বুধবার, ১৩ অগাস্ট ২০২৫, ০৬:২২ পূর্বাহ্ন
মুফতি আশিকুর রহমান রাহমানী:
সাড়ে চৌদ্দশ বছর আগে মানুষ ছিল দিকভ্রান্ত ও পথহারা। মানুষের মধ্যে মনুষ্যত্ব বোধ ছিল না। দুর্বলদের ওপর অন্যায়-অবিচার ও জুলুম-নির্যাতন চলত। শিরক, কুফর ও কুসংস্কার তৎকালীন সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে ছড়িয়ে পড়েছিল। মহান আল্লাহ ঠিক তখনই অন্যায়-অবিচার ও জুলুম-নির্যাতন থেকে মানুষকে মুক্ত করার জন্য পৃথিবীতে প্রেরণ করেন সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ মানব হজরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে। তিনি এসে দিক হারা উম্মতকে দেখিয়েছেন হেদায়েত ও সফলতার পথ। তিনি এসেছিলেন সমগ্র জগতের জন্য রহমত হিসেবে। আল্লাহতায়ালা পবিত্র কোরআনে ইরশাদ করেছেন, ‘(হে নবী!) আমি আপনাকে বিশ^জগতের জন্য রহমতস্বরূপ পাঠিয়েছি।’ (সুরা আম্বিয়া ১০৭)
ইমাম তবারি (রহ.) বলেছেন, নবী মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম জগতের সবার প্রতি মহান আল্লাহর রহমত। মুমিন কাফের নির্বিশেষে সব মাখলুকই কেয়ামত পর্যন্ত এই মহান রহমতের মাধ্যমে উপকৃত হতে থাকবে। মুমিনকে তো আল্লাহতায়ালা তার মাধ্যমে হেদায়াত দান করেছেন। তার ওপর ইমান আনা এবং তিনি আল্লাহতায়ালার পক্ষ থেকে যে পয়গাম নিয়ে এসেছেন তা অনুযায়ী আমল করলে রয়েছে মহা পুরস্কার জান্নাত। আর এই উম্মতের অবিশ্বাসীদেরকে তার কারণে পূর্ববর্তী উম্মতের অবিশ্বাসীর মতো নগদ শাস্তি দেবেন না। (তাফসিরে তবারি ১৮/৫৫২)
আল্লাহতায়ালা তার মাধ্যমে অন্ধকারাচ্ছন্ন দুনিয়াকে আলোকিত করেন। পৃথিবীর মানুষকে শিক্ষা দেন সত্যিকারের মনুষ্যত্ব, মানবতা, সভ্যতা, রুচি ও বোধের স্বচ্ছতা, নৈতিক ও চারিত্রিক পবিত্রতা এবং ইমান ও তাওহিদের বিশুদ্ধতা। এজন্য রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর প্রতি মহব্বত ও ভালোবাসা ইমানের অংশ। তার ভালোবাসা ছাড়া ইমান অপূর্ণ। ইমানের স্বাদ আস্বাদনের জন্য আল্লাহ ও তার রাসুল (সা.)-কে সবচেয়ে প্রিয়রূপে গ্রহণ করতে হবে। হাদিসে ইরশাদ হয়েছে, তিনটি গুণ যার মধ্যে থাকবে, সে ইমানের স্বাদ আস্বাদন করবে। তার মধ্যে প্রথমটি হলো, যার কাছে আল্লাহ ও তার রাসুল সবচেয়ে প্রিয় হবে। (সহিহ মুসলিম) রাসুল (সা.) আরও ইরশাদ করেছেন, তোমাদের কেউ মুমিন হতে পারবে না, যতক্ষণ আমি তার কাছে তার মা-বাবা, সন্তানসন্ততি ও অন্য সব মানুষ থেকে বেশি প্রিয় না হব। (সহিহ বুখারি) এ বিষয়ে রাসুল (সা.) আরও ইরশাদ করেছেন, ওই সত্তার শপথ, যার হাতে আমার জীবন, ততক্ষণ পর্যন্ত তুমি মুমিন হতে পারবে না, যতক্ষণ আমি তোমার কাছে তোমার জানের চেয়েও অধিক প্রিয় না হব। (সহিহ বুখারি)
উল্লিখিত হাদিসগুলোতে বর্ণিত হয়েছে, রাসুল (সা.)-কে কেমন ভালোবাসতে হবে। রাসুল (সা.)-এর প্রতি সাহাবায়ে কেরামের এমন ভালোবাসাই ছিল। তারা রাসুল (সা.)-কে মা-বাবা, সন্তানসন্ততি, এমনকি নিজ প্রাণের চেয়েও বেশি ভালোবাসতেন। তাদের পুরো জীবনই ছিল নবী প্রেমের প্রতিচ্ছবি। ইবাদত-বন্দেগি, লেনদেন, চলাফেরা, আখলাক-চরিত্র থেকে শুরু করে জীবনের সর্বত্রই ছড়িয়েছিল তার সুন্নাতের জ্যোতি। নবী প্রেম তাদের জীবন-জগতকে করেছিল জ্যোর্তিময়। নবী প্রেমের যে দৃষ্টান্ত তারা স্থাপন করে গেছেন, মানব ইতিহাসে সেটার দৃষ্টান্ত নেই। কাফেররা পর্যন্ত তা স্বীকার করেছে। রাসুল (সা.)-এর প্রতি সাহাবায়ে কেরামের ভালোবাসার ঘটনাবলি হাদিস, সিরাত ও ইতিহাসের কিতাবে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে। রাসুল (সা.)-কে সাহাবায়ে কেরামের মতো ভালোবাসে আমরাও হতে পারি সৌভাগ্যশালী আলোকিত মানুষ। রাসুল (সা.)-এর প্রতি সাহাবায়ে কেরামের ভালোবাসার কিছু দৃষ্টান্ত উপস্থাপন করা হলো।
এক. হাদিসে বর্ণিত হয়েছে, হজরত ওমর (রা.) রাসুল (সা.)-কে বললেন, হে আল্লাহর রাসুল! আপনাকে সবচেয়ে বেশি ভালোবাসি, তবে নিজের জানের চেয়ে বেশি নয়। রাসুল (সা.) বললেন, তাহলে তো এখনো (ইমান পরিপূর্ণ) হয়নি। যার হাতে আমার প্রাণ তার শপথ! যতক্ষণ পর্যন্ত আমি তোমার জানের চেয়েও বেশি প্রিয় না হব, ততক্ষণ তোমার ইমান পরিপূর্ণ হবে না। কিছুক্ষণ পর ওমর (রা.) বললেন, আল্লাহর শপথ! এখন আপনি আমার কাছে আমার জানের চেয়েও বেশি প্রিয় হয়ে গেছেন। রাসুল (রা.) বললেন, হ্যাঁ, ওমর! এখন তোমার ইমান পরিপূর্ণ হয়েছে। (সহিহ বুখারি) রাসুল (সা.)-এর প্রতি ভালোবাসাই হচ্ছে মুমিনের ইমান।
দুই. ওহুদ যুদ্ধ শেষ। রাসুল (সা.)-সহ সাহাবিরা যুদ্ধক্ষেত্র থেকে মদিনায় ফিরছিলেন। তারা বনু দিনার গোত্রের পাশ দিয়ে যখন যাচ্ছিলেন, তখন হজরত সুমাইয়া বিনতে কায়েসের সঙ্গে সাক্ষাৎ হয়। যুদ্ধ ফেরত সাহাবিরা হজরত সুমাইয়া (রা.)-কে বললেন, তোমার স্বামী, ভাই ও বাবা যুদ্ধে শহীদ হয়েছেন। তিনি নিজ স্বামী, ভাই ও বাবার শাহাদাতের কথা শোনার পরও কোনো প্রতিক্রিয়া না দেখিয়ে জানতে চাইলেন, নবীজি কেমন আছেন? তিনি বেঁচে আছেন তো? যুদ্ধ ফেরত সাহাবিরা বললেন, আপনি যেমন কামনা করছেন, আলহামদুলিল্লাহ! তিনি ভালো আছেন। এবার হজরত সুমাইয়া বললেন, তাহলে তাকে একটু দেখান। আমি তার জ্যোতির্ময় চেহারা মোবারক একটু দেখে নিই। রাসুল (সা.)-এর প্রতি ইশারা করে তাকে দেখানো হলো। দেখামাত্রই তিনি চিৎকার করে বলে উঠলেন, হে আল্লাহর রাসুল! আপনাকে সুস্থ দেখার পর সব বিপদ (স্বামী, ভাই ও বাবার মৃত্যু) আমার কাছে তুচ্ছ। অর্থাৎ এখন আর আমার মনে আমার স্বামী, ভাই বা বাবাকে হারানোর কোনো কষ্ট নেই। আপনাকে সুস্থ পেয়ে সব কিছুই আমি ভুলে গেছি। (আলবিদায়া ওয়ান নিহায়া)
তিন. প্রথম খলিফা আবু বকর সিদ্দিক (রা.) মৃত্যুশয্যায় শায়িত। এ অবস্থায় তার প্রিয় কন্যা নবীপতœী আয়েশা (রা.) এলেন। তিনি মেয়েকে জিজ্ঞাসা করলেন, রাসুল (সা.) কোন দিন ইন্তেকাল করেছেন? আয়েশা (রা.) বললেন, সোমবার। তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, আজ কী বার? আয়েশা (রা.) বললেন, সোমবার। আবু বকর সিদ্দিক (রা.) বললেন, আমি আশা করি, এখন থেকে রাতের মধ্যে আমার মৃত্যু হবে। (সহিহ বুখারি) এটা থেকে অনুমান করা যায়, আবু বকর (রা.) নবীজিকে কতটা ভালোবাসতেন, যার ফলে তিনি আকাক্সক্ষা করেন, নবীজি (সা.)-এর মৃত্যু যে দিন হয়েছে তার মৃত্যুও যেন সেদিনই হয়।
চার. আয়েশা (রা.) থেকে বর্ণিত, এক ব্যক্তি রাসুল (সা.)-এর কাছে এসে বললেন, হে আল্লাহর রাসুল! আপনি আমার স্ত্রী, সন্তানসন্ততি এমনকি আমার প্রাণের চেয়েও বেশি প্রিয়। আমি যখন ঘরে থাকি এবং আপনার কথা স্মরণ হয় তখন আপনাকে না দেখা পর্যন্ত ধৈর্য ধরতে পারি না। আর যখন আমার ও আপনার মৃত্যুর কথা স্মরণ হয় তখন আমি বুঝি, আপনি জান্নাতে নবীদের সঙ্গে উঁচু মাকামে থাকবেন। আর আমি জান্নাত পেলেও ভয় হয়, আপনাকে দেখতে পারব কি না। (তবারানি) রাসুল (সা.)-এর প্রতি এই সাহাবির কত গভীর মহব্বত! তার কথা স্মরণ হলে তাকে এক নজর না দেখা পর্যন্ত অস্থিরতা বোধ করেন এবং মৃত্যুর পরে জান্নাতে তাকে দেখতে পারবেন কি না তা নিয়েও চিন্তিত।
পাঁচ. ওহুদের যুদ্ধে শুরুর দিকে মুসলিমদের জয়ের পাল্লা ভারী ছিল। কিন্তু একপর্যায়ে কিছু বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়। এই সুযোগে কাফেররা রাসুল (সা.)-কে হত্যা করার অপচেষ্টায় লিপ্ত হয়। কিন্তু কিছু সাহাবি জীবন বাজি রেখে তার সামনে সুদৃঢ় প্রাচীরের মতো দাঁড়িয়ে থেকে কাফেরদের আক্রমণ প্রতিহত করেন। এতে তাদের কেউ নিহত, কেউ আহত হন। এমন বীর ও সাহসী সাহাবিদের অন্যতম আবু তালহা (রা.)। তিনি সুদক্ষ তিরন্দাজ ছিলেন। কাফেররা যখন রাসুল (সা.)-কে লক্ষ্য করে তীর নিক্ষেপ শুরু করে তখন তিনি ঢাল হাতে নিয়ে তার সামনে প্রাচীরের মতো দাঁড়িয়ে ছিলেন। রাসুল (সা.) উঁকি দিয়ে কাফেরদের অবস্থা দেখতে চাইলে তিনি বলতেন, হে আল্লাহর নবী! আমার মা-বাবা আপনার ওপর কোরবান হোক। আপনি উঁকি দেবেন না। হয়তো আপনার গায়ে কোনো তীর এসে লেগে যাবে। আমার বুক আপনার জন্য উৎসর্গিত। (সহিহ বুখারি) এটা সত্যিকারের ভালোবাসার প্রকাশ। নিজে আহত হবেন, নিহত হবেন; কিন্তু প্রেমাস্পদ যেন নিরাপদ থাকেন। রাসুল (সা.)-কে লক্ষ্য করে কাফেরদের নিক্ষিপ্ত তীরে সাহাবি নিজে আহত হয়েছেন। তবুও তার গায়ে একটা তীরও লাগতে দেননি।
ভয়েস/আআ