বৃহস্পতিবার, ০৯ অক্টোবর ২০২৫, ০৩:৩৬ অপরাহ্ন

দৃষ্টি দিন:
সম্মানিত পাঠক, আপনাদের স্বাগত জানাচ্ছি। প্রতিমুহূর্তের সংবাদ জানতে ভিজিট করুন -www.coxsbazarvoice.com, আর নতুন নতুন ভিডিও পেতে সাবস্ক্রাইব করুন আমাদের ইউটিউব চ্যানেল Cox's Bazar Voice. ফেসবুক পেজে লাইক দিয়ে শেয়ার করুন এবং কমেন্ট করুন। ধন্যবাদ।

কক্সবাজারে শুঁটকি তৈরির ধুম

এন.এ সাগর

দেশের সর্ববৃহৎ শুঁটকি পল্লী অবস্থিত কক্সবাজারের নাজিরার টেকে। ৯০ এর দশক থেকে শুঁটকি প্রlক্রিয়াজাত করা হচ্ছে এই পল্লীতে।

নানা প্রজাতির শুঁটকি উৎপাদনের ধুম পড়েছে কক্সবাজারের নাজিরার টেক শুটকি পল্লীতে। শীতকাল শুটকি প্রক্রিয়াজাত করার উপযুক্ত সময় হওয়ায় দিনরাত ব্যস্ত সময় পার করছেন শুঁটকি পল্লীর প্রায় ৩০ হাজার শ্রমিক। এই পল্লীর শুটকি গুনে ও মানে অতুলনীয় হওয়ায় এখন পর্যটকরা সরাসরি পল্লী থেকেই কিনছেন নানান প্রজাতির শুটকি।

চলতি অর্থবছরে শুঁটকি উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ৪০-৪৫ হাজার মেট্রিক টন।

শীতকালে বৃষ্টি না থাকায় এবং বাতাসের পরিমাণ ভালো থাকায় শুঁটকি দ্রুত শুকায়। তাই এই মৌসুমকেই শুটকি উৎপাদনের মোক্ষম সময় হিসেবে বেছে নিয়ে কর্মব্যস্ত সময় পাড় করছেন শ্রমিকরা। আগামী এপ্রিল মাস পর্যন্ত চলবে এই ব্যস্ততা।

তবে কাঁচা মাছ সরবরাহ বন্ধ হয়ে গেলে শ্রমিকদের কাজও বন্ধ হয়ে যায়।আর অভাব অনটন নেমে আসে সংসারে। এই পল্লীটিতে উৎপাদিত শুঁটকির সুনাম ছড়িয়েছে দেশের গণ্ডি পেরিয়ে বিদেশেও। যা দেখতে প্রতিবছর দেশ বিদেশ থেকে আসেন অনেক মানুষ।

শুধু তাই নই, এই পল্লীর শুটকির সুনাম থাকায়,পর্যটকরা সরাসরি পল্লী থেকেই কিনছেন নানা প্রজাতির শুটকি মাছ।

সরকারি বেসরকারি সুযোগ সুবিধা বাড়ানো গেলে এই অঞ্চলে শুটকি উৎপাদন আরও বাড়বে বলে মনে করছেন, এ খাতের সাথে জড়িতরা।

দেশের বৃহৎ শুঁটকি মহাল কক্সবাজারের নাজিরারটেক। দেশের চাহিদা মিটিয়ে বিদেশেও রপ্তানি করা হয় এখানকার শুঁটকি। আর এ খাত থেকে সরকারের লাখ লাখ টাকা রাজস্ব অর্জিত হচ্ছে।

কক্সবাজার শহরের নাজিরারটেক শুঁটকি মহালে এখন চলছে শুঁটকি উৎপাদনের কাজ। তবে আগামী ইলিশের নিরাপদ প্রজননের লক্ষ্যে ১২ অক্টোবর থেকে ২ নভেম্বর পর্যন্ত মোট ২২ দিন সারাদেশে ইলিশ আহরণ, পরিবহন, ক্রয়-বিক্রয় ও বিনিময় নিষিদ্ধ করেছে সরকার।

এই ২২ দিন সংশ্লিষ্ট জেলা প্রশাসকরা কঠোর নজর রাখবেন। এ সময় সরকারের এই সিদ্ধান্তকে মানতে হবে জেলে, আড়তদার, বিপণনকারী, গুদামজাতকারী ও বাজারজাতকরণের সঙ্গে জড়িত সংশ্লিষ্টদের। আর আইন অমান্যকারীকে মৎস্য আইনে সাজা দেওয়া হবে। এরপর মাছ ধরা শুরু হলে পুরোদমে মহালে কর্মব্যস্ত থাকবে শ্রমিকরা। তখন শীতের মৌসুমেও রোদের আলোতে মাছ শুকাতে সুবিধা হয়। শ্রমিক ও ব্যবসায়ীদের ধারণা এ বছর মৌসুমের ২ মাস পার হয়ে গেলেও বর্তমানে আগের চেয়ে দ্বিগুণ উৎপাদন ও রপ্তানি হচ্ছে নাজিরারটেকের শুঁটকি। আর এসব শুঁটকি উৎপাদনে নিয়োজিত আছেন প্রায় পাঁচ হাজার শ্রমিক।

ব্যবসায়ীরা বলেন, প্রতি মৌসুমে শুধু মাত্র নাজিরারটেক শুঁটকি মহালে ৬০ থেকে ৭০ হাজার টন বিভিন্ন জাতের শুঁটকি উৎপাদন করা হয়। যার বাজার মূল্য প্রায় দুই থেকে আড়াইশ কোটি টাকা। উৎপাদিত এসব শুঁটকি দেশের চাহিদা মিটিয়ে বিদেশেও রপ্তানি করা হচ্ছে। নাজিরারটেক নামক বিস্তুত ১০০ একর এলাকায় শুঁটকি মহালে শুঁটকি উৎপাদন শুরু হয়েছে। সাগরের বেঁড়িবাঁধ এবং বিশেষ উপায়ে তৈরি বাঁশের মাচার ওপর পাতলা করে বিছিয়ে সূর্যের তাপে কাঁচা মাছ শুকিয়ে শুঁটকিতে পরিণত করা হয়।

নাজিরারটেক শুঁটকি মহালে গিয়ে দেখা যায়, শুঁটকি শ্রমিক ও ব্যবসায়ীদের কর্মচাঞ্চল্য। যার যার মত সবাই ব্যস্ত। এভাবে নারী-পুরুষসহ প্রায় চার-পাঁচ হাজার শ্রমিকের আয়-রোজগারের উৎস এই নাজিরারটেক।

রোদে শুকানো হচ্ছে শুঁটকি। বর্ষাকাল ছাড়া বছরের নয়মাস এখানে শুঁটকি উৎপাদন চলে। তবে, সাগরের বেড়িবাঁধ এবং বিশেষ উপায়ে তৈরি বাঁশের মাচার ওপর পাতলা করে বিছিয়ে সূর্যের তাপে কাঁচা মাছ শুকিয়ে শুঁটকিতে পরিণত করা হয়। দেশে প্রথমবারের মতো শুঁটকি উৎপাদনে জাতীয় মৎস্য পুরস্কারপ্রাপ্ত শাহ আমানত ট্রেডার্সের স্বত্বাধিকারী আমান উল্লাহ আমান রাসায়নিকমুক্ত অর্গানিক শুঁটকি উৎপাদন করে যাচ্ছেন। নিত্যদিন পর্যটক ও ক্রেতার ভিড় বাড়ছে তার শুঁটকি মহালে।

নাজিরারটেক মহালে ছোটন নামে এক ব্যবসায়ীর নিয়ন্ত্রণে শ্রমিক হিসেবে কাজ করছেন শাহিনা আক্তার।

তিনি বলেন, বছরে ৭-৮ মাস শুঁটকি মহালে কাজ করছে এককালিন দেড় লাখ টাকা করে। থাকা ও খাওয়া মালিকের। মহালে প্রতিদিন সকাল থেকে বিকাল পর্যন্ত থাকতে হয়। মাচার পাশে থেকে মাছ পরিচর্যা করতে হয়। বর্তমানে তাদের মহালে অনেক মাছ রয়েছে।

ব্যবসায়ী মোঃ জাহেদ বলেন, তার শ্রমিকরা দীর্ঘদিন ধরে আছে। তাদের কাজও ভালো। এবছর নতুন তিনজন শ্রমিক কাজ করছেন। তাদের পাশের আড়তে শুধু বড় বড় পোয়া মাছ শুকানো হচ্ছে, সেখানে কথা হয় শ্রমিক হোসাইন ও সোলাইমানের সাথে।

তারা বলেন, দুইমাস আগে থেকে শুঁটকি উৎপাদন শুরু হয়েছে। এখন শুধু বড় বড় পোয়া মাছ শুকানো হচ্ছে। মাচা ও উপরে আজকে অনেক মাছ তোলা হয়েছে। এভাবে রোদ থাকলে ১০-১২ দিনের মধ্যে একদশ শুকিয়ে যাবে মাছ। তারপর ব্যবসায়ীরা দেশের বিভিন্ন প্রান্ত ও বিদেশে নিয়ে যাবেন মাছগুলো।

শুঁটকি ব্যবসায়ী নুরুল আবছার বলেন, শীত মৌসুম শুরুর আগে থেকে নাজিরারটেক শুঁটকি মহালে উৎপাদন শুরু হয়েছে। এবছরও রুপচাঁদা, ছুরি, কোরাল, সুরমা, লইট্যা পোপা, টেকচাদা, হাঙ্গর, ফাইস্যা, নাইল্যামাছসহ ১৮-২০ প্রজাতির শুঁটকি এ মহালে উৎপাদন করা হচ্ছে। তবে সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তরের পক্ষ থেকে শুঁটকি উৎপাদনে শ্রমিকদের সামান্য প্রশিক্ষণ এবং ভাতা পেলেও তা যথাযথ নয় বলে দাবি করেন তিনি। শ্রমিকদের আধুনিক ও সঠিকভাবে শুঁটকি উৎপাদনের আরো বেশি মৌলিক ধারণা দেওয়ার ব্যবস্থা নেয়ার গুরুত্বারোপ করেন তিনি। তাহলে এই নাজিরারটেক শুঁটকি মহাল থেকে সরকার কোটি কোটি টাকা রাজস্ব আদায় করতে পারবে। বর্তমানে কোস্ট ফাউন্ডেশন বিভিন্ন সহযোগিতা করে যাচ্ছেন। তাদের মতো সরকারি-বেসরকারি সংস্থা এগিয়ে আসলে সবাই উপকৃত হবে।

মৎস্য ব্যবসায়ী সমিতির আতিকুল্লাহ সিকদার বলেন, কক্সবাজারের আবহাওয়া শুঁটকির শুকানোর জন্য খুবই উপযোগী। লবণাক্ত আবহাওয়ার কারণে প্রতিবছর চট্টগ্রাম থেকে বিপুল পরিমাণ কাঁচা মাছ শুকানোর জন্য এই মহালে আনা হয়ে থাকে। উৎপাদনও খুব ভালো হচ্ছে।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, কক্সবাজারের নাজিরারটেকের শুঁটকি নিতে এখন দেশ-বিদেশের সকল মানুষ নিজেই এসে এবং পার্সেল যোগেও নিয়ে যাচ্ছে। যা এই শুঁটকি মানুষের চাহিদা এবং প্রোটিনের বড় একটি অংশ কক্সবাজারে উৎপাদিত শুঁটকি থেকে পূরণ হচ্ছে।

অপরদিকে কিছু ব্যবসায়ী অভিযোগ করে বলেন, কিছু অসাধু শ্রমিক ও ব্যবসায়ীরা কীটনাশক ব্যবহার করছে। যার ফলে মানুষ শুঁটকি খেলে স্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক ঝুঁকি রয়েছে।

নাজিরারটেকের শ্রমিক ও ব্যবসায়ীরা বলেন, দেশের এই বৃহৎ শুঁটকি মহালে দিন দিন উৎপাদন বৃদ্ধি পাচ্ছে। কিন্তু দীর্ঘদিনেও উক্ত এলাকার যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন ও মৎস্যজীবীদের মাঝে কোন প্রশিক্ষণের উদ্যোগ নেয়া হয়নি।

তারা আরো বলেন, কক্সবাজারে বেড়াতে আসা পর্যটকরাও কক্সবাজারের শুঁটকি না নিয়ে কক্সবাজার ছাড়তে চান না। এছাড়া অনেক শুঁটকি মাছ ব্যবসায়ী এই মহাল থেকে পাইকারী হারে মাছ কিনে তা বিভিন্ন বাজার ও মহল্লায় নিয়ে বিক্রি করে থাকে।

সূত্রে আরো জানা গেছে, গত ৮০ দশকের শুরু থেকে কক্সবাজার শহরের নাজিরারটেক এলাকাসহ মহেশখালী, কুতুবদিয়া, সোনাদিয়া, টেকনাফের বাহারছড়া, শাহপরীরদ্বীপ ও সেন্টমার্টিনে বিপুল পরিমাণ শুঁটকি উৎপাদন হচ্ছে। সেই থেকে কক্সবাজারের বিভিন্ন মহালের শুঁটকি দেশে ব্যাপক প্রচার প্রসার লাভ করে। এরপর মধ্যপ্রাচ্য, সৌদিয়া, দুবাই, হংকং ও কুয়েতসহ বিশ্বের নানা দেশে রপ্তানি প্রক্রিয়া শুরু করে ব্যবসায়ীরা। শুঁটকি রপ্তানি করে প্রতিবছর ব্যবসায়ীরা প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করে এবং সরকার এ খাত থেকে পাচ্ছে বিপুল পরিমাণ রাজস্ব।

নাজিরারটেক শুঁটকি ব্যবসায়ী বহুমূখী সমবায় সমিতির সভাপতি মো. আতিক উল্লাহ কোম্পানী বলেন, প্রায় ১শ একর এলাকাজুড়ে গড়ে উঠা এ শুঁটকি মহালে রয়েছে ছোট-বড় অর্ধশতাধিক আড়ত। দেশের সবচেয়ে বড় শুঁটকি মহাল হলো এই নাজিরারটেক। এখন শুঁটকি উৎপাদন কাজে নিয়োজিত আছেন প্রায় পাঁচ হাজার শ্রমিক ও প্রায় দুই হাজার ব্যবসায়ী। প্রতিদিন প্রায় দুইশ টন বিভিন্ন জাতের শুঁটকি উৎপাদন করা হচ্ছে।

মৎস্য অফিসের পক্ষ থেকে বিভিন্ন প্রশিক্ষণ ও বিষমুক্ত শুঁটকি উৎপাদনে সচেতনতার প্রোগ্রামও বাস্তবায়ন করা হচ্ছে।

ভয়েস/জেইউ।

Please Share This Post in Your Social Media

© All rights reserved © 2023
Developed by : JM IT SOLUTION