মঙ্গলবার, ০৫ ডিসেম্বর ২০২৩, ০৫:৪৮ অপরাহ্ন
আবদুল আউওয়াল:
ফেতনা মানে বিপদাপদ, দুর্যোগ, বিশৃঙ্খলা ইত্যাদি। তবে মানুষে মানুষে হানাহানি, খুনোখুনি, যুদ্ধ-বিদ্রোহের মতো ঘটনাগুলোকেই প্রধানত ফেতনা হিসেবে ধরা হয়। ফেতনার সময় ইমান নিয়ে বেঁচে থাকা কষ্টকর। তখন সত্য-মিথ্যার পার্থক্য করা কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। কারণ তা রাতের অন্ধকারের মতোই কালো থাকে। নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘শেষ জামানায় রাতের ঘনকালো অন্ধকারের মতো অনেক ফেতনার আবির্ভাব হবে। তখন মানুষ সকালে মুমিন থাকবে সন্ধ্যায় কাফের হয়ে যাবে। সন্ধ্যায় মুমিন থাকবে সকালে কাফের হয়ে যাবে।’ মুসান্নাফে ইবনে আবি শায়বা : ১৩/৩৮৫
হজরত আবু হুরায়য়া (রা.) কর্র্তৃক বর্ণিত হাদিসে এসেছে, ‘সে সময় অনেকে ফেতনায় পড়ে দুনিয়ার সম্পদের বিনিময়ে তাদের দ্বীন বিক্রি করে দেবে।’ সহিহ মুসলিম : ১১৮
অর্থাৎ মানুষ এতটাই দুনিয়ামুখী হবে যে সামান্য স্বার্থে নিজের চরিত্র ও আদর্শকে বিকিয়ে দিয়ে কুফরি করবে কিংবা কুফরির পক্ষে সমর্থন জোগাবে। ইসলামের বিরোধিতায় লিপ্ত হবে অথবা ইসলাম ও মুসলমানদের ক্ষতি হয় সে পথে হাঁটবে।
সেই ফেতনার সময় চলছে। ভবিষ্যতে তা আরও গভীর হবে। এই উম্মতের ওপর ফেতনার সূচনা হয় বিদ্রোহী কর্র্তৃক হজরত উসমান (রা.)-কে শহীদ করার মধ্য দিয়ে। অতঃপর তা আর বন্ধ হয়নি। এর ধারাবাহিকতায় সিফফিনের যুদ্ধ, উষ্ট্রের যুদ্ধের মতো (হজরত আলী (রা.) ও হজরত মুয়াবিয়া (রা.)-এর মধ্যকার যুদ্ধ) ফেতনায় মুসলিমরা পড়েছিল। কেয়ামত পর্যন্ত অনবরত ফেতনা আসতেই থাকবে।
নবী করিম (সা.) সব ফেতনা সম্পর্কে উম্মতকে সাবধান করে গেছেন এবং তা থেকে বাঁচার উপায়ও বলে দিয়েছেন। যেহেতু ফেতনার সময় বিবাদমান দলগুলোর কোনটির দাবি সত্য, কোনটির দাবি মিথ্যা তা নির্ণয় করা কঠিন হয়ে যায়, তাই তিনি এই জটিল পরিস্থিতিতে কোনো দলের পক্ষে যোগ দিয়ে আন্দোলন, বিদ্রোহ ও যুদ্ধে নামতে নিষেধ করেছেন। তিনি বলেছেন, ‘অচিরেই নানা রকম ফেতনার আবির্ভাব ঘটবে। সে সময় বসে থাকা ব্যক্তি ফেতনার দিকে হেঁটে অগ্রসর হওয়া ব্যক্তির চেয়ে এবং হেঁটে চলা ব্যক্তি আরোহী ব্যক্তির চেয়ে অধিক নিরাপদ ও উত্তম হবে। ফেতনা শুরু হয়ে গেলে যার উট থাকবে সে যেন উটের রাখালি নিয়ে ব্যস্ত থাকে। যার ছাগল থাকবে, সে যেন ছাগলের রাখালি নিয়ে ব্যস্ত থাকে। যার চাষাবাদের জমিন থাকবে, সে যেন চাষাবাদের কাজে ব্যস্ত থাকে।’ এক ব্যক্তি জিজ্ঞেস করলেন, ‘হে আল্লাহর নবী! যার কোনো কিছুই নেই সে কী করবে? তিনি বললেন, ‘পাথর দিয়ে তার তলোয়ারকে ভোঁতা করে নিরস্ত্র হয়ে যাবে এবং ফেতনা থেকে বাঁচার চেষ্টা করবে।’
…এরপর আরেক ব্যক্তি জিজ্ঞেস করলেন, ‘ওগো আল্লাহর নবী! কেউ যদি আমাকে জোর করে কোনো দলে নিয়ে যায় এবং সেখানে গিয়ে কারও তলোয়ার বা তীরের আঘাতে আমি নিহত হই, তাহলে আমার অবস্থা কী হবে? উত্তরে তিনি বললেন, ‘সে তার পাপ এবং তোমার পাপের বোঝা নিয়ে জাহান্নামের অধিবাসী হবে।’ সহিহ মুসলিম : ৬৯৮৬
উল্লিখিত আলোচনা দ্বারা এটা স্পষ্ট যে, ফেতনার মুহূর্তে প্রত্যেকে নিজ নিজ অবস্থানে অটল থেকে আপন কাজে মশগুল থাকা। নিজের চোখ-কান খোলা রেখে জীবনযাপন করা। মূক ও বধিরের মতো কিছু না জেনে কিছু না শুনে যে কারও ডাকে জীবন দেওয়ার প্রবণতা পরিহার করে চলা। জানমাল দেওয়ার আগে ভেবে নেওয়া, সেটাতে ধর্মের তাকিদ কতটা আছে। রক্তের মূল্যায়ন ধর্ম করবে নাকি ব্যক্তি ও গোষ্ঠীবিশেষ করবে। জীবনের বিনিময়ে জান্নাত পাওয়া যাবে নাকি জাহান্নাম। যুদ্ধ-বিদ্রোহের উপযুক্ত ধর্মীয় কারণ না থাকলে, শুধু নিজের স্বার্থরক্ষা, ক্ষমতা প্রতিষ্ঠা কিংবা হিংসা-বিদ্বেষের বশবর্তী হয়ে কারও পক্ষে কিংবা কারও বিপক্ষে গিয়ে নিজের জানমাল খরচ করলেই তার বিনিময় পাওয়া যাবে না। ন্যায়সংগত কারণে ধর্মীয়বোদ্ধাদের ঐকমত্যের ভিত্তিতে কোনো ফয়সালা হলে সেটা ভিন্ন কথা। নতুবা আত্মদান, আত্মত্যাগ বিফলে যাওয়ার সমূহ সম্ভাবনা রয়েছে। হাদিসে এসেছে, ‘ফেতনার যুগে হত্যাকারী ও নিহত ব্যক্তিদ্বয়ের কেউই জানবে না (হত্যাযোগ্য কোনো কারণ) কেন সে হত্যা করছে আর কেন সে নিহত হচ্ছে! সে যুগের হত্যাকারী আর নিহত ব্যক্তি দুজনই জাহান্নামি হবে (কারণ তাদের একজন হত্যাকারী আর অন্যজনের অন্তরে হত্যার নিয়ত ছিল কিন্তু সে পারেনি)।’ সহিহ মুসলিম : ৭১৯৬
স্মরণ রাখা চাই, আল্লাহতায়ালা চার প্রকার মানুষ ছাড়া সবাইকে ক্ষতির মধ্যে নিপতিত বলে ঘোষণা দিয়েছেন। ইরশাদ হয়েছে, ‘নিশ্চয় সব মানুষ ক্ষতিতে নিপতিত। তবে তারা ছাড়া যারা ইমান রাখে, সৎকাজ করে, পরস্পরকে সত্যের উপদেশ দেয় ও একে অন্যকে ধৈর্যের বাণী শোনায়।’ সুরা আসর : ২-৩
ভয়েস/আআ