শুক্রবার, ২৭ Jun ২০২৫, ০৯:২০ অপরাহ্ন

দৃষ্টি দিন:
সম্মানিত পাঠক, আপনাদের স্বাগত জানাচ্ছি। প্রতিমুহূর্তের সংবাদ জানতে ভিজিট করুন -www.coxsbazarvoice.com, আর নতুন নতুন ভিডিও পেতে সাবস্ক্রাইব করুন আমাদের ইউটিউব চ্যানেল Cox's Bazar Voice. ফেসবুক পেজে লাইক দিয়ে শেয়ার করুন এবং কমেন্ট করুন। ধন্যবাদ।

বিশ্ব শ্রমবাজারে উচ্চাশা

মোস্তফা কামাল:
কেবল নোবেল জয়, বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান বলেও নয় আরও নানা কারণেই বিশ্বে প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূস একটি ব্র্যান্ড। তার অর্থনীতি-সোশ্যাল বিজনেসের নানা তত্ত্ব আলোচিত গোটা বিশ্বে। বাস্তবায়নও হচ্ছে প্রতিবেশী ভারত থেকে শুরু করে যুক্তরাষ্ট্রসহ বিশ্বের দেশে দেশে। পোশাকশিল্পকে টেনে তুলতে এই ব্র্যান্ডকে কাজে লাগানোর অপেক্ষায় বিজিএমইএসহ এ খাত সংশ্লিষ্টরা। হাতছাড়া হয়ে যাওয়া অর্ডার ফেরাতে, বায়ার জোগাতে ইউনূস টনিক এরইমধ্যে প্রয়োগ শুরু হয়েছে। এখন ফল মেলার অপেক্ষা। এই যাত্রাপথে নানা বাধা। দেশের শিল্পাঞ্চলগুলোতে শ্রমিক অসন্তোষ ছড়ানোর অবিরাম উসকানি।

ড. ইউনূসকে নিয়ে উচ্চাশার আরেকটি জায়গা শ্রম রপ্তানি খাত। গেল ১৫-১৬ বছরে সর্বনাশের তেমন বাকি রাখা হয়নি এ সেক্টরে। এর মধ্যেই সেখানে মরুভূমিতে কয়েক বিন্দু পানির ছিটা পড়ল মালয়েশিয়ার সঙ্গে। নির্ধারিত সময় ৩১ মের মধ্যে মালয়েশিয়ায় যেতে না পারা প্রায় ১৭ হাজার কর্মী টাকা ফেরত পাওয়ার অনিশ্চয়তার মধ্যে শুক্রবার ঢাকা সফরে আশার বার্তা দেন দেশটির প্রধানমন্ত্রী আনোয়ার ইব্রাহিম। তবে পদ্ধতি ও কোনো কর্মীর জন্য এই ঘোষণা নিয়ে ছিল সংশয়। এমন সংশয়ের মধ্যে স্বাভাবিকভাবেই প্রত্যাশার কিছু বিষয়-আশয় রয়েছে আনোয়ার ইব্রাহিমের ঘণ্টা কয়েকের ঢাকা সফরের মধ্যে।

বাংলাদেশের স্বাধীনতাকে স্বীকৃতি দেওয়া মুসলিম রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে প্রথম দেশ মালয়েশিয়া। ১৯৭২ সালের ৩১ জানুয়ারি বাংলাদেশের স্বাধীনতাকে স্বীকৃতি দেয় দেশটি। মালয়েশিয়ার সঙ্গে বাংলাদেশের বাণিজ্যিক ও অর্থনৈতিক সম্পর্ক দীর্ঘদিনের। এ সম্পর্ক আরও বাড়ানোর সুযোগ অনেক। মাঝেমধ্যে তাতে ছেদ পড়েছে, নষ্ট হয়েছে। আবার জোড়াতালির গাঁথুনি দেওয়া হয়েছে। কিন্তু সময়ে সময়ে আবার গোলমাল বেধেছে। এমন প্রেক্ষাপটে কয়েক ঘণ্টার ঝটপট সফর করে গেলেন মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী আনোয়ার ইব্রাহিম। সম্পর্কে তিনি বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা নোবেল লরিয়েট ড. মুহাম্মদ ইউনূসের ঘনিষ্ঠ বন্ধু। আনোয়ার ইব্রাহিমই প্রথম সরকারপ্রধান, যিনি দায়িত্ব গ্রহণের পর অন্তর্বর্তী সরকারকে অভিনন্দন জানিয়েছেন। আবার বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠনের দুমাসের মধ্যে কোনো দেশের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে প্রথম ব্যক্তি আনোয়ার ইব্রাহিম বাংলাদেশ সফর করলেন। এ ছাড়া প্রায় ১১ বছর পর মালয়েশিয়ার কোনো প্রধানমন্ত্রী বাংলাদেশ সফর করলেন। সর্বশেষ ২০১৩ সালের নভেম্বরে সরকারি সফরে ঢাকায় এসেছিলেন মালয়েশিয়ার তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী নাজিব রাজাক। সামগ্রিক এ আবহের মধ্যে বাংলাদেশ ও মালয়েশিয়ার সম্পর্ক নতুন বাঁকে যাওয়ার সমীকরণ মেলাচ্ছেন কেউ কেউ। সফরে আসার পর বিমানবন্দরের আনুষ্ঠানিকতা শেষে এক গাড়িতে চড়ে আনোয়ার-ইউনূস দুই বন্ধু হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে পৌঁছেন। প্রটোকল মতো দ্বিপক্ষীয় বৈঠক করেন। পরে রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিনের সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎও করেন মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী। সামগ্রিক এ বাস্তবতায় ছোট্ট সফরটি অবশ্যই বড় প্রোফাইলের।

অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস বাংলাদেশের মানুষের প্রত্যাশা পূরণে সক্ষম বলেও আশাবাদ আনোয়ার ইব্রাহিমের। আর ড. ইউনূসের বিশ্বাস, দুদেশের সম্পর্ক উন্নীত হবে নতুন উচ্চতায়। বৈঠকে ফ্রি ট্রেড এগ্রিমেন্ট, নতুন কর্মসংস্থান তৈরি এবং ভিসা সহজীকরণের বিষয়ে আলোচনা হয়। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রতি সমর্থন জানিয়ে, বাংলাদেশের এগিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে সর্বাত্মক সহযোগিতার আশ্বাস দেন। তাদের আলোচনায় অর্থনৈতিক সহযোগিতা, রাজনৈতিক সম্পর্ক, বাণিজ্য ও বিনিয়োগ, শ্রম অভিবাসন, শিক্ষা, প্রযুক্তি, অবকাঠামোগত উন্নয়ন, প্রতিরক্ষা সহযোগিতাসহ পারস্পরিক স্বার্থসম্পর্কিত বিস্তৃত বিষয়গুলো প্রাধান্য পায়। বৈঠক শেষে যৌথ বিফ্রিংয়ে নানা জটিলতায় মালয়েশিয়ায় যেতে না পারা ১৮ হাজার কর্মীকে প্রথম দফায় সহযোগিতার আশ্বাসও দেওয়া হয়। আনোয়ার ইব্রাহিম বলেন, মালয়েশিয়ার জনশক্তি প্রয়োজন তবে উভয় দেশের মধ্যে অভিবাসন প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতা থাকতে হবে। এরপর বঙ্গভবনে রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিনের সঙ্গে সাক্ষাতের সময়ও উঠে আসে শ্রমশক্তির কথা। মালয়েশিয়ার সঙ্গে বাংলাদেশের এটিই বেশি প্রাসঙ্গিক। রাষ্ট্রপতিও যথারীতি আরও বাংলাদেশি জনশক্তি মালয়েশিয়ায় নিতে সহযোগিতা চেয়েছেন। বাংলাদেশ থেকে যাতে আরও দক্ষ ও আধাদক্ষ জনশক্তি মালয়েশিয়ায় যেতে পারে সে ব্যাপারে দেশটির প্রধানমন্ত্রী আনোয়ার ইব্রাহিমের সহযোগিতা চেয়েছেন রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন। তার সঙ্গে সাক্ষাৎকালে আনোয়ার ইব্রাহিম বাংলাদেশি জনশক্তি মালয়েশিয়ার আর্থসামাজিক উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে বলে উল্লেখ করেন। তিনি মালয়েশিয়ায় জনশক্তি রপ্তানির ক্ষেত্রে স্বচ্ছ প্রক্রিয়া নিশ্চিত করার ওপর জোর দেন। প্রশ্ন বা গোলমাল তো এই ‘জোর’ দেওয়ার মধ্যেই। মালয়েশিয়ায় জনশক্তি রপ্তানির ক্ষেত্রে স্বচ্ছতার ‘স্ব’ও রাখতে পারেনি বাংলাদেশ।

মালয়েশিয়ায় শ্রমবাজারের কফিনে শেষ পেরেকটা মেরে দিয়ে গেছেন সাবেক অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামালসহ বিশেষ চক্রটি। তার স্ত্রী কাশমেরী কামাল ও মেয়ে নাফিসা কামাল চক্র মালয়েশিয়ায় কর্মী পাঠানোর নামে হাজার-হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন বলে প্রচারিত। দুর্নীতি দমন কমিশন-দুদকের হাতে থাকা অভিযোগে টাকার এ অঙ্কটি প্রায় ২০ হাজার কোটি টাকা। এই কুকর্মে জড়িত সাবেক চার এমপি। চক্রটি চাকরির মিথ্যা প্রতিশ্রুতি দিয়ে শ্রমিকদের কাছ থেকে বিপুল পরিমাণ অর্থ হাতিয়ে নিয়েছে। এর সঙ্গে জড়িত বাংলাদেশ ও মালয়েশিয়া সরকারের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা জড়িত। এত শ্রমিক পাঠালেও অনেকে কাজ করার অনুমতি না পাওয়ায় ফেরত এসেছেন। মালয়েশিয়ায় শ্রমিক পাঠাতে সরকার নির্ধারিত জনপ্রতি ব্যয় হয় ৭৯ হাজার টাকা। বাস্তবে নেওয়া হয়েছে অনেক বেশি। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ভেরিটে ইনকরপোরেটেডসহ পাঁচটি সংস্থার গবেষণায় বেরিয়ে আসে, মালয়েশিয়া যেতে গড়ে একজন বাংলাদেশি কর্মী পাঁচ লাখ ৪৪ হাজার টাকা খরচ করেছেন। সরকার নির্ধারিত ফি’র চেয়ে বেশি নেওয়া হয়েছে প্রায় ২০ হাজার কোটি টাকা। প্রায় চার বছর বন্ধ থাকার পর ২০২২ সালের জুলাইতে মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার খুললে কর্মী পাঠাতে রিক্রুটিং এজেন্সি নির্বাচনের দায়িত্ব পায় মালয়েশিয়া। তাদের কাছে এক হাজার ৫২০টি রিক্রুটিং এজেন্সির তালিকা পাঠায় প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়। কিন্তু মাত্র ২৫টি এজেন্সির নাম নির্বাচন করা হয়। এজেন্সি বাছাইয়ের ক্ষেত্রে কোনো নীতিমালা ছিল না। এ সুযোগে সাবেক অর্থমন্ত্রী মুস্তফা কামাল ও তার পরিবার এবং সাবেক ওই তিন এমপি ছাড়াও আওয়ামীপন্থি লোকজনের মালিকানাধীন নতুন অনেক প্রতিষ্ঠান বিপুলসংখ্যক কর্মী পাঠিয়েছে।

অন্যদিকে অনেক শ্রমিক মালয়েশিয়ায় গিয়ে নানা জটিলতায় কাজ পাননি। কেউ কেউ ঋণ করে গিয়ে খালি হাতে ফিরে এসেছেন। বিদেশে কর্মী পাঠাতে ২০১৮ সালের ডিসেম্বরে রিক্রুটিং এজেন্সির লাইসেন্স নেন ফেনী আওয়ামী লীগের সাবেক সংসদ সদস্য নিজাম উদ্দিন হাজারী। তার মালিকানাধীন স্নিগ্ধা ওভারসিজ লিমিটেড লাইসেন্স নেওয়ার সাড়ে তিন বছরে ১০০ কর্মী বিদেশ পাঠায়। অথচ এই সিন্ডিকেটে যোগ দেওয়ার পর গত দেড় বছরে দেশটিতে প্রায় আট হাজার কর্মী পাঠায় স্নিগ্ধা ওভারসিজ লিমিটেড। ফেনী-৩ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মাসুদ উদ্দিন চৌধুরীর ফাইভ এম ইন্টারন্যাশনাল ৮ হাজার ৫৯২ জন, ঢাকা-২০ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য বেনজীর আহমেদের প্রতিষ্ঠান আহমেদ ইন্টারন্যাশনাল ৭ হাজার ৮৪৯ জন এবং সাবেক অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামালের স্ত্রী কাশমেরী কামালের অরবিটালস এন্টারপ্রাইজ ৭ হাজার ১৫২ জন ও মেয়ে নাফিসা কামালের মালিকানাধীন অরবিটালস ইন্টারন্যাশনাল ২ হাজার ৭০৯ জন শ্রমিক পাঠিয়েছে। এভাবে যে যা পেরেছেন, করেছেন।

কেবল মালয়েশিয়া নয়, দেশে দেশে শ্রমবাজারকে টেনে তোলার ভার এখন ড. ইউনূসের ঘাড়ে। তিনি প্রবাসীদের বৈধপথে রেমিট্যান্স পাঠানোর আহ্বান জানিয়েছেন। এর সাফল্য মিলতে শুরু করেছে। প্রতিনিয়ত রেমিট্যান্স প্রবাহ বাড়ছে। ছাত্র-জনতার আন্দোলনে সংহতি জানিয়ে ‘রেমিট্যান্স শাটডাউন’ কর্মসূচি ঘোষণা করেন বিভিন্ন দেশে বসবাসরত প্রবাসীরা। এতে বড় প্রভাব পড়ে প্রবাসী আয়ে। দেশের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর এখন ভিন্ন চিত্র। গত আগস্টে ২২২ কোটি ডলারের রেমিট্যান্স পাঠিয়েছেন প্রবাসীরা। পরের মাস সেপ্টেম্বরে ২৪০ কোটি ডলারেরও বেশি। যা গত বছরের একই সময়ের চেয়ে ৮০ শতাংশেরও বেশি। গত মাস দুয়েকের এ চিত্র অবশ্যই আশা জাগানিয়া। সামনে এর ধারাবাহিকতা আশা করাই যায়। আবার পোশাক শিল্পে গতি ফেরানোর চেষ্টা বানচালে সাভার-আশুলিয়া কাণ্ডের মতো জনশক্তি রপ্তানি খাতে বাগড়া বাধানোর ধুরন্ধর মহলের কারসাজির শঙ্কাও থেকে যায়।

লেখক: সাংবাদিক-কলামিস্ট

ডেপুটি হেড অব নিউজ, বাংলাভিশন

mostofa71@gmail.com

ভয়েস/আআ/সূত্র: দেশরূপান্তর

Please Share This Post in Your Social Media

© All rights reserved © 2023
Developed by : JM IT SOLUTION