রবিবার, ২৯ Jun ২০২৫, ০৫:২৩ অপরাহ্ন

দৃষ্টি দিন:
সম্মানিত পাঠক, আপনাদের স্বাগত জানাচ্ছি। প্রতিমুহূর্তের সংবাদ জানতে ভিজিট করুন -www.coxsbazarvoice.com, আর নতুন নতুন ভিডিও পেতে সাবস্ক্রাইব করুন আমাদের ইউটিউব চ্যানেল Cox's Bazar Voice. ফেসবুক পেজে লাইক দিয়ে শেয়ার করুন এবং কমেন্ট করুন। ধন্যবাদ।

কোনদিকে যাচ্ছে মিয়ানমার

শাহাদাৎ হোসাইন:
বাংলাদেশ ভৌগোলিক, রাজনৈতিক, ঐতিহাসিক ও সাংস্কৃতিকভাবে দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম দেশ। বাংলাদেশের দুটি দেশের সঙ্গে সীমান্ত রয়েছে। একটি দক্ষিণ এশিয়ার ভারত, আরেকটি দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশ মিয়ানমার। ফলে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার রাজনীতি বিশেষ করে মিয়ানমারে কী হচ্ছে বাংলাদেশ তা এড়িয়ে যেতে পারে না। মিয়ানমারকে বাংলাদেশে সাধারণ মানুষের অনেকে এখনো আগের নাম ‘বার্মা’ নামেই উচ্চারণ করে। বাংলাদেশের যে চট্টগ্রামের সঙ্গে মিয়ানমারের সীমান্ত রয়েছে সেই চট্টগ্রামে একটি প্রবাদ রয়েছে ‘মগ কাটা’ যার অর্থ বুঝায় নির্বিচারে হত্যা করা বা ধ্বংস করা। মূলত রোহিঙ্গাদের ওপর যুগের পর যুগ ধরে চলা গণহত্যাকে ইঙ্গিত করে এই প্রবাদের প্রচলন। ভৌগোলিক নৈকট্যের কারণে টেকনাফ সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশ-মিয়ানমারের সঙ্গে ঐতিহাসিক বাণিজ্য সম্পর্ক রয়েছে। আশির দশকেও চট্টগ্রামের অনেকে আরাকান এমনকি রেঙ্গুনে ব্যবসার কাজে যেতেন। মিয়ানমারের সঙ্গে সুম্পর্ক বাংলাদেশের জন্য অমিত সম্ভাবনার পূর্ব দুয়ার খুলে যেতে পারে। বাংলাদেশের উৎপাদিত পণ্য চলে যেতে পারে রেঙ্গুন, ব্যাংকক, কুয়ালালামপুর, সিঙ্গাপুর। কিন্তু সম্ভাবনা যতই উজ্জ্বলতর বাস্তবতা ততই কঠিন। ভূ-রাজনৈতিক পরিস্থিতি, রোহিঙ্গা সংকট এবং মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক পটভূমি সে সম্ভাবনাকে দমিয়ে রেখেছে। ফলে দোহাজারী-কক্সবাজার রেললাইন রামু থেকে মিয়ানমার সীমান্তে যেতে পারল না।

মিয়ানমারকে বলা যায় দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সবচেয়ে ‘বেয়াড়া’ কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ দেশ। দেশটিতে কদিন পর পর সামরিক বাহিনীর ক্ষমতা দখল ও বিভিন্ন প্রদেশের গেরিলা যুদ্ধের খবর নতুন নয়। তবে এবারের পরিস্থিতি ও সংকট কিছুটা জটিল। আপাত দৃষ্টিতে মনে হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র, চীন ও ভারতের নানা চাওয়া-পাওয়ার সমীকরণ দেশটিকে একটি জটিলতায় নিয়ে গেছে। মিয়ানমার ও পাকিস্তান রাষ্ট্র দুটি সৃষ্টির পর থেকে সেনাবাহিনী প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে দেশের পলিসি নিয়ন্ত্রণ করে। ২০২১ সালে সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে অং সান সু চির নির্বাচিত সরকারকে উৎখাত করে ক্ষমতা গ্রহণ করে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী। সেই থেকে সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে বিভিন্ন প্রদেশে সক্রিয় গেরিলারা যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছে। সামরিক জান্তার বিরুদ্ধে কাচিন-কারেন-চিন-রাখাইনদের পাশাপাশি গণতন্ত্রপন্থি সু চি সমর্থকদের একাংশ ‘পিপলস ডিফেন্স ফোর্স’ বা ‘পিডিএফ’ নামে যুক্ত হয়।

যুদ্ধ মিয়ানমারে নতুন নয়। কাচিন, কারেন, শান ও চিন প্রদেশে বহু বছর ধরে গেরিলারা সক্রিয় অধিক স্বায়ত্তশাসনের দাবিতে। বাস্তবতা হলো ভীষণ ক্ষমতাধর মিয়ানমার সেনাবাহিনী এই গেরিলাদের কখনো নিয়ন্ত্রণ করতে পারেনি। গত মাসের ২৭ তারিখ মিয়ানমারের বিভিন্ন গেরিলা বাহিনী একত্র হয়ে যে ‘ব্রাদারহুড অ্যালায়েন্স’ গড়ে তুলে একযোগে মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছে। হামলার দিনকে স্মরণীয় রাখতে তারা অভিযানের নাম দিয়েছে ‘অপারেশন ১০২৭’। ‘অপারেশন ১০২৭’-এ যুক্ত আছে আরাকান আর্মি, মিয়ানমার ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক অ্যালায়েন্স আর্মি (এমএনডিএ) এবং তাঙ ন্যাশনাল লিবারেশন আর্মি (টিএনএলএ)। এমএনডিএ যেসব অঞ্চল নিয়ন্ত্রণ করে তার সঙ্গে চীনের ইউনান প্রদেশের সীমান্ত রয়েছে। বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর সমন্বয়ে গঠিত সশস্ত্র এই ‘ব্রাদারহুড অ্যালায়েন্স’ দ্রুত মিয়ানমারের উত্তর দিককার রাজ্য শানের সামরিক ঘাঁটি এবং মিয়ানমারের সঙ্গে চীনের বাণিজ্যপথের উল্লেখযোগ্য অংশ দখল নিয়ে নিয়ন্ত্রণ করছে।

মিয়ানমারের গণতন্ত্রপন্থি অংশটার সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমাদের সম্পর্ক ও প্রভাব থাকলেও মিয়ানমারে সামাজিক, রাজনৈতিক ও সামরিকভাবে একচ্ছত্র প্রভাবশালী দেশ হলো চীন। অং সান সুচিকে গ্রেপ্তার ও গণতন্ত্রপন্থিরা দেশটিতে কোণঠাসা হয়ে যাওয়ার পর হতাশ যুক্তরাষ্ট্র ‘বার্মা অ্যাক্ট’ পাস করে এবং নিষেধাজ্ঞার মাধ্যমে দেশটির সেনাবাহিনীকে নিয়ন্ত্রণ করতে চাইছে। দেশটির গেরিলাদের প্রতি পশ্চিমাদের নৈতিক সমর্থন রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের এই উদ্দেশ্য বুঝতে পেরে চাইনিজরা তাদের পলিসিকে একটু মডিফাই করেছে। তারা এখন শুধু সেনাবাহিনী নয় গেরিলাদেরও আস্থাভাজন দেশ। চীন একদিকে কেন্দ্রীয় সেনাবাহিনীকে যেমন সব উপায়ে সহায়তা দিয়েছে, তেমনি বর্তমান গেরিলা যুদ্ধের অস্ত্রশস্ত্রের উৎসও চীন। মিয়ানমারের বিভিন্ন গেরিলা বাহিনী একত্র হয়ে যে ‘ব্রাদারহুড অ্যালায়েন্স’ গড়ে তুলেছে সেখানে চীনের সবুজ সংকেত ছিল বলে ধারণা করা হয়। অন্যদিকে গেরিলাদের প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাব শুধুমাত্র নৈতিক সমর্থন দেওয়া। এমনকি খ্রিস্টান-অধ্যুষিত কারেন ও চিন প্রদেশেও ইউরোপ-আমেরিকা বেসামরিক সহযোগিতার বাইরে তেমন কিছু করতে পারেনি।

কেন চীনের ইউটার্ন : চীন কেন আকস্মিক অবস্থান বদল করে গেরিলা গোষ্ঠীকে সমর্থন দিচ্ছে তা নিয়ে সচেতন মহলের আগ্রহ রয়েছে। এর কারণ হতে পারে দুটি। এক. ওয়াশিংটনকে মিয়ানমারের বিষয় থেকে দূরে রাখা এবং গেরিলারা যেন কোনোভাবে সার্বিক সহযোগিতার জন্য যুক্তরাষ্ট্র ও ভারতের দিকে ঝুঁকে না পড়ে তা নিশ্চিত করা, অথবা গেরিলাদের বিজয় যেন চীনের হাতছাড়া না হয়। দুই. সেনাবাহিনীকে চাপে রেখে আরও সুবিধা আদায় ও ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়ন নিয়ে সতর্ক করা।

কোন দিকে যাবে পরিস্থিতি : সেনাবাহিনী থেকে আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়েছে, ‘মিয়ানমার ভেঙে যেতে পারে।’ এই আশঙ্কা যেমন রয়েছে তেমনি আশঙ্কা রয়েছে সেনাবাহিনীর মধ্যে অন্তঃকোন্দল বাড়তে পারে। এমন পরিস্থিতিতে সেনাবাহিনীর তিনটা অপশন হচ্ছে সমাধানের। এক. দেশে চীনবিরোধী মনোভাবকে উসকে দিয়ে চীনের সঙ্গে একটা দর কষাকষিতে আসা। দুই. এনএলডির সঙ্গে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে অং সান সুচিকে মুক্তি দিয়ে সেনাবাহিনী নিয়ন্ত্রিত গণতন্ত্র ফিরিয়ে এনে বিদ্রোহ দমন করা। তিন. সেনাবাহিনীর নেতৃত্বের পরিবর্তন নিয়ে এসে আরও ক্যারিশম্যাটিক কাউকে নেতৃত্বে নিয়ে আসা। দ্বিতীয় অপশনটি হলে মিয়ানমারের ওপর পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞা শিথিল হতে পারে। এতে পশ্চিমা বিনিয়োগও বাড়বে দেশটিতে। ফলে চীন সে অপশনটি আপাতত চাইবে কি না সেটা প্রশ্নসাপেক্ষ। আপাত দৃষ্টিতে প্রথম অপশন মঞ্চায়ন কিছুটা দৃশ্যমান। ইতিমধ্যে রাজধানী নেপিডোতে বৌদ্ধ ভিক্ষুদের চীনবিরোধী বিক্ষোভ দেখা গেছে। তবে সেনাবাহিনীও নিয়ন্ত্রণের বাইরে যাওয়া শহর উদ্ধারে বসে নেই। আরাকান আর্মি অনেক বছর ধরে আমাদের পার্শ্ববর্তী রাজ্য আরাকানে (নতুন নাম রাখাইন) স্বায়ত্তশাসনের দাবিতে থেমে থেমে লড়াই করে যাচ্ছে। সশস্ত্র গোষ্ঠী আরাকান আর্মির (এএ) নিয়ন্ত্রণ থেকে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের পাউকতাও শহরকে মুক্ত করতে সম্প্রতি ব্যাপক হামলা শুরু করেছে জান্তা সরকার। কামানের গোলার পাশাপাশি যুদ্ধবিমান থেকেও হামলা চালানো হচ্ছে।

বেকায়দায় ভারত : বর্তমান ভূ-রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে সবচেয়ে বেকায়দায় মনে হচ্ছে ভারতকে। বার্মিজরা দীর্ঘকাল ধরে আন্তর্জাতিক আইনকানুন তোয়াক্কা করে না। মিয়ানমার দেশ হিসেবে পারস্পরিক কূটনীতিতেও খুব একটি আগ্রহী ও সহযোগী নয়। ভারতীয়রা বহু বছর ধরে উত্তর-পূর্ব অংশ থেকে কলকাতায় যোগাযোগব্যবস্থা তৈরির জন্য যে ‘কালাদান প্রজেক্ট’ নিয়ে কাজ করছে এবং ‘ভারত-মিয়ানমার-থাইল্যান্ড’ মহাসড়কের স্বপ্ন দেখছে তা যথেষ্ট চেষ্টার পরও এখনো আলোর মুখ দেখেনি। মিয়ানমারের বর্তমান পরিস্থিতি ভারতের ‘লুক-ইস্ট’ নীতিকে আরও বড় ধরনের হুমকিতে ফেলেছে। ভারতের সীমান্তবর্তী মিয়ানমারের সবকটি শহর চিন ন্যাশনাল আর্মির দখলে। এসব গেরিলাদের হাতে চাইনিজ অস্ত্র। মিজো-চিন এসব জনগোষ্ঠী কুকি জনগোষ্ঠীকে নিজেদের ‘কাজিন’ হিসেবে ভাবে। আশঙ্কা করা যায় এদের হাতে উন্নত অস্ত্র গেলে তা সীমান্তবর্তী মণিপুরের কুকি জনগোষ্ঠীর বিদ্রোহীদের হাতে চলে যেতে পারে। ফলে মিয়ানমারের সীমান্তবর্তী গেরিলাদের হাতে উন্নত অস্ত্র যাওয়া নিয়ে ভারতের উদ্বেগ রয়েছে।

সার্বিক পরিস্থিতিতে চীনকে ভাবা যেতে পারে ‘বরের বাবা’ ও ‘কন্যার বাবা’। চীন এমনভাবে মিয়ানমারে নিজেদের জাল বিস্তার করছে যে অন্য কোনো দেশ হোক সে যুক্তরাষ্ট্র বা ভারত কারোরই সেখানে কিছু করার কোনো সুযোগ কম। ভারত সীমান্তবর্তী মিয়ানমারের ওপর নজর রাখলেও আটলান্টিকের ওপার থেকে যুক্তরাষ্ট্রের জন্য মিয়ানমারের পরিস্থিতিতে ভূমিকা রাখার সুযোগ সীমিত হয়ে আসছে। অন্যদিকে মিয়ানমারের মতো গুরুত্বপূর্ণ দেশ চীনের ‘কলোনি’ হয়ে যাওয়া ও সামরিকতন্ত্রের জেঁকে বসার ঘটনা যুক্তরাষ্ট্রের বৈশি^ক নীতির জন্য উদ্বেগজনক। পাকিস্তানের সঙ্গে বিশেষ সম্পর্ক থাকার কারণে যুক্তরাষ্ট্র আফগানিস্তানে সোভিয়েত দখলকে রুখে দিতে পেরেছিল এবং ৯/১১ এর পর আল-কায়েদাকে দমন করতে পেরেছিল। তবে মিয়ানমারের পরিস্থিতি ভিন্ন। বঙ্গোপসাগর বা মিয়ানমার সংলগ্ন কোথাও যুক্তরাষ্ট্রের বিশেষ কোনো অবস্থান নেই। ফলে যুক্তরাষ্ট্র কীভাবে তাদের ‘বার্মা অ্যাক্ট’ বাস্তবায়ন করবে তা সময় বলে দেবে।

লেখক: আন্তর্জাতিক রাজনীতিবিষয়ক রিসার্চ স্কলার ও কলামিস্ট

Shahadatju44@gmail.com

ভয়েস/আআ/সূত্র: দেশ রূপান্তর

Please Share This Post in Your Social Media

© All rights reserved © 2023
Developed by : JM IT SOLUTION