শনিবার, ২৭ Jul ২০২৪, ০৯:১৯ পূর্বাহ্ন

দৃষ্টি দিন:
সম্মানিত পাঠক, আপনাদের স্বাগত জানাচ্ছি। প্রতিমুহূর্তের সংবাদ জানতে ভিজিট করুন -www.coxsbazarvoice.com, আর নতুন নতুন ভিডিও পেতে সাবস্ক্রাইব করুন আমাদের ইউটিউব চ্যানেল Cox's Bazar Voice. ফেসবুক পেজে লাইক দিয়ে শেয়ার করুন এবং কমেন্ট করুন। ধন্যবাদ।
শিরোনাম :

যুক্তরাষ্ট্রে আইনের শাসন ও ট্রাম্পের জবাবদিহি

রায়হান আহমেদ তপাদার:
২০১৬ সালের আগে অনেকেই মনে করেছিলেন, শেষ পর্যন্ত ট্রাম্প তার রাজনৈতিক আবেদনকে প্রসারিত করে সমর্থক ও বিরোধী মহলের প্রেসিডেন্ট হবেন। বেশির ভাগ রাজনীতিক তা-ই করেন। কিন্তু প্রেসিডেন্ট হওয়ার পরও তিনি সবার হতে পারেননি; অনুগতদের প্রতি অতিমাত্রায় পক্ষপাতিত্ব প্রদর্শন করে যাচ্ছিলেন এবং যারাই তার সমালোচনা করেছেন, এমনকি তারা নিজের দলের কংগ্রেসম্যান হলেও, তাদের বিরুদ্ধে সেই অনুগত গোষ্ঠীকে খেপিয়ে তুলেছেন। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের প্রাথমিক ধাপের প্রচার মৌসুম শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সবচেয়ে সম্ভাব্য চূড়ান্ত প্রার্থী হিসেবে যে দুজনের কথা মনে করা হচ্ছে, তাদের একজন জো বাইডেন এবং অন্যজন হলেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। অর্থাৎ এই দুজন আবার প্রতিদ্বন্দ্বিতায় মুখোমুখি হবেন। ২০২০ সালের নির্বাচনী নকশা অবলম্বনে বিচার করা হলে, বাইডেনই জয়ী হবেন বলে মনে হয়। কিন্তু আমেরিকার রাজনীতির ভবিষ্যৎ নিয়ে আগেভাগে নিশ্চিতভাবে কিছু বলা যায় না। দুই নেতার স্বাস্থ্যগত, আইনি অথবা অর্থনৈতিক অবস্থা ঘিরে ঘটা যেকোনো চমকে দেওয়া ঘটনা যেকোনো সময় দৃশ্যপট বদলে দিতে পারে।

তবে ট্রাম্প যদি সত্যি সত্যি হোয়াইট হাউজে ফিরে আসেন, তাহলে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতি কী হবেÑ এই প্রশ্নের উত্তর দেওয়া খুবই কঠিন। কারণ, ট্রাম্প নিজেই অনিশ্চিত মেজাজের লোক এবং তার মতিগতি নিয়ে আগেভাগে কিছু বলা সম্ভব নয়। তার প্রথম রাজনৈতিক কার্যালয়ই ছিল প্রেসিডেন্টের কার্যালয় এবং তার রাজনৈতিক আচরণও ছিল অত্যন্ত অপ্রচলিত। কম বেশি সবারই জানা, মার্কিন প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সন আইন লঙ্ঘন করে কিছু পদক্ষেপ নিয়েছিলেন বলে অভিযোগ ওঠার পর ১৯৭৭ সালে তৎকালীন ব্রিটিশ টিভি উপস্থাপক ডেভিড ফ্রস্টকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে তিনি এ বিষয়ে নিজের অবস্থান ব্যাখ্যা করেছিলেন।

প্রেসিডেন্ট জাতীয় স্বার্থে কোনো বেআইনি সিদ্ধান্ত নিতে পারেন কি না এমন প্রশ্নের জবাবে নিক্সন বলেছিলেন, প্রেসিডেন্ট যখন এটি করেন, তখন তা আর বেআইনি থাকে না। ডেভিড ফ্রস্ট তখন তাকে প্রশ্ন করেছিলেন, এটা কি আনুষ্ঠানিক সংজ্ঞার মধ্যে পড়বে? নিক্সনের জবাব ছিল, অবশ্যই। তার সেই বক্তব্য এটিও ব্যাখ্যা করতে সাহায্য করেছিল যে, কীভাবে তিনি আমেরিকান গণতন্ত্রের বিরুদ্ধে করা ষড়যন্ত্রকে বৈধ হিসেবে দেখতে অভ্যস্ত ছিলেন। দুঃখজনক হলেও সত্য, তখন নিক্সনের কোনো বিচার হয়নি। গদি থেকে সরে যাওয়ার পর তার বিরুদ্ধে চলা একটি ফৌজদারি তদন্ত প্রাথমিক পর্যায় অতিক্রম করার আগেই প্রেসিডেন্ট জেরাল্ড ফোর্ড তাকে ক্ষমা করে দিয়েছিলেন।

মার্কিন রাজনীতিকরা মনে করেন, জেরাল্ডের এই ক্ষমা যুক্তরাষ্ট্রকে তার নিজের প্রেসিডেন্টের বিরুদ্ধে মামলা করার মতো বিব্রতকর অবস্থা থেকে বাঁচিয়েছিল। কিন্তু ডোনাল্ড ট্রাম্প দ্রুত ধারাবাহিকভাবে চার চারটি মামলায় অভিযুক্ত হয়ে রীতিমতো ইতিহাস গড়ে ফেলেছেন। লক্ষ করার বিষয় হলো, এই চার অভিযোগের একটিও প্রেসিডেন্ট হিসেবে ট্রাম্পের আনুষ্ঠানিক দায়িত্বের সঙ্গে সরাসরি সম্পর্কিত নয়। মার্কিন কিংবা আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘন করে কোনোখানে ড্রোন হামলা চালানোর নির্দেশ দেওয়ায় তার বিচার হচ্ছে না। কোথাও নিষেধাজ্ঞা দিয়ে সাধারণ মানুষকে দুর্দশায় ফেলে দেওয়ার জন্য তার বিচার হচ্ছে না। কিংবা ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কির সঙ্গে কুৎসিত আলাপচারিতার জন্যও তাকে বিচারের মুখোমুখি হতে হচ্ছে না। বরং ২০২০ সালের নির্বাচনের ফলকে নস্যাৎ করার চেষ্টা, গোপন নথি সরানো এবং নির্বাচনী প্রচারণাবিধি লঙ্ঘন করে এক নারীকে উৎকোচ দেওয়ার অভিযোগে তার বিচার হচ্ছে।

একজন সাবেক নেতাকে আইনের আওতায় আনা আপাতত কূটনৈতিকভাবে আমেরিকার জন্য বিব্রতকর হতে পারে। তবে এটি যুক্তরাষ্ট্রকে আইনের শাসনের প্রতি ন্যায়নিষ্ঠ ও নিবেদিত রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করবে। এই বিচার করতে যুক্তরাষ্ট্র ব্যর্থ হলে সেটি তাৎক্ষণিক মেয়াদে মার্কিনিদের মুখরক্ষা করবে বটে; কিন্তু প্রজাতন্ত্রের ভাবমূর্তির জন্য একটি ধ্বংসাত্মক আঘাতের প্রতিনিধিত্ব করবে। বিশ্বজুড়ে কার্যকর গণতন্ত্রগুলো প্রায়ই তাদের সাবেক নেতাদের এবং এমনকি গদিতে থাকা ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে মামলা করে। অবশ্য তাদের মধ্যে খুব কম লোকই জেল খেটেছেন। বিচারিক প্রক্রিয়ায় তাদের আইনের কাঠগড়ায় দাঁড় করালেও শেষ পর্যন্ত জাতীয় ঐক্যের স্বার্থে তাদের ক্ষমা করা হয় এবং কেউ কেউ কম শাস্তি পান। নিক্সনের মতো তাদের গদি থেকে সরিয়ে দেওয়া যেতে পারে। কিন্তু জেলে রাখা দুরূহ ব্যাপার। যুক্তরাষ্ট্রে ট্রাম্প এখনো রিপাবলিকান পার্টির অতুলনীয় নেতা এবং দক্ষিণপন্থি অনেকের কাছে ত্রাণকর্তা। ট্রাম্পের সমর্থকদের একটি বড় অংশ মনে করেন, ট্রাম্প যা করেছেন তা একদম ঠিক ছিল এবং যুক্তরাষ্ট্রের বৃহত্তর স্বার্থেই তিনি তা করেছেন।

পর্নো তারকা স্টর্মি ড্যানিয়েলসকে মুখ বন্ধ রাখার জন্য উৎকোচ দেওয়ার মামলায় নিউ ইয়র্কের গ্র্যান্ড জুরি ডোনাল্ড ট্রাম্পের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠনের পর তারা হয়তো স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলছেন। নিশ্চিত করে বলা যায় ফ্রান্স, তাইওয়ান ও দক্ষিণ কোরিয়ার মতো গণতান্ত্রিক দেশ তাদের সাবেক রাষ্ট্রপ্রধানদের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করেছে, এমনকি সাজাও দিয়েছে। ট্রাম্প ও তার সমর্থকরা এই মামলার গুরুত্বকে খাটো করে দেখছেন। ট্রাম্পের সঙ্গে যৌন সংসর্গ হওয়ার কথা চেপে যাওয়ার জন্য ২০১৬ সালে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের প্রচারণার সময় পর্নো তারকা স্টর্মি ড্যানিয়েলসকে ট্রাম্প অর্থ দিয়েছিলেন এবং সেই অর্থ মাইকেল কোহেন নামের এক আইনজীবীর মাধ্যমে স্টর্মিকে দেওয়া হয়েছিল বলে ২০১৮ সালে একটি আদালতে প্রমাণিত হয়েছিল। মামলায় মাইকেল কোহেনের তিন বছরের জেল হয়। এই অভিযুক্তির কারণে ট্রাম্প ভবিষ্যতে নির্বাচিত কোনো প্রেসিডেন্টের কাছেই ক্ষমা পাবেন না। তিনি যদি প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন, তাহলেই নিজেকে ক্ষমা করতে পারবেন।

সাবেক মডেল কারেন ম্যাকডুগালের মতো অনেকেরই ধারণা, এ ঘটনায় ট্রাম্প নারী ভোটারদের কাছে অজনপ্রিয় হবেন। যে সপ্তাহে ট্রাম্পের অভিযুক্তি এবং টোলেডোর প্রত্যর্পণ চূড়ান্তকারী রায় ঘোষণা হয়েছে, সেই একই সপ্তাহে পেরুর কৌঁসুলিরা ঘোষণা করেছেন, তারা ভাবী প্রেসিডেন্ট দিনা বোলুয়ার্তে এবং সাবেক প্রেসিডেন্ট পেদরো কাস্তিলোর বিরুদ্ধে ২০২১ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের প্রচার ব্যয়বিধি লঙ্ঘনের অভিযোগ তদন্ত করে দেখবেন।

১৯৯০ থেকে এ পর্যন্ত পেরুতে যতজন প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছেন, তার মধ্যে ছয়জন আছেন যাদের কেউ হয় জেলে আছেন, নয়তো কেউ জেলে যাওয়ার অবস্থায় আছেন, কেউবা আটকাদেশ মাথায় নিয়ে আছেন। টোলেডোর প্রত্যর্পণাদেশের চূড়ান্ত রায় হওয়ার আগমুহূর্ত পর্যন্ত পেরুর অনেক মানুষ ধারণা করছিলেন, টোলেডোকে যুক্তরাষ্ট্র রক্ষা করবে। ঠিক একইভাবে অনেক আমেরিকানেরও বিশ্বাস ছিল, ট্রাম্পের কখনো বিচার হবে না। ট্রাম্প এবং টোলেডো মামলাকে ভিন্ন খাতে নেওয়ার জন্য একই ধরনের কৌশল নিয়েছেন। তারা দুজনই দাবি করেছেন, রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে তাদের বিরুদ্ধে এসব অভিযোগ আনা হচ্ছে এবং তাদের বিরুদ্ধে বিচার বিভাগকে অস্ত্র বানানো হচ্ছে। ট্রাম্পের সমর্থকরা বলছেন, আদালতের এ রায় প্রমাণ করে, যুক্তরাষ্ট্র এখন বানানা রিপাবলিক।

কর্র্তৃত্ববাদী শাসকদের প্রশংসাকারী থেকে ট্রাম্প ২০২৪ সালের নির্বাচনে প্রেসিডেন্ট হিসেবে দাঁড়াচ্ছেন। বিশ্বের কাছে এখন এই বার্তা স্পষ্ট যে, ট্রাম্প আবার নির্বাচিত হলে বিশ্বব্যাপী গণতন্ত্রের জন্য মহাদুর্যোগ বয়ে আনবে। স্থানীয়ভাবে গজিয়ে ওঠা উগ্রবাদ, ষড়যন্ত্রতত্ত্ব এবং ঘৃণাসূচক ভাষা ব্যবহারের আধিক্য যুক্তরাষ্ট্রের গণতন্ত্রকে ভয়ানক বিপদে ফেলে দিয়েছে। রিপাবলিকান পার্টি দিন দিন ক্রিশ্চিয়ান জাতীয়তাবাদের দিকে ঝুঁকছে। প্রতি পাঁচজন রিপাবলিকানের মধ্যে একজন এবং ডেমোক্র্যাটদের ১৩ শতাংশ সমর্থক বিশ্বাস করেন ‘আজকের দিনে’ রাজনৈতিক সহিংসতা ন্যায্য। কিন্তু ট্রাম্পের ওই গ্রেপ্তার হওয়াকে একদিন গণতন্ত্রের বাঁকবদল হিসেবে স্মরণ করা হবে। সবচেয়ে বড় কথা, পেরু এবং যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্টদের বিচারিক প্রক্রিয়ার সামনে দাঁড় করানোর ঘটনা আমাদের দেখাচ্ছে, আইনের শাসন বজায় রাখার এবং ক্ষমতাবানদের জবাবদিহি করার ক্ষমতাই গণতন্ত্রকে স্বৈরতন্ত্র থেকে আলাদা করে রাখে।

লেখক: গবেষক ও কলাম লেখক

raihan567@yahoo.com

Please Share This Post in Your Social Media

© All rights reserved © 2023
Developed by : JM IT SOLUTION