মঙ্গলবার, ১২ অগাস্ট ২০২৫, ০৬:৫২ অপরাহ্ন
মুফতি আশিকুর রহমান রাহমানী:
হজরত রাসুলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে ভালোবাসা ইমানের দাবি। তিনি ছিলেন পৃথিবীবাসীর জন্য আলোকবর্তিকা। তিনি পৃথিবীর মানুষকে ভ্রষ্টতার গাঢ় অন্ধকার থেকে উদ্ধার করে শাশ্বত আলোকোজ্জ্বল পথের ওপর প্রতিষ্ঠিত করেছেন এবং মানুষেকে দাসত্বের শৃঙ্খল থেকে মুক্ত করে মহান স্রষ্টার পথে নিয়ে এসেছেন। এমনকি মানবজগতের জীবনধারায় আমূল পরিবর্তন করে ইতিহাসের চরিত্রকেই পাল্টিয়ে দিয়েছেন। সেই মহামানব হজরত মুহাম্মদ (সা.)-কে কে না ভালোবাসবে? রাসুল (সা.)-এর প্রতি শ্রদ্ধা-ভক্তি রাখা এবং তাকে ভালোবাসা মুমিনের জন্য আবশ্যক। পবিত্র কোরআনে বর্ণিত হয়েছে, ‘আপনি বলুন, যদি তোমাদের কাছে আল্লাহ, তার রাসুল এবং আল্লাহর পথে জিহাদ করার চেয়ে বেশি প্রিয় হয় তোমাদের পিতা, সন্তান, ভাই, স্ত্রী ও পরিবার এবং যে সম্পদ তোমরা উপার্জন করেছ, যে ব্যবসা-বাণিজ্যে তোমরা মন্দার আশঙ্কা করছ, যে বাসস্থানকে তোমরা ভালোবাসো, তাহলে তোমরা অপেক্ষা করো আল্লাহর বিধান আসা পর্যন্ত, মহান আল্লাহ বিশৃঙ্খল জাতিকে সুপথ দেখান না। (সুরা তাওবা ২৪) উল্লিখিত আয়াতটি মহান আল্লাহ ও রাসুল (সা.)-কে সর্বাধিক ভালোবাসা আবশ্যক হওয়ার সবচেয়ে বড় প্রমাণ।
পুরুষ সাহাবিদের রাসুলপ্রেমের দৃষ্টান্তের কথা ব্যাপক আলোচিত হলেও সে তুলনায় নারী সাহাবিদের রাসুলপ্রেম, রাসুল (সা.)-এর প্রতি শ্রদ্ধা-ভক্তি ও আত্মত্যাগ নিয়ে খুব বেশি আলোচনা হয় না। অথচ রাসুল (সা.)-এর প্রতি তাদের ত্যাগ, শ্রদ্ধা-ভক্তি, অবদান ও আনুগত্যের নজির ছিল অতুলনীয়। নারী সাহাবিদের নবীপ্রেমের বিভিন্ন ঘটনা ইতিহাসের পাতায় উজ্জ্বল হয়ে আছে। এখানে নবীপ্রেমিক কয়েকজন মহীয়সী রমণীর ঘটনা উল্লেখ করা হচ্ছে। যাদের রাসুলপ্রেমের অনন্য ঘটনা ইতিহাসে অমর হয়ে আছে। এসব ঘটনা আমাদের হৃদয়েও নবীজির ভালোবাসার সৌধ নির্মাণে সাহায্য করবে।
উম্মে হাবিবা (রা.)-এর ঘটনা : ঐতিহাসিক মক্কা বিজয়ের পূর্ব মুহূর্তে একদিন কুরাইশ নেতা আবু সুফিয়ান মদিনায় হাজির। মদিনায় ঢুকেই তিনি নিজ কন্যা এবং রাসুল (সা.)-এর জীবন সঙ্গিনী উম্মে হাবিবার ঘরে প্রবেশ করলেন। আবু সুফিয়ান বিছানায় বসতে গেলে উম্মে হাবিবা (রা.) বিছানা গুটাতে শুরু করলেন। বিষয়টি লক্ষ করে আবু সুফিয়ান বিস্মিত হলেন। উম্মে হাবিবা (রা.)-কে জিজ্ঞাসা করলেন, মা আমি কি এ বিছানার উপযুক্ত নই? না এ বিছানা আমার উপযুক্ত নয় বলে তুমি মনে করছ? উম্মে হাবিবা বললেন, এটা আল্লাহর রাসুলের বিছানা। আর তুমি মুশরেক, নাপাক। তাই আমি চাই না যে, তুমি রাসুল (সা.)-এর বিছানায় বসো। এ কথা শুনে আবু সুফিয়ান মেয়ের কাছ থেকে বের হয়ে অন্যত্র চলে গেলেন। (আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া ৩/৪৭৩)
উম্মে আমারা (রা.)-এর ঘটনা : উম্মে সাদ বিনতে সাদ বলেন, আমি একদিন উম্মে আমারার কাছে গিয়ে বললাম, খালা! আপনার যুদ্ধ অভিজ্ঞতা সম্পর্কে কিছু বলুন। তিনি বললেন, উহুদ যুদ্ধে আমি সকালেই বের হয়ে পড়ি। লোকজন কী করছে তা আমি দেখছিলাম। আমার সঙ্গে একটি পানিভর্তি পাত্র ছিল। আমি রাসুল (সা.)-এর কাছ পর্যন্ত পৌঁছে যাই। সেখানে তার সাহাবিরা ছিলেন। তখন মুসলমানদের বিজয়ের পালা চলছিল। কিন্তু পরবর্তী সময়ে যখন মুসলমানরা পরাজিত হলেন, তখন আমি রাসুল (সা.)-এর কাছে গিয়ে আশ্রয় নিলাম। আমি তাকে রক্ষার জন্য সরাসরি যুদ্ধে লিপ্ত হই। তরবারি চালিয়ে এবং তীর নিক্ষেপ করে শত্রুদের দূরে তাড়িয়ে দিই। এতে আমি আহত হই। বর্ণনাকারী উম্মে সাদ বলেন, ‘আমি তার কাঁধে জখমের চিহ্ন দেখেছি। সেটি ছিল বৃত্তাকার গভীর গর্ত।’ কে এই আঘাত করেছিল তা আমি তাকে জিজ্ঞেস করি। তিনি বললেন, ওই আঘাত করেছিল অভিশপ্ত ইবনে কুমাইয়্যা। সাহাবিরা রাসুল (সা.) থেকে দূরে চলে যাওয়ার পর সে এসে বলল, মুহাম্মাদ কোথায় আমাকে দেখিয়ে দাও। তখন আমি নিজে, মুসআব ইবনে উমায়ের এবং অন্য কয়েকজন লোক রাসুল (সা.)-কে রক্ষার জন্য দাঁড়িয়ে গেলাম। তখন সে আমার ওপর এ আক্রমণ চালায়। (আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া ৩/১৬৪)
রাসুল (সা.)-এর নির্দেশ পালন : রাসুল (সা.) একবার মসজিদ থেকে বের হচ্ছিলেন। দেখলেন নারী-পুরুষ পাশাপাশি পথ চলছে। তখন (নারীদের লক্ষ্য করে নবীজি বললেন) তোমরা পুরুষদের পেছনে থাকো এবং পথের মাঝখানে না হেঁটে একপাশ দিয়ে হাঁটো। এরপর নারীদের এমন অবস্থা হয়েছিল যে, তারা রাস্তার পাশ দিয়ে এভাবে হাঁটতেন যে, তাদের কাপড় রাস্তার পাশের দেয়ালের সঙ্গে লেগে যেত। (সুনানে আবু দাউদ)
জয়নব বিনতে জাহাশ (রা.)-এর ঘটনা : একবার জয়নব বিনতে জাহাশ (রা.)-এর ভাই ইন্তেকাল করল। মৃত্যুর পর চতুর্থ দিন তিনি সুগন্ধি ব্যবহার করে বললেন, সুগন্ধি ব্যবহারের কোনো প্রয়োজন আমার ছিল না। তবে আমি রাসুল (সা.)-এর কাছে শুনেছি, কোনো নারীর জন্য স্বামী ছাড়া অন্যের মৃত্যুতে তিন দিনের বেশি শোক প্রকাশ করা বৈধ নয়। শুধু এ হুকুম পালনের জন্যই আমি এমন করেছি। (সুনানে আবু দাউদ)
জুলাইবিব (রা.)-এর ঘটনা : জুলাইবিব (রা.) রাসুল (সা.)-এর একজন সাহাবি। একদিন রাসুল (সা.) তাকে জিজ্ঞাসা করলেন, জুলাইবিব! তুমি বিবাহ করবে না? জুলাইবিব (রা.) তখন বললেন, হে আল্লাহর রাসুল! আমার অর্থসম্পদ ও বংশীয় আভিজাত্য বলতে কিছুই নেই। কে আমার কাছে তার মেয়ে বিবাহ দেবে? রাসুল (সা.) তখন এক আনসারি সাহাবিকে তার মেয়ের জন্য জুলাইবিবের পক্ষ থেকে বিয়ের প্রস্তাব দিলেন। আনসারি সাহাবি তার স্ত্রীর সঙ্গে পরামর্শ করে সিদ্ধান্ত জানানোর কথা বললেন। স্ত্রীর সঙ্গে কথা বললে তিনি কোনোভাবেই এ বিয়ের জন্য রাজি হচ্ছিলেন না। তবে তার কন্যা রাসুল (সা.)-এর প্রস্তাব শুনেছিল। বিশ্বাসের সুদৃঢ় পাহাড় তার হৃদয়ে প্রোথিত ছিল। তাতে প্রবাহিত ছিল নবীপ্রেমের স্বচ্ছ ঝর্ণাধারা। তাই বাবাকে বললেন, আপনারা রাসুল (সা.)-এর প্রস্তাবকে ফিরিয়ে দিচ্ছেন? না, এটা কখনোই হতে পারে না। আমি জুলাইবিবকে বিয়ে করব। অবশেষে বিবাহ হলো এবং ঘর আলোকিত করে একটি সন্তান জন্ম নিল। (মুসনাদে আহমাদ)
ফাতেমা বিনতে কায়েস (রা.)-এর ঘটনা : বিয়ে নারী-পুরুষ সবার জীবনে গুরুত্বপূর্ণ এক অধ্যায়। সুখী জীবন গঠনে উত্তম সঙ্গী সবাই প্রার্থনা করে। সবাই অনেক ভেবে এবং যাচাই-বাছাই করে সম্পর্কে জড়ায়। এমন বিষয় রাসুল (সা.)-এর হাতে ছেড়ে দিয়ে বিয়ে করার নজিরও স্থাপন করেছেন নারী সাহাবিরা। ফাতিমা বিনতে কায়েস (রা.) ছিলেন হিজরতকারী নারীদের অন্যতম। আবদুর রহমান ইবনে আউফ (রা.) তাকে বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছিলেন। তিনি ছিলেন অঢেল সম্পদের অধিকারী। অন্যদিকে রাসুল (সা.) উসামা ইবনে জায়েদ (রা.)-এর সঙ্গে বিয়ের ব্যাপারে ফাতিমা বিনতে কায়েস (রা.)-এর সঙ্গে কথা বলেছিলেন। ফাতিমা (রা.) বলেন, আমি রাসুল (সা.)-এর এ বাণী শুনেছিলাম, যে আমাকে ভালোবাসে সে যেন উসামাকেও ভালোবাসে। তাই তিনি যখন উসামা (রা.)-এর সঙ্গে বিয়ের ব্যাপারে আমার সঙ্গে কথা বলেন, আমি তখন বললাম, আমার বিষয়টি আপনার হাতে সোপর্দ করলাম। আপনি যার সঙ্গে ইচ্ছা আমাকে বিয়ে দিন। (সুনানে নাসায়ি)
রাসুল (সা.)-কে মসজিদের মিম্বর দান: মসজিদে নববীতে মিম্বর তৈরির আগে রাসুল (সা.) একটি খেজুর গাছের গুঁড়ির ওপর ভর দিয়ে জুমার দিনে খুতবা দিতেন। এক সময় রাসুল (সা.) মিম্বরের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন। তখন এক নারী সাহাবি খেদমতের নিয়তে এগিয়ে আসেন। আবু হাজিম ইবনে দিনার (রহ.) থেকে বর্ণিত, রাসুল (সা.) আনসারদের এক নারীর কাছে লোক পাঠিয়ে বলেছিলেন, তোমার কাঠমিস্ত্রিকে আমার জন্য কিছু কাঠ দিয়ে এমন জিনিস তৈরি করার নির্দেশ দাও, যেটার ওপর বসে আমি লোকদের সঙ্গে কথা বলতে পারি। এরপর ওই নারী তাকে আদেশ করেন এবং তিনি মদিনা থেকে ৯ মাইল দূরবর্তী গাবা এলাকার ঝাউ কাঠ দিয়ে তা তৈরি করে নিয়ে আসেন। মহিলাটি রাসুল (সা.)-এর কাছে তা পাঠিয়ে দেন। রাসুল (সা.)-এর আদেশে এখানেই তা স্থাপন করা হয়। (সহিহ বুখারি)
ভয়েস/আআ