শনিবার, ১২ অক্টোবর ২০২৪, ০২:৩৬ অপরাহ্ন

দৃষ্টি দিন:
সম্মানিত পাঠক, আপনাদের স্বাগত জানাচ্ছি। প্রতিমুহূর্তের সংবাদ জানতে ভিজিট করুন -www.coxsbazarvoice.com, আর নতুন নতুন ভিডিও পেতে সাবস্ক্রাইব করুন আমাদের ইউটিউব চ্যানেল Cox's Bazar Voice. ফেসবুক পেজে লাইক দিয়ে শেয়ার করুন এবং কমেন্ট করুন। ধন্যবাদ।

লেবাননিদের রক্তে লাভের অঙ্ক নেতানিয়াহু-ইসরায়েলের

নাজমুল আহসান:
মধ্যপ্রাচ্যে শান্তির সম্ভাবনা দিন দিন দূরীভূত হচ্ছে। ইসরায়েলের আগ্রাসী আচরণের কারণে কেউ যেন কিছু করতে পারছে না। তবে শান্তি না এলেও পশ্চিমাদের পক্ষ থেকে বিশেষ করে আমেরিকার পক্ষ থেকে সংযম প্রদর্শন ও যুদ্ধবিরতির জন্য মায়াবি হুমকি, কিছুটা বাগাড়ম্বর দেখানো হচ্ছে। যদিও কোনো কিছুতেই ইসরায়েলের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু ও তার ডানপন্থি কোয়ালিশন সরকারের ওপর তার কোনো প্রভাব পড়ছে না। বরং মধ্যপ্রাচ্যে সংঘাতকে আরও ছড়িয়ে দিতে ইসরায়েল, এর গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদ ও সামরিক বাহিনী আইডিএফ একের পর এক উসকানিমূলক কাণ্ড ঘটিয়েই যাচ্ছে। কিছুদিন আগে, হামাস নেতা ইসমাইল হানিয়াকে ইরানের রাজধানী তেহরানে হত্যা করে ইসরায়েলি গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদ। এ জন্য তারা ইরানের নিরাপত্তা এজেন্ট ভাড়া করেছিল বলে পরবর্তী সময়ে ইরানি অনুসন্ধানে প্রকাশ পায়।

গত বছরের ৭ অক্টোবর হামাস ইসরায়েলে আক্রমণ চালানোর ফলে শুধু হামাস নির্মূল নয়, ইরান সমর্থিত লেবাননভিত্তিক প্রতিরোধ গোষ্ঠী হিজবুল্লাহকে শায়েস্তা করার জন্য ইসরায়েল সর্বোচ্চ সামরিক ও গোয়েন্দা শক্তি প্রয়োগ করছে। যার সাম্প্রতিক উদাহরণ হিসেবে হিজবুল্লাহ সংশ্লিষ্ট যোগাযোগ রক্ষাকারী যন্ত্রের বিস্ফোরণ ঘটানো। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংবাদ মাধ্যমের তথ্য অনুযায়ী, এতে অন্তত ৩৭ জন নিহত হয় এবং আহত হয় প্রায় তিন হাজারেরও বেশি মানুষ। নিহতদের মধ্যে শিশুসহ বেসামরিক জনগোষ্ঠীও ছিল। লেবাননে ইসরায়েলি নজরদারি থেকে রক্ষা পেতে হিজবুল্লাহ মোবাইল ফোনের পরিবর্তে পেজার ব্যবহার করে থাকে।

হামাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধে ইসরায়েল গাজাবাসী ফিলিস্তিনিদের ওপর যে বর্বর হত্যাযজ্ঞ চাপিয়ে দেয় তার প্রতিবাদে ইরান সমর্থিত লেবাননের হিজবুল্লাহ, ইয়েমেনের হুথি বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলো ইসরায়েলকে গাজায় হামলা বন্ধের জন্য চাপ দিয়ে আসছিল এবং ফিলিস্তিনিদের সমর্থনে উত্তর ইসরায়েলের ওপর ধারাবাহিক রকেট হামলা চালিয়ে যাচ্ছে।

গৃহযুদ্ধের সময় হিজবুল্লাহ লেবাননে বিশেষ করে দক্ষিণ লেবাননে একটি শক্তিশালী সামরিক ও রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। যারা মূলত দক্ষিণ লেবাননের শিয়া ধর্মাবলম্বীদের দ্বারা তৈরি ও ইরান সমর্থিত ও ইরানি বিপ্লব দ্বারা অনুপ্রাণিত। হিজবুল্লাহ দক্ষিণ লেবাননে দখলদার ইসরায়েলি বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলে। ২০০৬ সালে ইসরায়েলি সামরিক বাহিনী ও হিজবুল্লাহর মধ্যে সর্বাত্মক যুদ্ধ ছড়িয়ে পড়ে। সেই যুদ্ধে দক্ষিণ লেবাননের একটি বড় এলাকা ধ্বংসযজ্ঞে পরিণত হয়, ইসরায়েলও হিজবুল্লাহর সক্ষমতা ধ্বংস করতে তৎপর হয়ে ওঠে। ২০০৬-এর যুদ্ধে ১১০০’র বেশি সাধারণ মানুষ ও হিজবুল্লাহ যোদ্ধা নিহত হয়। অন্যদিকে ইসরায়েলি পক্ষে ১২০ জন আইডিএফ সদস্য ও ৪০ জন বেসামরিক মানুষ নিহত হয়।

হিজবুল্লাহ ও ইসরায়েলের মধ্যে সংঘাত ১৯৮০-এর দশকের গোড়ার দিকে শুরু হয় যখন হিজবুল্লাহ প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। ২০০৬ সালের যুদ্ধে হিজবুল্লাহ ইসরায়েলি বাহিনীকে পিছু হটতে বাধ্য করেছিল। বিশেষ করে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদেও ১৭০১ নম্বর প্রস্তাবের ভিত্তিতে ওই ঐতিহাসিক বিজয় অর্জিত হয়। বিভিন্ন তথ্য মতে, বর্তমানে হিজবুল্লাহর প্রায় এক লাখের মতো সামরিক সদস্য আছে। অবশ্য কিছু পশ্চিমা তথ্য এই সংখ্যাটিকে ৫০ হাজার বলে ঘোষণা করেছে। হিজবুল্লাহ তার অস্ত্রভাণ্ডারের মাধ্যমে ইসরায়েলের গুরুত্বপূর্ণ সামরিক স্থাপনা ও অবকাঠামোকে তাদের আক্রমণের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করতে পারে। এসব অবকাঠামোর মধ্যে ইসরায়েলের হাইফা বন্দরও রয়েছে। ইরানের প্রযুক্তিতে নির্মিত তাদের ক্ষেপণাস্ত্র ও ড্রোনের তেমন সক্ষমতাই আছে।

ইসরায়েলের গাজা আক্রমণের শুরু থেকে ইসরায়েল ও হিজবুল্লাহর মধ্যে যে উত্তেজনা চলছিল তার পারদ আরও চড়তে শুরু করে গত ১৭ ও ১৮ সেপ্টেম্বর লেবানন ও সিরিয়ার অসংখ্য যোগাযোগ স্থাপনকারী যন্ত্র পেজার ও ওয়াকিটকি বিস্ফোরণের ঘটনার মাধ্যমে। হিজবুল্লাহর অভিযোগ, এসব যন্ত্রে ইসরায়েলি গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদ বিস্ফোরক স্থাপন করেছিল। ঘটনার পর থেকে হিজবুল্লাহর পক্ষ থেকে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে যোগ্য প্রতিশোধ গ্রহণের হুমকি দেওয়া হয়। হিজবুল্লাহ নেতা হাসান নাসরুল্লাহ ১৯ সেপ্টেম্বর এক টিভি ভাষণে এর কড়া জবাব দেন। এর পরপরই হিজবুল্লাহর রাতভর রকেট হামলায় ইসরায়েলের হাইফা, আফুলা, নাজারেথ ও উত্তর ইসরায়েলের অন্যান্য শহরে সাইরেন বেজে ওঠে। ইরান সমর্থিত গোষ্ঠীটি বলেছে যে, বেশ কয়েকটি ইসরায়েলি সামরিক ও বিমানঘাঁটি লক্ষ্য করে হামলা চালানো হয়েছে। ইসরায়েলের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, হিজবুল্লাহ উত্তর ইসরায়েলে কয়েকশ রকেট নিক্ষেপ করেছে যার প্রায় সবগুলোই তাদের আয়রন ডোম ধ্বংস করতে পেরেছে। অন্যদিকে এর জবাবে ইসরায়েল দক্ষিণ লেবাননের জনবহুল এলাকায় বিমান হামলা চালায়। যদিও ইসরায়েল জানিয়েছে, তারা হিজবুল্লাহর সামরিক লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত করেছে। লেবাননের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের বরাতে বিবিসি জানিয়েছে ইসরায়েলি হামলায় লেবাননে ৫৫০ জন নিহত হয়, যার মধ্যে ৫০ জন শিশু রয়েছে। হিজবুল্লাহ জানিয়েছে, হামলায় ইব্রাহিম আকিল নামে তাদের একজন শীর্ষ সামরিক কমান্ডার নিহত হন। এবারে ইসরায়েলের সবচেয়ে ভয়াবহ হামলাটি ছিল গত সোমবার যা ১৯৯০-এর গৃহযুদ্ধের পর এটাই ছিল সবচেয়ে ভয়াবহতম দিন। ইসরায়েলি হামলার ভয়ে হাজার হাজার মানুষ নিরাপদ আশ্রয়ের সন্ধানে দক্ষিণ লেবানন থেকে পালাচ্ছে, স্কুলে অস্থায়ী আশ্রয়কেন্দ্র খুলে অবস্থান করছে। জাতিসংঘ বলছে গত বছরের ৭ অক্টোবরের পর থেকে হামাসের ইসরায়েলে হামলার পর লেবানন ও ইসরায়েলের উভয় পক্ষের দুই লাখ মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছে। যার মধ্যে দক্ষিণ লেবানন থেকে প্রায় সোয়া লাখ মানুষের বাস্তুচ্যুত হওয়ার খবর পাওয়া যাচ্ছে।

যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে বৈরুতে আক্রমণের আগে ইসরায়েল ওয়াশিংটনকে হামলা সম্পর্কে অবহিত করেনি। তবে বরাবরের মতো যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, তারা পরিস্থিতি শান্ত করার জন্য কাজ করছে ও উভয়পক্ষকে আহ্বান জানাচ্ছে। যাতে দক্ষিণ লেবানন ও উত্তর ইসরায়েলের বাস্তুচ্যুত অধিবাসীরা ফিরে আসতে পারে। ইসরায়েল বলছে উত্তর ইসরায়েলের অধিবাসীদের নিরাপত্তার জন্য তারা লেবাননের ওপর না, হিজবুল্লাহর ওপর হামলা চালিয়েছে। কিন্তু আসল কারণ অন্য কোথাও। আর সেটা হচ্ছে মধ্যপ্রাচ্যে ইসরায়েলের আধিপত্যবাদী ও দখলদারিত্ব নীতি। লেবাননে হামলার পরিপ্রেক্ষিতে অদূর ভবিষ্যতে গাজার মতো পরিস্থিতি সৃষ্টি হতে পারে লেবাননে। এমনই আশঙ্কা প্রকাশ করলেন রাষ্ট্রপুঞ্জের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস। তিনি বলেন, ‘লেবাননে আর একটি গাজার পরিস্থিতির অভিঘাত বিশ্বের পক্ষে সামলানো কঠিন হবে।’ ইসরায়েল বর্তমান পরিস্থিতিকে যুদ্ধের একটি নতুন অবস্থা বলছে এবং উত্তর সীমান্তে ভারী যুদ্ধাস্ত্রসহ সৈন্য সরবরাহ ও সমাবেশ করেছে। সর্বাত্মক যুদ্ধ লেগে গেলে ইসরায়েলকে বিপদের মুখে পড়তে হতে পারে বলে আশঙ্কা করেছে সংবাদমাধ্যম সিএনএন। প্রতিরক্ষা বিশারদদের একাংশের মতামত তুলে ধরে তারা জানিয়েছে, আয়রন ডোম-সহ ইসরায়েলের আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাগুলোতে যত ক্ষেপণাস্ত্র রয়েছে, তার চেয়ে হিজবুল্লাহর ক্ষেপণাস্ত্র এবং ড্রোনের সংখ্যা বেশি। সে কারণে তাদের হামলা পুরোপুরি ঠেকানো ইসরায়েলি সেনার এয়ার ডিফেন্স ইউনিটগুলোর পক্ষে সম্ভব নাও হতে পারে। লেবাননের ওপর আক্রমণের মধ্য দিয়ে ইসরায়েল হিজবুল্লাহকে নিরস্ত্র করতে চায় বলে জানিয়েছে। এর মাধ্যমে উত্তর ইসরায়েলের যে ৬০ হাজার ইসরায়েলিকে তারা সরিয়ে নিতে বাধ্য হয়েছে তাদের ফিরিয়ে আনতে চাচ্ছে। তবে এই আক্রমণের মাধ্যমে ইসরায়েল মধ্যপ্রাচ্যে উত্তেজনা জিইয়ে রাখতে চাচ্ছে। এভাবে বিমান আক্রমণ করে হিজবুল্লাহর মতো প্রতিরোধ শক্তিকে দমন করা সম্ভব না, তা ইসরায়েলি কর্র্তৃপক্ষও বোঝে। তবে এই হতাহতের মধ্য দিয়ে একজন লাভবান হচ্ছেন, আর তিনি হচ্ছেন ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু। যুদ্ধের দামামা টিকিয়ে রেখে তিনি ক্ষমতার মসনদকে পাকাপোক্ত করতে চাচ্ছেন। নেতানিয়াহু ভালোভাবেই জানেন যুদ্ধের উত্তেজনা শেষ হয়ে গেলে তার পক্ষে আর ক্ষমতায় থাকা সম্ভব হবে না। নেতানিয়াহুর বিরুদ্ধে ইসরায়েলিদের মধ্যে অসন্তোষ চরমে। যে কারণে বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ছে। যুদ্ধ শেষে শুধু ক্ষমতাচ্যুতই নয়, ক্ষমতা ছাড়লেই দুর্নীতির অভিযোগে বিচারের মুখোমুখি হতে হবে তাকে। আর নেতানিয়াহু তা ভালোভাবেই জানেন। কেনই-বা তিনি যুদ্ধ বন্ধ চাইবেন? বরং যুদ্ধের নতুন নতুন ফ্রন্ট খুলে ক্ষমতাকে দীর্ঘায়িত করতে চাইবেন। রাজনীতির এই মারপ্যাঁচে তিনি কতটুকু সফল হতে পারেন তাই এখন দেখার বিষয়। কারণ হিজবুল্লাহ প্রতিরোধ যুদ্ধ হামাসের তুলনায় অনেক গুণ শক্ত, যা ইসরায়েল এর আগেও ২০০৬ সালে টের পেয়েছে। পাশাপাশি গত প্রায় এক বছর ধরেই চলতে থাকা যুদ্ধ ইসরায়েলি সামরিক বাহিনী আইডিএফ কতটা চালিয়ে নিতে পারে তাও প্রশ্নসাপেক্ষ। তবে পরিস্থিতি যাই হোক না কেন, পশ্চিমাদের সহযোগিতায় ইসরায়েল ও নেতানিয়াহু যে আরও শিশু, নারী ও সাধারণ মানুষের হত্যার কারণ হবে তা বলার অপেক্ষা রাখে না। এর ফলে নেতানিয়াহু লাভবান হলেও ইসরায়েলের নিরাপত্তা কতটা সংহত হবে তা ভবিষ্যৎই বলে দেবে তবে ইতিহাস এর পক্ষে সাক্ষ্য দেয় না।

লেখক” উন্নয়নকর্মী ও কলামিস্ট
psmiraz@yahoo.com

Please Share This Post in Your Social Media

© All rights reserved © 2023
Developed by : JM IT SOLUTION