সোমবার, ২০ মে ২০২৪, ১২:২০ অপরাহ্ন

দৃষ্টি দিন:
সম্মানিত পাঠক, আপনাদের স্বাগত জানাচ্ছি। প্রতিমুহূর্তের সংবাদ জানতে ভিজিট করুন -www.coxsbazarvoice.com, আর নতুন নতুন ভিডিও পেতে সাবস্ক্রাইব করুন আমাদের ইউটিউব চ্যানেল Cox's Bazar Voice. ফেসবুক পেজে লাইক দিয়ে শেয়ার করুন এবং কমেন্ট করুন। ধন্যবাদ।

মানুষের মুক্তিকামী সংগ্রামের উজ্জ্বল মেনিফেস্টো

আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক:
মার্কিন লেখক রালফ ওয়াল্ডো এমারসনের একটা কথা আছে স্পিচ ইজ পাওয়ার। আবার ফ্রান্সিস বেকনের একটি কথা আছে নলেজ ইজ পাওয়ার। বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণের মূল্যায়ন করতে গেলে সংক্ষেপে এই দুটি কথা আমার স্মরণে আসে। বক্তৃতা বা ভাষণের ক্ষমতা যে কতদূর যেতে পারে, ভাষণটি তার প্রকৃষ্ট প্রমাণ। ১৯ মিনিটের ভাষণে তিনি যে কথাগুলো বলেছেন, যে শব্দ প্রয়োগ ঘটিয়েছেন, যেসব তথ্য দিয়েছেন, তার প্রতিটি জায়গায় আজ ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করার সুযোগ রয়েছে। একটি ভাষণ বা বক্তৃতার ধ্রুপদি বা ক্ল্যাসিকাল যেসব বৈশিষ্ট্য থাকা দরকার তার সবকিছু ভাষণটিতে রয়েছে।

জাতিসংঘের বিশেষায়িত সংস্থা ইউনেস্কো ৩০ অক্টোবর, ২০১৭ তারিখে বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণটি ইউনেস্কোর বিশ্ব ঐতিহ্য-স্মারক তালিকায় (Memory of the World International Register) সংযোজিত করেছে। এর কারণ কী? কারণ, ভাষণটি কেবল বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও এ দেশের মানুষের মুক্তির অনুপ্রেরণা হিসেবে নয়, তারা দেখেছে এই ভাষণটি সারা বিশ্বের নিপীড়িত ও মুক্তিকামী মানুষের সংগ্রামের এক উজ্জ্বল মেনিফেস্টো। বঙ্গবন্ধুর ৪৫তম শাহাদাতবার্ষিকীতে ইউনেস্কো মহাপরিচালক অদ্রে আজুলে যে বাণী দিয়েছেন তাতে তিনি উল্লেখ করেছেন, ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে বঙ্গবন্ধুর জীবনদর্শন সর্বদাই অনুপ্রেরণার উৎস হয়ে থাকবে। তার ভাষায়, ‘It is certain that Bangabandhu’s legacy will continue to be a great source of inspiration for generations to come and for those working to reinvent the world.’

আন্তর্জাতিক সাময়িকী নিউজ উইক কর্তৃক ‘রাজনীতির কবি’ বলে অভিহিত বঙ্গবন্ধু। আর তার ৭ মার্চের ভাষণ ছিল প্রকৃতপক্ষে রাজনীতির মহাকাব্য। ইতিহাসবিদ ও লেখক জ্যাকব এফ ফিল্ড সম্পাদিত ‘We Shall Fight On The Beaches’ গ্রন্থে পুরো পৃথিবীকে আন্দোলিত করেছে এমন ৪১টি ভাষণের মাঝে স্থান করে নিয়েছে বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ। খ্রিস্টপূর্ব ৪৩১ থেকে ১৯৮৭ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত এই সুদীর্ঘ সময়কালের ইতিহাসে যে ভাষণগুলো মানবসভ্যতায় স্থায়ী প্রভাব ফেলেছে, কালজয়ী অনুপ্রেরণাদায়ী সে ভাষণগুলোই এ গ্রন্থের আধেয়।

অধুনালুপ্ত ‘দৈনিক পাকিস্তান’ ‘লক্ষ কণ্ঠের বজ্রশপথ’ শিরোনামে পরদিনের (৮ মার্চ, ১৯৭১) পত্রিকায় বর্ণনা করে, ‘লক্ষ হস্তে শপথের বজ্রমুষ্টি মুহুর্মুহু উত্থিত হচ্ছে আকাশে। জাগ্রত বীর বাঙালির সার্বিক সংগ্রামের প্রত্যয়ের প্রতীক, সাত কোটি মানুষের সংগ্রামী হাতিয়ারের প্রতীক বাঁশের লাঠি মুহুর্মুহু স্লোগানের সাথে সাথে উত্থিত হচ্ছে আকাশের দিকে। এই ছিল রবিবারের (৭ মার্চ, ১৯৭১) রমনার রেসকোর্স মায়দানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঐতিহাসিক সভার দৃশ্য।’ ‘জয় জনতার জয়’ শিরোনামে দৈনিক ইত্তেফাক পরদিন অর্থাৎ ৮ মার্চ, ১৯৭১ তারিখে রিপোর্ট করে যে, গভীর রাত্রিতে প্রাপ্ত খবরে প্রকাশ, ‘সামরিক কর্তৃপক্ষ শেষ পর্যন্ত ঢাকা বেতার হইতে শেখ মুজিবুর রহমানের রমনা রেসকোর্স ময়দানে প্রদত্ত ভাষণের পূর্ণ বিবরণ প্রচারের অনুমতি দিতে স্বীকৃত হইয়াছেন। সোমবার (৮ মার্চ, ১৯৭১) সকাল সাড়ে ৮ ঘটিকায়, ঢাকা বেতার কেন্দ্র হইতে শেখ মুজিবুর রহমানের রমনা রেসকোর্স ময়দানে প্রদত্ত ভাষণ প্রচার করা হইবে। বাংলার অন্যান্য বেতারকেন্দ্র হইতেও ইহা রিলে করা হইবে।’ ভাষণটি বাঙালি জাতির মুক্তি প্রক্রিয়ার অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে সেই মুহূর্ত থেকেই বিশ্বব্যাপী পরিগণিত।

বঙ্গবন্ধু ৭ মার্চ একাত্তরের অপরাহ্ণে যখন ভাষণ দিচ্ছিলেন তখন বেতার-টেলিভিশন বন্ধ করার যে ঘটনা ঘটিয়েছিল পাকিস্তানি শাসকরা, ঠিক তেমনই ঘটনা আমাদের প্রত্যক্ষ করতে হয়েছে স্বাধীন বাংলাদেশে। বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারী ও হত্যাকান্ডের দোসররা দীর্ঘ একুশ বছর বঙ্গবন্ধুর এই সম্মোহনী ভাষণটিকে একদিনের জন্যও প্রচার করেনি। বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ডের একুশ বছর পর ১৯৯৬ সালের ২৩ জুন সন্ধ্যায় বাংলাদেশ টেলিভিশন প্রথমবারের মতো এই ভাষণ সম্প্রচার করে। পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে এই ঐতিহাসিক ভাষণটি আজ আমাদের পবিত্র সংবিধানের অংশ।

যোগাযোগতাত্ত্বিক বিশ্লেষণ

বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ যোগাযোগ বিজ্ঞানের তাত্ত্বিক প্রয়োগের এক বিস্ময়কর ঘটনা। যোগাযোগ বিষয়ে আধুনিক নিয়ম-কানুনের এক আশ্চর্য প্রতিফলন ঘটেছে এখানে। প্রতি মিনিটে গড়ে ৫৮ থেকে ৬০টি শব্দ উচ্চারণ করে বঙ্গবন্ধু ১৯ মিনিটে এ কালজয়ী ভাষণটি শেষ করেছিলেন। সম্প্রচারতত্ত্বে প্রতি মিনিটে ৬০ শব্দের উচ্চারণ একটি আদর্শ হিসাব। এক হাজার একশত সাতটি শব্দের এ ভাষণে কোনো বিরক্তিকর পুনরাবৃত্তি নেই, কোনো বাহুল্য নেই আছে শুধু সারকথা, সারমর্ম। তবে দু-একটি স্থানে পুনরাবৃত্তি বক্তব্যের অন্তর্লীন তাৎপর্যকে বেগবান করেছে।

ভাষণের সূচনাপর্ব অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বলা হয়ে থাকে ‘There is nothing like a good beginning for a speech’। বক্তব্যের প্রারম্ভে শ্রোতার মানসিক অবস্থান (audience orientation) ও সাম্প্রতিক ঘটনা উল্লেখ করা অত্যাবশ্যক বলে যোগাযোগতত্ত্বে যা বলা হয় (reference to audience and reference to recent happenings) তার আশ্চর্য প্রতিফলন ঘটে বঙ্গবন্ধুর এ যুগান্তকারী ভাষণে।

বঙ্গবন্ধু ভাষণ শুরু করেছিলেন, ‘ভাইয়েরা আমার, আজ দুঃখভারাক্রান্ত মন নিয়ে আপনাদের সামনে হাজির হয়েছি। আপনারা সবই জানেন এবং বোঝেন। আমরা আমাদের জীবন দিয়ে চেষ্টা করেছি। কিন্তু দুঃখের বিষয় আজ ঢাকা, চট্টগ্রাম, খুলনা, রাজশাহী, রংপুরে আমার ভাইয়ের রক্তে রাজপথ রঞ্জিত হয়েছে। আজ বাংলার মানুষ মুক্তি চায়, বাংলার মানুষ বাঁচতে চায়, বাংলার মানুষ তার অধিকার চায়।’ অত্যন্ত কার্যকর অবতরণিকা যা পুরো বক্তৃতার মূলভিত্তি তৈরি করেছে ও শ্রোতাকুলকে অভ্যুদিত বক্তৃতার আভাস দিচ্ছে।

পুরো বক্তৃতার আধেয় বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় যে, এ ভাষণই ছিল কার্যত (de facto) বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা। ‘আমি প্রধানমন্ত্রিত্ব চাই না’ এই উচ্চারণ প্রসঙ্গে প্রয়াত সাংবাদিক-সম্পাদক কামাল লোহানী বলেছিলেন, ‘সংসদীয় রাজনীতির অঙ্গনে চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করার এই বলিষ্ঠতা একমাত্র বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানই দেখাতে পেরেছিলেন বলে তিনি জাতিরাষ্ট্র-স্রষ্টা এবং মুক্তিদাতা হিসেবে মহত্ত্ব অর্জন করেছিলেন।’

জনযোগাযোগে যেসব speech-idiom ব্যবহার করার কথা তা অত্যন্ত সঠিকভাবে সুপ্রযুক্ত হয়েছে বক্তৃতায়। বাংলার জনগণের সঙ্গে বাংলাদেশের অবিসংবাদিত নেতার সংলাপ এ বক্তৃতা। ভাষণে তিনি সংলাপের বাচনশৈলী অনুসরণ করেছিলেন অত্যন্ত সুচারুভাবে। বক্তৃতার বিভিন্ন পর্যায়ে তিনি সরাসরি সুনির্দিষ্ট প্রশ্ন উত্থাপন করেছেন পাঁচটি : কী অন্যায় করেছিলাম? কী পেলাম আমরা? কীসের আর.টি.সি.? কার সঙ্গে বসব? যারা আমার মানুষের রক্ত নিয়েছে তাদের সঙ্গে বসব? বক্তার সঙ্গে শ্রোতার মেলবন্ধন সৃষ্টিতে ‘ask question and then answer’ ’ পরামর্শের সুপ্রয়োগ ঘটেছে এখানে। পুরো ভাষণে বর্তমানকালের যৌক্তিক ব্যবহার বক্তৃতাটিকে সজীবতা দিয়েছে। যোগাযোগতাত্ত্বিকদের declarative বাক্য সংক্ষিপ্ত করার বর্তমান নির্দেশিকা বঙ্গবন্ধুর ভাষণে যথাযথ প্রতিফলিত। যেমন, ‘২৮ তারিখে কর্মচারীরা গিয়ে বেতন নিয়ে আসবেন’; ‘প্রত্যেক ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলো’; ‘সরকারি কর্মচারীদের বলি আমি যা বলি তা মানতে হবে’; ‘যে পর্যন্ত আমার এই দেশের মুক্তি না হবে, খাজনা-ট্যাক্স বন্ধ করে দেওয়া হলো, কেউ দেবে না’; ‘সাড়ে সাত কোটি বাঙালিকে দাবায়ে রাখতে পারবা না’।

রাষ্ট্রনায়কোচিত ও কর্তৃত্বব্যঞ্জক বক্তৃতার অপরিহার্য বৈশিষ্ট্য হচ্ছে ভবিষ্যৎ কর্মোদ্যোগ, কর্মপরিকল্পনার সঙ্গে শ্রোতাদের শুধু পরিচিতি করানোই নয়, বরং তাদের সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণে উদ্বুদ্ধ ও অনুপ্রাণিত করা। বঙ্গবন্ধু কাজটি অত্যন্ত সফলভাবে সাধন করেছিলেন তার এ বক্তৃতার মাধ্যমে ‘তোমাদের ওপর আমার অনুরোধ রইল, প্রত্যেক ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলো। তোমাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবিলা করতে হবে এবং জীবনের তরে রাস্তাঘাট যা যা আছে সব কিছু, আমি যদি হুকুম দেবার নাও পারি তোমরা বন্ধ করে দেবে।’ সাড়ে ৭ কোটি বাঙালি এ বক্তব্যকেই হুকুমনামারও অধিক গুরুত্বপূর্ণ প্রত্যাদেশ বলে সেদিন গ্রহণ করেছিলেন।

মানবিক দৃষ্টিভঙ্গি বঙ্গবন্ধুর চরিত্রের এক অন্যতম বৈশিষ্ট্য। কঠিন সতর্কবাণী উচ্চারণের সময়ও তার মানবিক উদারতার কোনো হেরফের কখনো যে ঘটেনি তার প্রকৃষ্ট প্রমাণ ৭ মার্চের ভাষণ। রাষ্ট্রের জন্মমৃত্যুর সংযোগস্থলে দাঁড়িয়েও তিনি ‘আমরা ভাতে মারব, আমরা পানিতে মারব’ বলার সঙ্গে সঙ্গেই আবার আশ্বাসবাণী উচ্চারণ করেন ‘তোমরা আমার ভাই তোমরা ব্যারাকে থাকো, কেউ তোমাদের কিছু বলবে না। কিন্তু আর আমার বুকের ওপরে গুলি চালাবার চেষ্টা কোরো না।’ কঠিনের সঙ্গে কোমলের এমন সহাবস্থান উদার-হৃদয় বঙ্গবন্ধুর মধ্যে সর্বদাই বিদ্যমান ছিল।

যথাযথ তথ্য চয়নের ফলে বক্তৃতাটি অত্যন্ত তথ্যনিষ্ঠ, আর তীক্ষè যুক্তিবিন্যাসের কারণে শ্রোতাদের মধ্যে তীব্র প্রণোদনা সঞ্চারে সক্ষম হয়েছে। সহজ ভাষায় জোরালো যুক্তিবাদ বঙ্গবন্ধুর ভাষণের এক সহজাত বিশেষত্ব। সর্বজনীন ভাষণের একটি প্রধান দায়িত্ব কর্মসূচি নির্ধারণ (agenda setting function) যা বঙ্গবন্ধুর এ বক্তৃতায় সুস্পষ্টভাবে এসেছে বারবার। কিন্তু কঠোর কর্মসূচি প্রদানকালেও বঙ্গবন্ধুর মানবিক দৃষ্টিভঙ্গির (humanistic approach) যে কোনো তারতম্য ঘটত না তার স্বাক্ষর নিম্নোক্ত বক্তব্য : ‘আমি পরিষ্কার অক্ষরে বলে দেবার চাই যে, আজ থেকে এই বাংলাদেশে কোর্ট, কাছারি, ফৌজদারি আদালত, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ থাকবে। গরিবের যাতে কষ্ট না হয়, যাতে আমার মানুষ কষ্ট না করে, সে জন্য সমস্ত অন্য জিনিসগুলো আছে সেগুলোর হরতাল, কাল থেকে চলবে না। রিকশা, ঘোড়ার গাড়ি চলবে, রেল চলবে, লঞ্চ চলবে। কিন্তু সেক্রেটারিয়েট, সুপ্রিম কোর্ট, হাইকোর্ট, জজকোর্ট, সেমি-গভর্নমেন্ট দপ্তরগুলো ওয়াপদা, কোনো কিছু চলবে না।’

জনযোগাযোগে ব্যক্তি বা ঘটনার মর্যাদা আরোপ (status conferral function) একটি গুরুত্বপূর্ণ বিধান। বঙ্গবন্ধুর বক্তৃতার বিভিন্ন অংশে এ বিধানের প্রয়োগ লক্ষ করা যায়। যেমন তিনি বলেছেন, ‘আর এই সাতদিন হরতালে যে সমস্ত শ্রমিক ভাইয়েরা যোগদান করেছেন প্রত্যেকটা শিল্পের মালিক তাদের বেতন পৌঁছে দেবেন’ কিংবা ‘আর যে সমস্ত লোক শহীদ হয়েছে, আঘাতপ্রাপ্ত হয়েছে, আমরা আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে যতদূর পারি ওদের সাহায্য করতে চেষ্টা করব।’

সর্বজনীন বক্তব্যে ও জনযোগাযোগে কার্যকর ফল লাভের জন্য চ্যালেঞ্জ উত্থাপন (posing a challenge) ) সর্বজনবিদিত একটি পদ্ধতি। বঙ্গবন্ধু বক্তৃতার শেষপর্যায়ে এসে যখন বলেন, ‘প্রত্যেক গ্রামে, প্রত্যেক মহল্লায়, আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে সংগ্রাম পরিষদ গড়ে তোলো এবং তোমাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে প্রস্তুত থাকো। মনে রাখবা রক্ত যখন দিয়েছি, রক্ত আরও দেব এ দেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়ব ইনশালাহ’ তখন বোঝা যায় যে তিনি যোগাযোগবিদ্যার শিল্পকুশল প্রণালিতে পরম দক্ষতায় কীভাবে শ্রোতাদের বক্তৃতার সঙ্গে গেঁথে ফেলেছেন।

যে কোনো বক্তৃতার সংজ্ঞানির্ধারণী অংশ সাধারণত শেষেই উচ্চারিত হওয়া বাঞ্ছনীয় বলে যোগাযোগবিদদের আধুনিক অভিমত। বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণের শেষবাক্য ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’। কার্যত স্বাধীনতার ঘোষণা যা ৭ মার্চের বক্তৃতার সংজ্ঞা হিসেবে স্বীকৃত। যে প্রক্রিয়ায় তিনি ভাষণ শেষ করেছেন তা যোগাযোগবিদ্যার পাঠ্যপুস্তকের সঙ্গে হুবহু মিলে যায়, যেখানে বলা হয় ‘Don’t drag out your conclusion’’।

আমরা জানি যে, বলিষ্ঠ বক্তব্য সর্বদাই সংক্ষিপ্ত হয়। একাত্তরের ৭ মার্চ তারিখে প্রদত্ত জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের তট-অতিক্রমী ভাষণ তেজস্বী বক্তৃতার এক শ্রেষ্ঠ উদাহরণ।

বক্তৃতাবিশারদ, গবেষক ও যোগাযোগবিদদের জন্য এ ঐতিহাসিক ভাষণ একটি আবশ্যিক পাঠক্রম হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে দেশে-বিদেশে।

৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণ বঙ্গবন্ধুর extempore speech হলেও লক্ষণীয় যে উপস্থিত বক্তৃতার সচরাচর পরিদৃষ্ট লক্ষণ যেমন বিরক্তিকর পুনরাবৃত্তি, শব্দচয়নে মুহূর্তের দ্বিধাগ্রস্ততা ইত্যাদি ছিল একেবারেই অনুপস্থিত। বঙ্গবন্ধুর বক্তৃতায় শব্দের ব্যবহার বিশ্লেষণ করলে যুক্তরাষ্ট্রের তৃতীয় রাষ্ট্রপতি টমাস জেফারসনের (১৭৪৩-১৮২৬) বিখ্যাত উক্তি the most valuable of all talents is that of never using two words when one will do’ আমাদের স্মরণে আসে।

বঙ্গবন্ধু মানবজাতির সার্বিক মুক্তির ঠিকানা দিয়ে গেছেন ৭ মার্চের ভাষণে। তাই ইউনেস্কো আজ বিশ্বঐতিহ্য-স্মারক তালিকায় বঙ্গবন্ধুর সেই ভাষণকে সংযোজিত করে মানবমুক্তির চলমান যাত্রাকে আরও গতিশীল করার পদক্ষেপ নিয়েছে।

লেখক: সাবেক উপাচার্য; অধ্যাপক, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, ঢাবি

ভয়েস/আআ

Please Share This Post in Your Social Media

© All rights reserved © 2023
Developed by : JM IT SOLUTION