বুধবার, ০৮ অক্টোবর ২০২৫, ০৩:৫০ অপরাহ্ন
এ কে এম শহীদুল হক:
বিশ্বব্যাপী করোনাভাইরাসের বিস্তার প্রতিরোধ এবং চিকিৎসাসেবা প্রদানের জন্য পুলিশ ও চিকিৎসকরা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে দিনরাত কাজ করে যাচ্ছেন। আমাদের দেশেও একইভাবে চিকিৎসক, নার্স, স্বাস্থ্যকর্মী, পুলিশ, প্রশাসনিক কর্মকর্তা ও অন্যান্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য ও সেনা সদস্যরা করোনার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে যাচ্ছেন।
মানবতার মহান পেশায় নিয়োজিত চিকিৎসকদের সম্বন্ধে এক শ্রেণির মানুষের নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি আছে। কিছুদিন আগে খুলনাতে একজন রোগীর মৃত্যুর জন্য অবহেলার অভিযোগ এনে একটি ক্লিনিকের মালিক একজন চিকিৎসককে শারীরিক নির্যাতন করে হত্যা করা হয়েছিল। সিজারিয়ান অপারেশনের পর রক্তপাত বন্ধ না হওয়ায় রোগীকে ঢাকাতে রেফার্ড করা হয়েছিল। পথিমধ্যে রোগীর মৃত্যু হয়। এটিএন নিউজের অনলাইন সংবাদ পোর্টালে ঘটনাটি জানি। সংবাদের নিচে অসংখ্য লোকের কমেন্ট ছিল। একটি কমেন্ট ছাড়া বাকি সবাই এই হত্যাকা- ও হত্যাকারীদের পক্ষে অবস্থান নিয়েছিল। হত্যাকারীদের কাজটি সঠিক হয়েছে ইত্যাদি লিখে চিকিৎসকদের বিরুদ্ধে নানারকম নেতিবাচক ও আপত্তিকর মন্তব্য করা হয়েছিল। জানা যায়, ঐ চিকিৎসক বেশ পরোপকারী ছিলেন। তিনি অনেক কম টাকায় সিজারিয়ান অপারেশন করতেন। অতি দরিদ্রদের বিনা পয়সায় চিকিৎসা করতেন। খুলনার ছেলে খুলনাবাসীদের সেবা করবেন, তাই ঢাকায় আসেননি। আর সেই খুলনাবাসীই তাকে ভিত্তিহীন অভিযোগের দায়ে হত্যা করল। বড়ই মর্মান্তিক।
করোনা মহামারীর মধ্যে চিকিৎসক, নার্স ও স্বাস্থ্যকর্মীরা নিজেদের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সম্মুখ সারিতে থেকে করোনা রোগীর চিকিৎসাসেবা দিয়ে যাচ্ছেন। তারা ব্যক্তিগত ও পারিবারিক জীবনের প্রতি খেয়াল না করে মানবতার সেবায় নিজেদের নিয়োজিত রেখেছেন। এ দুর্যোগের সময়েও যদি চিকিৎসকের সম্বন্ধে জনমত ( (public perception) এ রকম নেতিবাচক হয় তবে চিকিৎসকদের মর্যাদা, আত্মত্যাগের স্বীকৃতি ও মানবিক সেবার মূল্যায়ন কোথায়? আর কী করলে মানুষ চিকিৎসকদের ভালো বলবেন। চিকিৎকদের সম্বন্ধে মানুষের এ ধরনের দৃষ্টিভঙ্গি থাকলে ভবিষ্যতে এ পেশায় আসতে অনেকেই নিরুৎসাহিত হতে পারেন।
আমার স্কুলজীবনের এক ক্লাসমেটের মেয়ে ডাক্তার। একটি সরকারি মেডিকেল কলেজের প্রভাষক। এখন ঐ কলেজের ল্যাবরেটরিতে করোনা টেস্টের দায়িত্বে আছে। তার সঙ্গে কথা হলো। সে বলল, ‘মামা, সকালে বাসা থেকে শিশু মেয়েটিকে মায়ের কাছে রেখে হাসপাতালে যাই। পিপিই পরে ল্যাবরেটরিতে ঢুকতে হয়। যখন পিপিই পরিধান করি, তখন মনে হয় আমি যেন দোজখে প্রবেশ করছি। অত্যধিক গরম, অ-আরামদায়ক ও অস্বস্তিকর। সারা দিন তা পরেই ল্যাবে কাজ করতে হয়। রাতে বাসায় আসতে নয়টা/দশটা বেজে যায়। আমাকে দেখেই মেয়েটি কাছে আসার জন্য অস্থির হয়ে পড়ে। কিন্তু আমি তাকে কাছে আসতে দিই না। গোসল করে, কাপড়-চোপড় সব ফেলে দিয়ে অনেকক্ষণ পর বাচ্চাকে কাছে আনি। সারা দিন পর আমাকে পেয়ে তার যে কী আনন্দ! আমরা ডাক্তাররা সবাই এত ঝুঁকি নিয়ে কষ্ট করে কাজ করি। অথচ এক শ্রেণির লোক আমাদের ভালো জানেন না, সমালোচনা করেন। এখন আর এগুলো আমলে নিই না। ওসব কথা শুনতেও চাই না। মানুষের সেবায় নিজেদের বিলিয়ে দিচ্ছি। মানবতার জন্য কাজ করছি। এ জন্যই ডাক্তার হয়েছি। এতেই আমি মানসিক শান্তি পাচ্ছি। কে কী বলল তা তোয়াক্কা করি না। তা শোনার সময়ও নেই, মনও নেই। দোয়া করবেন মামা সুস্থ থেকে যেন মানুষের জন্য কাজ করে যেতে পারি।’
মেয়েটির কথা শুনে আমার ভালো লাগল। সব চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মী এ মানসিকতা নিয়েই এ দুর্যোগের সময় চিকিৎসাসেবা দিয়ে যাচ্ছেন। চিকিৎসকরা পরিবার-পরিজন থেকে বিচ্ছিন্ন থাকছেন। তাদের পরিবার প্রতি মুহূর্তে উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠার মধ্যে থাকছে। অনেকে আক্রান্ত হয়েছেন। ইতিমধ্যে পঁচিশ/ত্রিশজন চিকিৎসক মৃত্যুবরণও করেছেন। কাজেই করোনাযুদ্ধে সম্মুখ সারিতে থেকে যেসব চিকিৎসক ও পুলিশ যুদ্ধ করে যাচ্ছেন তাদের প্রতি আমাদের সবার সম্মান প্রদর্শন করা উচিত। তাদের ভূমিকা ও আত্মত্যাগের স্বীকৃতি দেওয়া অবশ্যই আমাদের একান্ত কর্তব্য। এক্ষেত্রে মানুষের দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন আবশ্যক।
একটি কুচক্রী মহল সর্বদা ষড়যন্ত্র করে ও গুজব ছড়িয়ে তাদের হীন উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য মানবসেবা ও জনস্বার্থে নিয়োজিত ব্যক্তিদের ভাবমূর্তি নষ্ট করে তাদের মধ্যে হতাশা সৃষ্টি করতে চায়। এরা বিবেক ও মনুষ্যত্ব বিবর্জিত এক প্রকার কীট। এদের ব্যাপারে দেশবাসীকে সতর্ক থাকতে হবে। গুজব সমাজ ও মানবতার কল্যাণের জন্য হুমকি। তাই কোনো কিছুর সত্যতা না পাওয়া পর্যন্ত গুজবে কান দেওয়া যাবে না। সামাজিক মিডিয়ার সব প্রচারণা সত্য নয়। সেগুলোর সত্যতা প্রমাণ না হওয়া পর্যন্ত বিশ্বাস করা ঠিক হবে না।
সমাজের সব পেশা ও শ্রেণির লোকদের পুলিশের সেবা নিতে হয়। বিপদ-আপদে মানুষ পুলিশের সহায়তা চায়। যেমন কারও বাড়িতে ডাকাত হামলা করলে ঐ বাড়ির লোকজন আল্লাহর পরই পুলিশকে স্মরণ করেন। মনে মনে বলেন এখন যদি পুলিশ আসত। সুযোগ পেলে পুলিশকে কল করেন। এখন তো ৯৯৯-এ কল করলেই পুলিশ চলে আসে।
করোনাযুদ্ধে দেশবাসী পুলিশের ভূমিকা লক্ষ করেছে। এ দুর্যোগের সময়ে পুলিশ সম্মুখ সারিতে থেকে পুলিশের বিধিবদ্ধ কাজের বাইরেও মানবিক কাজও করছে। করোনায় মৃত্যুবরণকারী ব্যক্তির সন্তান ও আত্মীয় স্বজন ভয়ে সৎকারের জন্য মৃত ব্যক্তির কাছে না এলেও পুলিশ মৃত ব্যক্তির জানাজার ব্যবস্থা করছে। দাফন-কাফন বা সৎকারের ব্যবস্থা করেছে। পুলিশ নিজস্ব উদ্যোগে ত্রাণ বিতরণ করেছে। সচেতনামূলক প্রচারণা চালাচ্ছে, মানুষের চাহিদা মোতাবেক ওষুধ ও খাদ্যসামগ্রী তাদের দোরগোড়ায় পৌঁছে দিচ্ছে।
পুলিশ নিজেদের জীবনের ঝুঁকি নিয়েই এসব কাজ করছে। করোনার বিরুদ্ধে ঝুঁকিপূর্ণ দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে জুলাইয়ের শুরুতেই করোনাভাইরাসে আক্রান্ত পুলিশ সদস্যের সংখ্যা দশ হাজার ছাড়িয়ে গিয়েছে। ৪৪ জন পুলিশ সদস্য করোনা আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেছে। আরও প্রায় দেড় হাজার সদস্য হাসপাতালে ভর্তি আছে। নিকট অতীতে সন্ত্রাসী ও জঙ্গি দমন করতে গিয়েও অনেক পুলিশ সদস্য শহীদ হয়েছেন।
করোনাযুদ্ধে শুধু পুলিশ না আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অন্যান্য সদস্য যেমন সেনাবাহিনী, বিজিবি, আনসার এবং প্রশাসনিক কর্মকর্তারাও আক্রান্ত হচ্ছেন। সংবাদকর্মীরাও আক্রান্ত হচ্ছেন। তাদের অনেকে মৃত্যুবরণ করেছেন।
পুলিশ তাদের ওপর অর্পিত দায়িত্ব থেকে কখনো পিছু হটেনি। শত সমস্যা, সীমাবদ্ধতা ও ঝুঁকির মধ্যেও তারা সাহসের নিয়ে জনগণের সঙ্গে থেকে দায়িত্ব পালন করে থাকে। কিন্তু তারপরও জনগণের মধ্যে পুলিশ সম্বন্ধে নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি বিরাজ করছে। এটা অত্যন্ত পরিতাপের বিষয়। সমাজে ও দৈনন্দিন জীবনে প্রত্যেক পেশার ও সেবা প্রদানকারী সংস্থার সেবার প্রয়োজনীয়তা আছে এবং তাদের সবারই যথাযথ মর্যাদাও আছে। সমাজকেই এ মর্যাদা সমুন্নত রাখতে হবে। কাউকেই তুচ্ছ জ্ঞান করা মোটেই সমীচীন নয়।
চিকিৎসক ও পুলিশের বিরুদ্ধে অভিযোগ থাকতে পারে। তাদের কোনো ত্রুটি-বিচ্যুতি নেই এ কথা আমি বলব না। কিন্তু সেজন্য ঢালাওভাবে তাদের সবাইকে দোষারোপ করা সমীচীন নয়। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ নিজ নিজ বিভাগের সদস্যদের সংশোধনের জন্য, তাদের সেবা প্রদান প্রক্রিয়ায় ও আচরণে পরিবর্তন এনে সেবার মান উন্নয়নের জন্য চেষ্টা অব্যাহত রেখেছেন। ইতিবাচক পরিবর্তনও আসছে। দোষত্রুটি থাকলেও এ দুটো সেবামূলক পেশার অস্তিত্ব ও প্রয়োজনীয়তাকে কি আমরা অস্বীকার করতে পারব? পুলিশ সদস্য ও চিকিৎসকরা যদি একটি দিন কাজ না করেন তবে দেশে কী অবস্থার সৃষ্টি হবে তা কি আমরা কখনো ভেবে দেখেছি? দেশে চরম অরাজকতা দেখা দেবে, মানুষের জানমাল, নিরাপত্তা ও সম্ভ্রম হুমকির মধ্যে পড়বে। বহু লোক চিকিৎসার অভাবে মৃত্যুবরণ করবে।
পুলিশ ও চিকিৎসকের সেবা মানুষ নিচ্ছে। তাদের সেবার প্রয়োজনীয়তাও উপলব্ধি করছে। কিন্তু তাদের সম্বন্ধে নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গিও আছে। কেন এটা হচ্ছে, তা গবেষণার দাবি রাখে। তবে তারা যে সেবা দিচ্ছে সে স্বীকৃতি দেওয়া উচিত। মূল্যায়ন করা উচিত। নিন্দা ও বৈরিতা নয়, আপন ভেবে পরামর্শ দিয়ে তাদের দৃষ্টিভঙ্গি ও মননশীলতায় জনপ্রত্যাশার আলোকে পরিবর্তন আনাই বিজ্ঞতার পরিচায়ক হবে।
লেখক
সাবেক ইন্সপেক্টর জেনারেল, বাংলাদেশ পুলিশ