ট দাম বাড়লে সেখানকার ক্রেতারা টি-শার্ট কিনবে না এটা কোনোভাবেই বিশ্বাসযোগ্য নয়। আসলে শ্রমিককে কম মজুরি দেওয়ার জন্য কাল্পনিক ভয় দেখানো অনুচিত। আর বাংলাদেশ থেকে গার্মেন্টস চলে যাওয়া তো দূরের কথা উল্টো চীনসহ বিভিন্ন দেশ থেকে আমাদের দেশে কাজ আসছে, চীনের ব্যবসায়ীদের দল মাঝেমধ্যেই বাংলাদেশে আসছে, তারা সরকারের উচ্চপর্যায়ের সঙ্গে বৈঠক করছে। বাংলাদেশের গার্মেন্টস মালিকরাও ২০৩০ সালের মধ্যে গার্মেন্টস পণ্যের রপ্তানি বার্ষিক ১০০ বিলিয়ন করার স্বপ্ন দেখছেন। এসব স্বপ্নের সঙ্গে শ্রমিকদের মানসম্পন্ন জীবনযাপনের উপযোগী মজুরির কথাটা যেন চাপা পড়ে না যায়। মজুরি বিতর্কের গ্রহণযোগ্য সমাধান তাই জরুরি।
লেখক: রাজনৈতিক সংগঠক ও কলামিস্ট
rratan.spb@gmail.com