মঙ্গলবার, ০৫ ডিসেম্বর ২০২৩, ০৭:০৯ অপরাহ্ন
মুফতি এনায়েতুল্লাহ:
জীবন চলার পথে মানুষ সগিরা-কবিরাসহ (ছোট-বড়) অসংখ্য পাপকাজে লিপ্ত হয়। কখনো ইচ্ছায় আবার কখনো অনিচ্ছায়। সগিরা গোনাহ আল্লাহতায়ালা বিভিন্নভাবে ক্ষমা করলেও কবিরা গোনাহ তওবা ছাড়া ক্ষমা করেন না। আবার তওবা করার পর পুনরায় সেই অপরাধ করলে তাদের তওবাও কবুল হয় না। ইরশাদ হয়েছে, ‘সেসব লোক তাদের দ্বারা যখনই কোনো অশ্লীল কাজ সংঘটিত হয় অথবা তারা যখন কোনো গোনাহ করে অথবা তারা যদি নিজেদের ওপর জুলুম করে বসে, (সঙ্গে সঙ্গেই) তারা আল্লাহর কথা স্মরণ করে এবং নিজেদের গোনাহের জন্য তার কাছে মাফ চায়; কারণ আল্লাহ ছাড়া গোনাহ মাফ করতে পারে এমন কে আছে? অতঃপর জেনে-বুঝে তারা আর এসব গোনাহের কাজে অটল থাকে না। এই হচ্ছে (সেই বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত লোকদের) ফলাফল তাদের মালিকের পক্ষ থেকে প্রতিদান, তিনি তাদের ক্ষমা করে দেবেন আর এমন জান্নাতে দাখিল করাবেন যার তলদেশে ঝরনাধারা প্রবহমান। সেখানে তারা চিরদিন থাকবে। সৎকর্মশীল লোকদের জন্য কত সুন্দর প্রতিদান তিনি রেখে দিয়েছেন।’ -সুরা আলে ইমরান : ১৩৫-১৩৬
শরিয়তের বিধানে শিরক এমন এক পাপ, যা আল্লাহ কখনই ক্ষমা করেন না। আল্লাহতায়ালার ঘোষণা, ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ তার সঙ্গে কাউকে শরিক করার গোনাহ ক্ষমা করেন না। এ ছাড়া অন্য সব গোনাহ তিনি যাকে ইচ্ছা ক্ষমা করে দেবেন।’ -সুরা নিসা : ৪৮
শিরকের অপরাধ কতটা ভয়াবহ, সে সম্বন্ধে কোরআন মাজিদে অনেক আয়াত রয়েছে। শিরককারীদের কোনো আমল গ্রহণ করা হবে না মর্মে আল্লাহতায়ালা বলেছেন, ‘আর তারা যদি শিরক করত, তারা যা আমল করেছিল তা অবশ্যই বরবাদ হয়ে যেত।’ -সুরা আনআম : ৮৮
শিরককারীর সঙ্গে দয়াময় আল্লাহ ও ইসলামের দূরত্ব কত বেশি তা নিম্নের আয়াত থেকে অনুধাবন করা যায়। ‘আর যে ব্যক্তি আল্লাহর সঙ্গে (অন্য কাউকে) শরিক করে, তার অবস্থা হচ্ছে- সে যেন আকাশ থেকে ছিটকে পড়ল অতঃপর (মাঝপথে) কোনো মৃতভোজী প্রাণী এসে তাকে ছোঁ মেরে নিয়ে গেল অথবা (জমিনে পড়ার আগেই) বাতাস তাকে উড়িয়ে নিয়ে (অজ্ঞাত কোনো) দূরবর্তী স্থানে নিক্ষেপ করল।’ -সুরা হজ : ৩১
কেয়ামতের দিন হাশরের ময়দানে আল্লাহতায়ালা জান্নাতবাসীদের ডেকে বলবেন, হে জান্নাতি বান্দারা! দুনিয়ায় তোমাদের জন্য যা যা ওয়াদা করা হয়েছে তা ঠিকমতো পেয়েছ? জান্নাতিরা বলবে, জি পেয়েছি, আর কিছু বাকি নেই। আল্লাহ বলবেন, না সব কিছু পাওনি। যে আল্লাহকে না দেখে ইমান এনেছে, রাত জেগে তাহাজ্জুদের নামাজ পড়েছে, আল্লাহর জমিনে তার দীন বিজয়ের সংগ্রামে শহীদ হয়েছে সেই আল্লাহকে এখনো তারা দেখেনি। আল্লাহতায়ালা সেদিন জান্নাতিদের সামনে এসে হাজির হবেন। জান্নাতিরা সেদিন আল্লাহর অপরূপ সৌন্দর্যের দিকে তাকিয়ে থাকবে আর এভাবে কত কাল কেটে যাবে আল্লাহ ছাড়া কেউ জানে না। সেদিন সেই সুবর্ণ সুযোগ থেকে কেবল তারাই বঞ্চিত হবে যারা দুনিয়ায় আল্লাহর সঙ্গে অন্য কাউকে শরিক করবে। ইরশাদ হয়েছে, ‘অতএব যে ব্যক্তি তার পালনকর্তার সাক্ষাৎ কামনা করে, সে জন্য বেশি বেশি নেক আমল করে এবং তার পালনকর্তার ইবাদতে অন্য কাউকে শরিক না করে।’ -সুরা কাহাফ : ১১০
ইবনে কাসিরে বলা হয়েছে, এই সুবিশাল আসমান ও জমিনের মালিক আল্লাহতায়ালা আফসোস করে বলেন, বান্দা কেমন করে তার সঙ্গে শরিক করে? তিনি মানুষের বসবাসের জন্য জমিনকে বিছানা বানিয়েছেন আর আসমানকে ছাদস্বরূপ সৃষ্টি করেছেন। শুধু তাই নয়, তোমাদের জীবিকার জন্য আকাশ থেকে পানি বর্ষণ করে তার দ্বারা ফলমূল উৎপাদনের ব্যবস্থা করেছেন। আল্লাহর এই কুদরতি ব্যবস্থাপনায় জেনেশুনে কেমনে তার শরিক করো? আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘হে মানব সম্প্রদায়! তোমরা তোমাদের সেই প্রতিপালকের উপাসনা করো যিনি তোমাদের ও তোমাদের পূর্ববর্তীদের সৃষ্টি করেছেন যাতে তোমরা পরহেজগার ও ধর্মভীরু হতে পারো। যিনি তোমাদের জন্য জমিনকে বিছানা বানিয়েছেন ও আকাশকে ছাদস্বরূপ সৃষ্টি করেছেন এবং আসমান থেকে বৃষ্টি বর্ষণপূর্বক তোমাদের জীবিকার জন্য ফল-ফলাদি উৎপাদন করেছেন। সুতরাং জেনেশুনে কাউকে আল্লাহর সমকক্ষ স্থির কোরো না।’ -সুরা বাকারা : ২১-২২
সুরা আনআমের ১৫১ নম্বর আয়াতে আল্লাহতায়ালা বিশ্ববাসীর জন্য ৫টি অধ্যাদেশ জারি করেছেন, তার মধ্যে প্রথম দফা হলো- শিরক। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘হে মুহাম্মাদ! তাদের বলে এসো আমি তোমাদের শুনাই তোমাদের রব তোমাদের ওপর কী বিধিনিষেধ আরোপ করেছেন। ১. তার সঙ্গে অন্য কাউকে শরিক কোরো না, ২. পিতা-মাতার সঙ্গে সদ্ব্যবহার করো, ৩. দারিদ্র্যের ভয়ে নিজের সন্তানদের হত্যা কোরো না, আমি তোমাদের জীবিকা দিচ্ছি এবং তাদেরও দেব, ৪. প্রকাশ্যে বা গোপনে অশ্লীল বিষয়ের ধারেকাছেও যেয়ো না এবং ৫. আল্লাহতায়ালা যে প্রাণকে মর্যাদা দান করেছেন সংগত কারণ ছাড়া তাকে ধ্বংস কোরো না।
দুনিয়ার জীবনে মহান আল্লাহ তার গাফুরুর রহিম নামের খাতিরে পাহাড় পরিমাণ গোনাহ করা সত্ত্বেও অসংখ্য বান্দাকে ক্ষমা করলেও মুশরিককে ক্ষমা করবেন না। হজরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, আল্লাহ বলেন- হে আদম সন্তান! যদি জমিন ভর্তি গোনাহ নিয়ে আমার সামনে সাক্ষাৎ করো, তবে আমি পৃথিবী পরিমাণ ক্ষমা নিয়ে তোমার সাক্ষাৎ করব এই শর্তে যে, তুমি কোনো কিছুকে আমার সঙ্গে অংশীদার স্থাপন করবে না।’ -মুসনাদ আহমেদ : ২১৪৭২
শরিয়তের পরিভাষায় তাওহিদের অর্থ মহান আল্লাহকে তার সুমহান জাত বা সত্তা, তার সিফাত বা গুণাবলি, অধিকার বা কর্র্তৃত্ব এবং এখতিয়ারের ক্ষেত্রে একক ও অদ্বিতীয় হিসেবে স্বীকৃতি প্রদান করা। তাওহিদের বিপরীত শিরক। তাই কালেমা পড়ে মুসলমান হওয়া সত্ত্বেও কোনো ব্যক্তি যদি আল্লাহ ছাড়া অন্য কারও ইবাদত করে, আল্লাহর সিদ্ধান্তের তোয়াক্কা না করে নিজের যাবতীয় বিষয়ে নিজেই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে- তবে সে অবশ্যই মুশরিক বলে পরিগণিত হবে। আল্লাহতায়ালা সবাইকে শিরকমুক্ত জীবন গঠনের তওফিক দান করুন।
লেখক : শিক্ষক ও ইসলামবিষয়ক গবেষক
muftianaet@gmail.com