বুধবার, ০৮ অক্টোবর ২০২৫, ০৭:৪৩ অপরাহ্ন

দৃষ্টি দিন:
সম্মানিত পাঠক, আপনাদের স্বাগত জানাচ্ছি। প্রতিমুহূর্তের সংবাদ জানতে ভিজিট করুন -www.coxsbazarvoice.com, আর নতুন নতুন ভিডিও পেতে সাবস্ক্রাইব করুন আমাদের ইউটিউব চ্যানেল Cox's Bazar Voice. ফেসবুক পেজে লাইক দিয়ে শেয়ার করুন এবং কমেন্ট করুন। ধন্যবাদ।

মূর্তি নয় শুধু, ভাবমূর্তিও!

ইরতিশাদ আহমদ:

“সিংহকে যদি তার কাহিনী বলতে দেওয়া না হয়, শিকারের গল্প সবসময় শিকারিকেই মহিমান্বিত করবে” জিম্বাবুয়ের প্রচলিত প্রবাদ।

মূর্তি, স্মৃতিস্তম্ভ, নামাঙ্কিত ভবন বা সড়ক-সেতু, প্রভৃতির উদ্দেশ্য কী? আর কিছু নয়, এর উদ্দেশ্য হলো ভাবমূর্তি সৃষ্টি করা। যে ভাবমূর্তি প্রায়শই অর্ধসত্যের বা অসত্যের ওপরে প্রতিষ্ঠিত। মূর্তি বানিয়ে বৈধতা দেওয়ার প্রয়াস থাকে ভাবমূর্তি সৃষ্টির প্রচেষ্টায়। মানুষের মন-মানসে ভাবমূর্তি তৈরির প্রয়োজনেই মূর্তির নির্মাণ। মূর্তি এসেছে ইতিহাসের পক্ষপাতমূলক বয়ানের ধারাবাহিকতায়– ভাবমূর্তি সৃষ্টির প্রয়োজনে। ক্ষমতাসীনদের বয়ানে লেখা ইতিহাসে তাদের এবং তাদের পূর্বপুরুষদের স্তুতি থাকবে, সাফাই থাকবে, অতিরঞ্জিত কাহিনী থাকবে– সত্যিকারের ইতিহাস নয়। তাই সেই ইতিহাসের ধারায় নির্মিত ও প্রতিষ্ঠিত মূর্তিগুলো সাধারণত বিরাটাকায়, স্বাভাবিক মানুষের আকার থেকে অনেক বড়। তাদের চরিত্রের কলুষতা, দুর্বলতা, অমানবিকতা আর ইতিহাসে তাদের ভূমিকার অন্ধকার দিকগুলোকে দামি পাথরের বা মূল্যবান ধাতুর বিশালত্ব, কাঠিন্য এবং চাকচিক্য দিয়ে ঢেকে দেওয়ার প্রয়াস যেন।

আমেরিকার মিনেসোটায় শ্বেতাঙ্গ পুলিশের নির্যাতনে প্রাণ হারালেন কৃষ্ণাঙ্গ জর্জ ফ্লয়েড। তার মৃত্যু যুগ যুগ ধরে লালিত বর্ণবৈষম্যের বিরুদ্ধে সূচনা করল এক অভূতপূর্ব গণঅভ্যুত্থানের। শুধু আমেরিকায় নয়, সারা বিশ্বে। এই বিক্ষোভের ধারাক্রমে বিক্ষোভ ঘটেছে ইতিহাস সৃষ্টিকারী কয়েকজন ‘ঐতিহাসিক’ ব্যক্তিত্বের বর্ণবৈষম্যবাদী ও মানবতাবিরোধী ঐতিহাসিক ভূমিকার বিরুদ্ধে। প্রশ্ন উঠেছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের স্থপতি বা ‘ফাউন্ডিং ফাদার্স’দের ভূমিকা নিয়ে। তাদের প্রায় সবাই কৃষ্ণাঙ্গ দাসদের মালিক ছিলেন বা দাস ব্যবসার সঙ্গে জড়িত ছিলেন। তাদের জীবনের কিছু অন্ধকার অধ্যায় আছে, আর আছে সেগুলোকে ঢেকে রাখার সচেতন প্রয়াস প্রচলিত ইতিহাসে। কিন্তু ইতিহাসেরও পুনর্জন্ম আছে। তথ্য বদলায় না, কিন্তু ইতিহাস, ইতিহাসের বয়ান পরিবর্তিত হতে পারে। ইতিহাসের নতুন পাঠে কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে যেতে পারেন নন্দিত ‘ঐতিহাসিক’ ব্যক্তিত্বরা। এবারের নতুন পাঠে, ক্রিস্টোফার কলম্বাস থেকে শুরু করে জর্জ ওয়াশিংটন কেউ বাদ যাননি। আমেরিকার কথিত আবিষ্কারক কলম্বাসের বর্বরোচিত কর্মকাণ্ডের বিবরণ সচেতন করে তুলেছে এই প্রজন্মের আমেরিকানদের। কলম্বাসের নামে প্রবর্তিত এবং উদযাপিত দিবস এখন যুক্তরাষ্ট্রের অনেক অঙ্গরাজ্যেই আর পালিত হয় না। কয়েকটা অঙ্গরাজ্য আর শহরে পালিত হয় আদিবাসী দিবস (ইন্ডিজেনাস ডে) নামে।

যুক্তরাষ্ট্রের প্রথম প্রেসিডেন্ট হলেও, ‘ফাউন্ডিং ফাদার্স’দের একজন হলেও, জর্জ ওয়াশিংটন যে একজন দাস-মালিক ছিলেন ঐতিহাসিক এই তথ্যটাকে আর গুরুত্বহীন জ্ঞানে উপেক্ষা করা যাচ্ছে না। যুক্তরাষ্ট্রের মতো একটা দেশের প্রতিষ্ঠায় তার শত অবদান থাকা সত্ত্বেও। প্রশ্ন উঠেছে, টমাস জেফারসন এবং এন্ড্রু জ্যাকসনসহ আর অনেকের ইতিহাস নিয়ে, ইতিহাসে তাদের ভূমিকা নিয়ে। প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয় সিদ্ধান্ত নিয়েছে উড্রো উইলসনের নাম একটি ভবন থেকে অপসারণের।

বিক্ষোভটা ছড়িয়ে পড়েছে বিশ্বব্যাপী। সংগঠিত হয়েছে, হচ্ছে দেশে দেশে বর্ণবৈষম্যের প্রাণকেন্দ্র বিশ্বের বড় বড় শহরগুলোতে। বিশ্ব ইতিহাসের অনেক রথী-মহারথীদের স্মৃতি শ্রদ্ধার সঙ্গে ধরে রাখার জন্য যে মূর্তিগুলো বড় বড় শহরের কেন্দ্রে স্থাপন করা হয়েছে সে মূর্তিগুলোর ওপরে বিক্ষোভরত জনতার রোষ গিয়ে পড়েছে। কোনোটাকে উপড়ে ফেলা হয়েছে, কোনোটার গায়ে রং-কালি মেখে দেওয়া হয়েছে। আসলে বিক্ষোভটা ঐতিহাসিক সেই চরিত্রগুলোকে শ্রদ্ধাভরে জনসাধারণের স্মৃতিতে জাগরূক রাখার যে উদ্দেশ্য তারই বিরুদ্ধে। কেন এই মূর্তি? কেন এই স্মৃতিসৌধ? কীসের স্মৃতি, কোন স্মৃতি? এই বিক্ষোভ, যে ইতিহাস এতদিন শোনানো হয়েছে তার বর্ণনা এবং বর্ণনাকারীদেরই প্রশ্নবিদ্ধ করেছে।

ওপরে উল্লিখিত জিম্বাবুয়ের সেই প্রবাদবাক্যটার ব্যাখ্যানুযায়ী। কারা লিখেছে এই ইতিহাস? সে প্রশ্নই সামনে চলে এসেছে সবকিছুকে ছাপিয়ে। ইতিহাসের ঘটনা কেউ অস্বীকার করে না, করতে পারে না। কলম্বাসের অভিযান ও তার ফলে ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলোর গতিপ্রকৃতি নিয়ে বিতর্কের অবকাশ খুব একটা নেই। এখন আমাদের ভালো লাগুক বা না লাগুক যা ঘটেছে তা ঘটেছে তাকে বদলানোর উপায় নেই। তবে ইতিহাসের যে ব্যাখ্যা বা মূল্যায়ন আমরা পেয়ে এসেছি ক্ষমতাধরদের কাছ থেকে তাকে বর্জন করা যাবে না, অস্বীকার করা যাবে না, প্রশ্ন করা যাবে না, বা তার ভিন্ন মূল্যায়ন উপস্থাপন করা যাবে না এ যুগে এই আবদার আর মেনে নেওয়া যায় না। কারণ ঐতিহাসিক চরিত্রগুলোকে মহিমান্বিত করার সিদ্ধান্ত তো ইতিহাসের সিদ্ধান্ত নয়, সিদ্ধান্তটা স্রেফ রাজনৈতিক নিয়েছেন ক্ষমতাবান রাজনীতিকরা, রক্ষণ করেছেন ক্ষমতাসীন রাজনীতিকরা, রাজনৈতিক কারণেই। (যে কারণে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প এই সেদিন জারি করেছেন ‘মূর্তি রক্ষার’ নির্বাহী আদেশ।)

ধরা যাক, উইনস্টন চার্চিলের কথা। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালীন ব্রিটেনের প্রতাপশালী প্রধানমন্ত্রী চার্চিল শুধু রাজনীতি, কূটনীতির জন্যই যে খ্যাতি পেয়েছিলেন তাই নয়, তাকে ভাষার ব্যবহারে অভিনবত্ব ও মৌলিকত্বের জন্য সাহিত্যের নোবেল পুরস্কারও দেওয়া হয়েছিল ১৯৫৩ সালে। যখন তিনি দ্বিতীয়বারের মতো যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। তার বর্ণবাদী বাণীগুলো কিন্তু সযতনে পরিহার করা হয়ে থাকে তার সম্পর্কে বিদগ্ধ আলোচনায়। যেমন তিনি বলেছিলেন, ‘আই হেইট ইন্ডিয়ানস’, বলেছিলেন, ‘দে আর অ্যা বিস্টলি পিপল উইথ অ্যা বিস্টলি রিলিজিওন’ (এরা জংলি মানুষ, এদের ধর্মটাও জংলি)। বাংলায় ১৯৪৩-এ যে দুর্ভিক্ষ হয় তার জন্য দায়ী চার্চিল অনুসৃত নীতি। জাপান-অধিকৃত বার্মা থেকে চালের সরবরাহ বন্ধ হয়ে গেলে চার্চিল ও তার কেবিনেট নির্দেশ দেয় ব্রিটিশ সৈন্যদের জন্য চাল মজুদ রাখতে। যার ফলে দুর্ভিক্ষে মারা যায় বাংলার ত্রিশ লাখেরও বেশি মানুষ। আমাদের শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনের তুলিতে যে দুর্ভিক্ষের চিত্রভাষ্য অমর হয়ে আছে। সমালোচনার মুখে দুর্ভিক্ষ-পীড়িত মানুষদের সম্পর্কে চার্চিল মন্তব্য করেছিলেন, তার নির্দেশ পরিবর্তন করলে ফলাফলে খুব একটা হেরফের হবে না, কারণ ‘দে ব্রিড লাইক রেবিটস’ (ওরা খরগোশের মতো বংশবৃদ্ধি করে)। ভারতীয় কংগ্রেস নেতা গান্ধীকে নিয়ে তীর্যক মন্তব্য করেছিলেন, ‘এত লোক মরলে গান্ধী বেঁচে আছে কেন’? ভাষার ব্যবহারে চার্চিল সৃষ্টিশীল ছিলেন বটে! সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার তো আর এমনিতেই দেওয়া হয়নি!

গান্ধীর কথা যখন এসেই গেল তখন তার কথাও বলা দরকার। গান্ধীর মূর্তিও শোভা পায় লন্ডনের পার্লামেন্ট স্কোয়ারে, যেখানে আছে চার্চিলের মূর্তি। সেই গান্ধীকে নিয়েও কথা উঠেছে। অহিংসার প্রবক্তা, ‘মহাত্মা’ উপাধিপ্রাপ্ত গান্ধীর ভাবমূর্তি জনমানসে, শুধু ভারত উপমহাদেশে নয়, সারা বিশ্বে প্রায় অবিসংবাদিত। কিন্তু গান্ধীও বর্ণপ্রথার সমর্থক ছিলেন। এই নিয়ে ভারতের সংবিধান রচয়িতাদের অন্যতম, দলিত সম্প্রদায়ের নেতা বাবাসাহেব আম্বেদকার ছিলেন গান্ধীর সমালোচনায় উচ্চকণ্ঠ। মেনে নিলেও নেওয়া যেতে পারে, হিন্দু ধর্মের ভক্ত এবং অনুসারী হিসেবে রাজনীতিক গান্ধী বর্ণপ্রথাকে বর্জন করতে পারেননি। ইতিবাচক প্রলেপ লাগিয়ে গ্রহণযোগ্য করে তোলার চেষ্টা করেছেন।

কিন্তু গান্ধীর বর্ণবিদ্বেষী মানসিকতার নিদর্শন শুধু ভারতে নয়, পাওয়া যায় সবচেয়ে বেশি দক্ষিণ আফ্রিকায়, যেখানে তিনি আইন ব্যবসায় নিযুক্ত ছিলেন ভারতে ফিরে আসার আগে। সেখানকার নেটিভ কালোদের তিনিও নিচ জাতের মনে করতেন, ঠিক যেমন উপনিবেশবাদী শ্বেতাঙ্গরা করত। তার সংগ্রামের মূল উদ্দেশ্য ছিল বাদামি গাত্রবর্ণের ভারতীয়রা যেন শ্বেতাঙ্গদের মতো সমমর্যাদা পায়। তখন শ্বেতাঙ্গরা কৃষ্ণাঙ্গ এবং ভারতীয়দের এককাতারে ফেলে নানা রকমের বৈষম্যমূলক আচরণ করত। শ্বেতাঙ্গ আধিপত্য মানতে তার আপত্তি ছিল না। কিন্তু সাদা কর্র্তৃপক্ষ ভারতীয়দের সঙ্গে কালো নেটিভদের মতো আচরণ করবে, এটি তার কাছে গ্রহণযোগ্য ছিল না। দক্ষিণ আফ্রিকায় ভারতীয়দের সঙ্গে শ্বেতাঙ্গদের আচরণের উদ্দেশ্য সম্পর্কে তিনি বলেছিলেন, “তারা চায় অসভ্য কাফিরদের (কৃষ্ণাঙ্গদের) স্তরে আমাদের নামিয়ে নিতে যাদের পেশা হচ্ছে শিকার আর জীবনে একমাত্র উদ্দেশ্য হচ্ছে একটা নির্দিষ্ট সংখ্যক পশু সংগ্রহ করে একটা বউ কিনে নেওয়া। আর তারপর অলস এবং ‘উলঙ্গ’ (বর্বরোচিত) জীবনযাপন করা”। জোহানেসবার্গ মিউনিসিপ্যাল কর্র্তৃপক্ষ সিদ্ধান্ত নিল আফ্রিকানরাও ভারতীয়দের সঙ্গে একই এলাকায় বসবাস করতে পারবে। বছরটি ছিল ১৯০৪। অসন্তুষ্ট গান্ধী লিখেছিলেন কাউন্সিলরের বরাবরে, ‘কাফিরদের এখান থেকে তুলে নিতে হবে। আমি এই কাফিরদের সঙ্গে ভারতীয়দের মেলামেশার ঘোর বিরোধী’।

গান্ধী ‘রোল মডেল’ ছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের আফ্রিকান-আমেরিকান নেতা মার্টিন লুথার কিং আর দক্ষিণ আফ্রিকার জননায়ক নেলসন মান্ডেলার। এভাবেই সৃষ্টি হয় ভাবমূর্তির। তবে মানুষের চোখ খুলছে। তাই ২০১৮-তে ঘানা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা তাদের ক্যাম্পাস থেকে গান্ধীর মূর্তিটাকে বেদি থেকে তুলে ফেলে দিয়েছে।

এই মূর্তিগুলোকে উপড়ে ফেলার জোয়ার এসেছে, ইতিহাসের নতুন পাঠের ফলে। জাদুঘরে তাদের জায়গা হলেও হতে পারে ইতিহাসের খাতিরে। তবে ভাবমূর্তি সংরক্ষণের উদ্দেশে নয়, খ-িত ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে নয়। বরং সম্পূর্ণ ও সঠিক ইতিহাসের বিচারে নির্ধারিত হবে তাদের যথাযোগ্য স্থান এবং নির্মিত হবে তাদের বাস্তবোচিত সত্যিকারের ভাবমূর্তি। প্রয়োজনে তাদের দাঁড়াতে হতে পারে আসামির জন্য নির্ধারিত জায়গা ইতিহাসের কাঠগড়ায়। অথবা তাদের আসন হতে পারে গণমানুষের অন্তরে, বীরের মর্যাদায়। বেদি থেকে মূর্তির উৎপাটনই যথেষ্ট নয় আরও জরুরি গণমানসে প্রকৃত ভাবমূর্তির সৃষ্টি এবং সত্যকে অস্বীকার করে মিথ্যার ওপরে প্রতিষ্ঠিত যে ভাবমূর্তি তার উচ্ছেদ।

লেখক-ইমেরিটাস প্রফেসর, ফ্লোরিডা ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি, যুক্তরাষ্ট্র
irtishad@gmail.com

Please Share This Post in Your Social Media

© All rights reserved © 2023
Developed by : JM IT SOLUTION