শুক্রবার, ১৪ ফেব্রুয়ারী ২০২৫, ০২:২৫ অপরাহ্ন
আবদুল আজিজ:
টানা কয়েক বছর ধরে বিদেশী পর্যটকের খরা লেগে আছে কক্সবাজারে। তাই বিদেশী পর্যটক টানতে চলছে মহা কর্মযজ্ঞ। সরকারের মহাপরিকল্পনার অংশ হিসাবে মালদ্বীপের আদলে ঢেলে সাজানো হচ্ছে কক্সবাজারের প্রতিটি পর্যটন স্পটগুলোকে। মাষ্টারপ্লানের মাধ্যমে বাস্তবায়ন করা হচ্ছে নতুন নতুন মেগাপ্রকল্প। এতে করে আগামীতে গড়ে উঠছে একটি আধুনিক কক্সবাজার। প্রকল্পগুলো সম্পূর্ণ বাস্তবায়ন হলে আসবে বিদেশী পর্যটক। অর্জিত হবে বৈদেশিকমুদ্রা, বিকশিত হবে পর্যটন শিল্প।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, কক্সবাজার বিমানবন্দরকে আন্তর্জাতিক মানের উন্নয়ন, চট্টগ্রামের দোহাজারি থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত রেললাইন নির্মাণ, সোনাদিয়াকে বিশেষ পর্যটন এলাকা হিসেবে গড়ে তোলা, ইনানি সৈকতের উন্নয়ন, টেকনাফের সাবরায়েং ইকো ট্যুরিজম পার্ক নির্মাণ, শামলাপুর সৈকতের উন্নয়ন, চকরিয়ায় মিনি সুন্দরবনে পর্যটকদের গমনের জন্য যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন, ডুলাহাজরা সাফারি পার্কের আধুনিকায়নসহ ২৫ ধরনের প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে সরকার। তার’ই অংশ হিসেবে সেন্টমার্টিনকে সাজানো হচ্ছে মালদ্বীপের আদলে। ভ্রমণের জন্য সেন্টমার্টিনে নামবে সি-প্লেনের। কক্সবাজার টু মহেশখালী ও টেকনাফ চলবে ক্যাবল কার। এছাড়াও রয়েছে নানা উন্নয়নমূলক কর্মকান্ড। ব্যাপক এই কার্যক্রম বাস্তবায়ন হলে পাল্টে যাবে কক্সবাজারের পর্যটন খাত।
কক্সবাজার আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর:
দেশের প্রথম সমুদ্রবক্ষের ওপর নির্মিতব্য কক্সবাজার আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের রানওয়ের নির্মাণের কাজ শেষ পর্যায়ে। চলতি বছরে শেষের দিকে আন্তর্জাতিকভাবে বিমান উঠা-নামা করবে। সমুদ্রের জলে গড়ে উঠা রানওয়ের নির্মাণ ব্যয় ধরা হয়েছে ১ হাজার ৯০০ কোটি টাকা, যার পুরোটাই অর্থায়ন করছে বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ (বেবিচক)। ২০২১ সালের ২৮ আগস্ট ‘কক্সবাজার বিমানবন্দর রানওয়ে সমুদ্রে সম্প্রসারণ প্রকল্পে’র উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সমুদ্রগর্ভে ৪৩ হেক্টর ভূমি পুনরুদ্ধার করে (ভরাটের মাধ্যমে) রানওয়ে বর্ধিত করা হচ্ছে। এতে এই রানওয়ের দৈর্ঘ্য দাঁড়াবে ১০ হাজার ৭০০ ফুট, যা হবে দেশের সর্ববৃহৎ রানওয়ে।
সাবরাং ইকো ট্যুরিজম পার্ক:
কক্সবাজারের টেকনাফে গড়ে উঠছে দেশের প্রথম পর্যটন নির্ভর অঞ্চল সাবরাং ইকো ট্যুরিজম পার্ক। পরিকল্পিত এই আধুনিক মানের পার্কটি জীব-বৈচিত্র সংরক্ষন করেই দ্বীপটিতে করা হচ্ছে। দেশীয় সংস্কৃতি ও কৃষ্টিকে অগ্রাধিকার দিয়েই সাবরাং ট্যুরিজম পার্ক নির্মান করা হচ্ছে। দ্বীপটির মাত্র ৩০ শতাংশ জায়গায় গড়ে উঠছে পার্ক ও হোটেল। ৩০ একর জায়গায় করা হচ্ছে শপিং সেন্টার, মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর, এম পি থিয়েটার ও কনভেনশন হল, এমিউজমেন্ট পার্ক। ২০ একর জায়গায় হচ্ছে প্রশাসনিক ভবন, হাসপাতাল, ফায়ার সার্ভিস এবং দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কেন্দ্র। ২৬ একর জায়গায় পয়ঃবর্জ্য পরিশোধন প্লান্ট, কঠিন বর্জ্য ও ই বর্জ্য পরিশোধন প্লান্ট, পাওয়ার প্লান্ট, বৈদ্যুতিক সাব-স্টেশন, পানি পরিশোধন ও সংরক্ষনাগার, সোলার প্লান্ট এবং বায়োগ্যাস প্লান্ট করা হচ্ছে। ১৩ একর জায়গায় ওয়েলফেয়ার সেন্টার, ৮ একর জায়গায় বাস ডিপো, ট্রান্সপোর্টেশন হাব, হ্যালি প্যাড এবং জেটি স্থাপন করা হবে। ৫৪ একর জায়গায় রাস্তা হাটা পথ এবং বাইসাইকেল লেনের জন্য রাখা হবে। ৫২৮ একর জায়গায় ঝাউগাছ লাগিয়ে দৃষ্টিনন্দন করা হয়েছে। আগামী ৫ বছরে সাবরাং ইকো ট্যুরিজম পার্কটি নির্মিত হলে দেশি বিদেশি পর্যটকদের সবধরনের চাহিদা পূরন করবে।
জালিয়ার দ্বীপ এক্সক্লুসিভ “নাফ ট্যুরিজম পার্ক:
কক্সবাজারে টেকনাফের নাফনদীর বুকে জেগে উঠা জালিয়ারদ্বীপ গড়ে উঠছে এক্সক্লুসিভ নাফ ট্যুরিজম পার্ক। ট্যুরিজম পার্কটি বিদেশি পর্যটকদের নিকট আকর্ষনীয় করে তোলার জন্য কেবল কার, প্যারা সেইলিং, স্কুবা ডাইভিং, সি-ক্রুসিং সহ অত্যাধুনিক সুযোগ সুবিধা রয়েছে। ইতোমধ্যে বেজা কর্তৃক মাটি ভরাটসহ অন্যান্য উন্নয়ন কার্যক্রম বাস্তবায়নের জন্য কাজ চলছে। নাফ নদী ক্রসিং করে ২ মেগাওয়ার্ড লোড সরবরাহের জন্য ১১ কেভি সাবমেরিন ক্যাবল লাইন নির্মানের ড্রইং, ডিজাইন ও বিওকিউ বাপবিবো বরাবর প্রেরণ করা হয়েছে।’
চট্টগ্রাম-কক্সবাজার রেললাইন প্রকল্প:
কক্সবাজারের সাথে সারা দেশের যোগাযোগ ব্যবস্থা উন্নত করতে কক্সবাজার, চট্টগ্রাম ও ঢাকা মহাসড়ককে চারলেইন করার পাশাপাশি নির্মাণ করা হচ্ছে রেললাইন। ইতিমধ্যে কক্সবাজারে আন্তর্জাতিকমানের রেলষ্টেশন নির্মাণের কাজ শেষ হয়েছে। অক্টোবরের যেকোন সময়ে পরিক্ষামুলক রেল চলাচল শুরু হচ্ছে। ১০০ কিলোমিটার রেললাইনের মধ্যে ইতোমধ্যে ৯৫ কিলোমিটারের কাজ শেষ হয়েছে। বাকি পাঁচ কিলোমিটার রেললাইন অক্টোবরের প্রথম সপ্তাহের মধ্যে শেষ হবে। ইতোমধ্যে পরীক্ষামূলক ট্রেন চলাচলের জন্য পটিয়া স্টেশনে প্রস্তুত রাখা হয়েছে ছয়টি বগি ও দুই হাজার ২০০ সিরিজের একটি ইঞ্জিন। ধারণা করা হচ্ছে, আগামী ২৮ অক্টোবর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দোহাজারী-কক্সবাজার রেললাইন প্রকল্পটি উদ্বোধন করবেন।
ট্যুর অপারেটর এসোসিয়েশন অব কক্সবাজার (টুয়াক) এর সভাপতি তোফায়েল আহমেদ কক্সবাজার ভয়েসকে বলেন, ‘ উন্নয়নের নানা কার্যক্রমের মাঝে যুক্ত হওয়া সি-প্লেন ও ক্যাবল কার কক্সবাজারকে বিশ^বাসীর কাছে আরো বেশি গ্রহণযোগ্য করে তুলবে। সাথে পর্যটন সেবার মানও উন্নত হবে। কক্সবাজারে অন্যান্য মেগা প্রকল্পের পাশাপাশি পর্যটন খাতে ব্যাপক উন্নয়নের খবরে সন্তুুষ্ট আমরা। এসব কাজ বাস্তবায়ন হলে পর্যটন সেবায় যুক্ত হবে ভিন্ন এক মাত্রা।’
কক্সবাজার উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (কউক) চেয়ারম্যান কমোডর মোহাম্মদ নুরুল আবছার কক্সবাজার ভয়েসকে বলেন, ‘কক্সবাজারে পর্যটন খাতে ব্যাপক কার্যক্রম অব্যাহত রয়েছে। এতে যুক্ত হচ্ছে সেন্টমার্টিন ভ্রমনে সি-প্লেন ও কক্সবাজার টু মহেশখালী এবং টেকনাফে ক্যাবল কার স্থাপনের পরিকল্পনা। এরই মধ্যে মালদ্বীপের রিসোর্ট গ্রুপের সাথে যোগাযোগ চলছে। তাদের কাছ থেকে কারিগরি পরার্মশ নিয়ে চলবে কার্যক্রম। এতে সারাবছর সেন্টমার্টিন যেতে পারবে পর্যটক। এছাড়াও রয়েছে সাবরাং ট্যুরিজম পার্কে বিশাল আন্ডার সি অ্যাকুরিয়াম, সার্কুলার বাস টার্মিনাল, মেরিনা বে-রিসোর্ট, খুরুশকুল স্মার্ট সিটি, থিম পার্ক, ইকো রিসোর্ট, চৌফলদন্ডীতে রিভাররেইন ট্যুরিজম।’
কক্সবাজার জেলা প্রশাসক মুহম্মদ শাহীন ইমরান কক্সবাজার ভয়েসকে বলেন, ‘পরিবেশকে গুরুত্ব দিয়ে পর্যটন খাতে সরকারের ব্যাপক উন্নয়নের কাজ চলছে। বিশেষ করে বিদেশী পর্যটক টানতে এসব কাজ চলছে। ইতিমধ্যে অনেক কিছুর পরিবর্তন হয়েছে এবং মেগা প্রকল্পসহ অনেক প্রকল্প চলমান রয়েছে। কয়েক বছরের মধ্যে হাতে নেয়া উন্নয়ন প্রকল্পগুলো শেষ হলে বিশ্বেও দরবারে মাথা উচু করে দাড়াবে কক্সবাজার।
ভয়েস/আআ