মঙ্গলবার, ১২ অগাস্ট ২০২৫, ০৪:০৭ অপরাহ্ন
মাওলানা হাফেজ কাজী মারুফ বিল্লাহ:
হজরত রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যে সময় মক্কায় ইসলাম নিয়ে এসেছিলেন তখন পৃথিবীর অন্যতম সুপার পাওয়ার ছিল পারস্য। পারস্যের লোকজন ছিল জরথুস্ট্র ধর্মের অনুসারী। কোনো কোনো ঐতিহাসিক ধারণা করেন, জরথুস্ট্র নবী ছিলেন। তার ওপর প্রেরিত আসমানি গ্রন্থের নাম জেন্দাবেস্তা। তবে এ বিষয়ে বাস্তব কোনো প্রমাণ পাওয়া যায় না। বলা হয়, জরাথুস্ট্রের শিক্ষা ছিল একত্ববাদ। পরবর্তী সময়ে লোকজন সে শিক্ষা ভুলে অগ্নি উপসানায় ডুবে যায়। রাসুল (সা.)-এর সমসাময়িক পারস্যের সম্রাটের নাম ছিল কিসরা পারভেজ। তিনি ছিলেন দোর্দণ্ড প্রতাপের অধিকারী। অহংকারে তার পা মাটিতে পড়ত না। একদা তার সামনে বিনীত ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছেন নবীজির সাহাবি হুজায়ফার ছেলে আবদুল্লাহ (রা.)। তার হাতে গুরুত্বপূর্ণ চিঠি। সম্রাট পরাভেজ চিঠি নিয়ে পড়তে শুরু করলেন।
চিঠি পাঠিয়েছেন বিশ্বনবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)। সিরাত গবেষকরা বলেন, ষষ্ঠ হিজরির জিলহজ মাসে রাসুলুল্লাহ (সা.) পারস্যসহ সমসাময়িক শক্তিধর রাজাদের কাছে রিসালাতের দাওয়াত সম্পর্কিত চিঠি পাঠান। সম্রাট পারভেজের কাছে পাঠানো চিঠিটি ছিল এরকম, ‘বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম। শান্তি বর্ষিত হোক তার প্রতি, যে হেদায়াতের অনুসারী, আল্লাহ ও তার রাসুলের প্রতি বিশ্বাসী এবং যে সাক্ষ্য দেয়, আল্লাহ ছাড়া কোনো মাবুদ নেই, তিনি এক, তার কোনো শরিক নেই, মুহাম্মাদ (সা.) আল্লাহর বান্দা ও রাসুল। আমি আল্লাহর নির্দেশে আপনাকে ইসলাম গ্রহণের জন্য দাওয়াত দিচ্ছি। আমাকে বিশ্ববাসীর জন্য রহমত হিসেবে পাঠানো হয়েছে। আমি আল্লাহর বান্দাদের সতর্ক করি এবং অস্বীকারকারীদের কাছে দাওয়াত পৌঁছাই। আপনি ইসলাম গ্রহণ করলে শান্তি ও সম্মান দুটোই আপনার জন্য নির্ধারিত। আর যদি দাওয়াত কবুল না করেন তাহলে আপনার সব প্রজার অগ্নিপূজার গুনাহ আপনার আমলনামায় যোগ হবে।’
পুরো চিঠি পড়ে রাগে ফেটে পড়লেন সম্রাট পারভেজ। টুকরো টুকরো করে ছিঁড়লেন বিশ্বনবীর দাওয়াতি চিঠিখানি। বললেন, ‘আমি পারস্যের সম্রাট। আরবের ওই মুহাম্মদ আমার গোলাম। (নাউজুবিল্লাহ)। আর সে আমাকে তার ওপর ইমান আনার দাওয়াত দিচ্ছে!’ পুরো ঘটনা রাসুলুল্লাহ (সা.)-কে বললেন আবদুল্লাহ ইবনে হুজায়ফা (রা.)। রাসুলুল্লাহ (সা.) শুনে খুব কষ্ট পেলেন। তিনি বললেন, ‘আমার চিঠির মতোই তার সাম্রাজ্য ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে গেছে।’ এটি ছিল রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর ভবিষ্যদ্বাণী। তখনো কিসরা পারভেজ দোর্দণ্ড প্রতাপের সঙ্গে রাজ্য পরিচালনা করছেন। রাসুলুল্লাহ (সা.) কিন্তু বলেননি, তার সাম্রাজ্য ভঙে টুকরো টুকরো হয়ে যাবে। তিনি বলেছেন, তার সাম্রাজ্য ভেঙে গেছে। অতীতকালের শব্দ দিয়ে বলেছেন। এর মানে হলো, রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর চিঠির সঙ্গে বেয়াদবির ফল কিসরা পারভেজ পাবেই পাবে।
পরের ঘটনা হলো, কিসরা পারভেজ সিরিয়ার প্রশাসক বাজানকে নির্দেশ দিলেন রাসুলুল্লাহ (সা.)-কে গ্রেপ্তার করে নিয়ে আসার জন্য। বাজান দুজন পুলিশ পাঠিয়ে দিল রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর কাছে। সঙ্গে একটি চিঠি। তারা এসে রাসুলুল্লাহ (সা.)-কে বলল, ‘আপনি আমাদের সঙ্গে চলুন। সম্রাটের কাছে আত্মসমর্পণ করলে আপনার অপরাধ ক্ষমা করা হতে পারে।’ রাসুলুল্লাহ (সা.) মুচকি হেসে বললেন, ‘তোমরা অনেক দূর থেকে এসেছ। আজ বিশ্রাম করো। তোমাদের সঙ্গে কাল সকালে কথা হবে।’ পরদিন সকালে তারা রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর কাছে এলে তিনি বলেন, ‘গতকাল রাতে সম্রাট কিসরার ছেলে শেরওয়াইহি তাকে খুন করে তার রাজত্ব কেড়ে নিয়েছে। তোমরা চলে যাও। তোমাদের প্রশাসক বাজানকে বলবে সে যেন ইসলাম কবুল করে।’ পরবর্তী সময়ে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, সত্যিই সম্রাট পারভেজ সে রাতে নিজ ছেলের হাতে খুন হয়েছেন। (আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া ৪/৪৬৮)
ঐতিহাসিকরা বলেন, সম্রাট পারভেজকে হত্যা করার পর তার পেট কেটে তাকে টুকরো টুকরো করা হয়, যেভাবে সে রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর চিঠিকে টুকরো টুকরো করেছিল। মাওলানা আবদুর রহমান জামি (রা.) পুরো ঘটনা উল্লেখ করে বলেন, আবদুল্লাহ ইবনে হুজায়ফা (রা.) কিসরার দরবার থেকে চলে আসার পর সম্রাট প্রহরীদের কঠোর নির্দেশ দিয়ে বলেন, ‘এই প্রাসাদে যেন কোনো আরব লোক ঢুকতে না পারে।’ এরপর সম্রাট তার ব্যক্তিগত রুমে আসলেন বিশ্রাম নিতে। সেখানে তিনি দেখলেন আরবদের মতো দেখতে কে যেন দাঁড়িয়ে আছে। সম্রাট ভয় পেয়ে গেলেন। ওই রুমে কোনো মানুষ ঢোকার অনুমতি ছিল না। সম্রাট জিজ্ঞেস করল, ‘কে তুমি?’ সে বলল, ‘আপনি আরবের মুহাম্মদ (সা.)-এর ওপর ইমান আনুন।’ সম্রাট বলল, ‘আমি ভেবে দেখি। এখন তুমি যাও।’ লোকটি সঙ্গে সঙ্গে অদৃশ্য হয়ে গেল। সম্রাট প্রহরীদের ডেকে গোপন রুমে কীভাবে মানুষ ঢুকল তা জানতে চেয়ে কড়া ভাষায় তিরস্কার করলেন। কাউকে জেলে পাঠালেন। কারও চাকরি চলে গেল। কিন্তু সবাই বারবার বলছে তারা কাউকে ঢুকতে দেখেনি।
দ্বিতীয় রাতেও একই ঘটনা ঘটল। এবার লোকটির হাতে একটি লাঠি ছিল। সম্রাট বললেন, ‘কী চাও?’ লোকটি বলল, ‘তুমি রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর সঙ্গে বেয়াদবি করেছ। বাঁচতে চাইলে ইমান গ্রহণ করো’ এ বলে সম্রাটের মাথায় খুব জোরে আঘাত করল লোকটি। তৃতীয় দিনও একইভাবে সম্রাটকে লাঠি দিয়ে আঘাত করা হলো। এবার আঘাতের সঙ্গে সঙ্গে লাঠি ভেঙে যায়। ওই রাতেই সম্রাটের পুত্র তাকে খুন করে। (শাওয়াহেদুন নবুওয়াত ১১৯-১২০)
ইতিহাসের পাতায় এমন অনেক ঘটনা আছে, দেখা গেছে যে, হজরত রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সঙ্গে বেয়াদবির কারণে মহান আল্লাহ অনেককে ধ্বংস করে দিয়েছেন। তাই মুসলিম-অমুসলিম কারও দ্বারাই এমন কোনো কাজ করা কাম্য নয়, যেটার দ্বারা তার সঙ্গে বেয়াদবি হয়। মহান আল্লাহ আমাদের সবাইকে রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর মর্যাদা রক্ষা করা এবং তার প্রতি বেশি বেশি দরুদ পাঠের তওফিক দান করুন।
ভয়েস/আআ