শুক্রবার, ০৩ অক্টোবর ২০২৫, ০৯:০৪ অপরাহ্ন
জিকির উল্লাহ জিুক :
দেশের একমাত্র প্রবাল দ্বীপ সেন্টমার্টিনকে ঘিরে এখন কেবল সমস্যা ও সংকট। সঙ্গে আছে বিধিনিষেধের নানা প্রশাসনিক শর্ত। এসব কারণে দেশের সর্বদক্ষিণে বঙ্গোপসাগরের বুকে জেগে থাকা প্রায় ১৭ বর্গকিলোমিটার আয়তনের দ্বীপটিতে বসবাসকারী সাড়ে ১০ হাজার মানুষ এখন উদ্বিগ্ন রয়েছে।
প্রতি বছর অক্টোবরের শেষ থেকে দ্বীপটিতে পর্যটন মৌসুম শুরু হয়। কিন্তু এবার নভেম্বরের মাঝামাঝি সময় এসেও শুরু হয়নি পর্যটকের আনাগোনা। অনিশ্চয়তার কবলে রয়েছে পর্যটকবাহী জাহাজ চলাচল। এর মধ্যে দ্বীপে বসবাসকারী মানুষের নিজস্ব প্রয়োজনে কাঠের ট্রলার বা স্পিডবোটযোগে টেকনাফ আসা-যাওয়া করতেও প্রতিবন্ধকতায় আছে। তাদের আসা বা যাওয়া এখন নির্ভর করছে প্রশাসনিক অনুমতির ওপর। স্থানীয় ছাড়া বাংলাদেশের কোনো নাগরিকের দ্বীপে যেতে হলে লিখিত অনুমতির শর্ত দেওয়া হয়েছে সম্প্রতি। ফলে দ্বীপের মানুষের মধ্যে ক্রমাগত উদ্বেগ বাড়ছে।
দ্বীপের বাসিন্দারা বলছে, তাদের নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য আনা-নেওয়ার ক্ষেত্রেও রয়েছে জটিলতা। এর মধ্যে দ্বীপের চিকিৎসাসেবার সরকারি প্রতিষ্ঠানের চিকিৎসক ও নার্সশূন্যতা রয়েছে। অসুস্থ রোগীদের টেকনাফ আনার ক্ষেত্রে অনুমতি জটিলতায় অনেকের মৃত্যুও হচ্ছে। একই সঙ্গে দ্বীপটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষকশূন্যতার কারণে লেখাপড়াও ব্যাহত হচ্ছে প্রতিনিয়ত।
পর্যটকবাহী জাহাজ চলাচলে অনিশ্চয়তা
প্রতি বছর নভেম্বরের প্রথম থেকে সেন্টমার্টিনে পর্যটকবাহী জাহাজ চলাচল পুরোদমে শুরু হয়। কিন্তু সম্প্রতি সরকারের গৃহীত উদ্যোগ ও প্রশাসনিক বিধিনিষেধের জটিলতার কবলে তা শুরু করা সম্ভব হয়নি। কবে নাগাদ জাহাজ চলাচল শুরু হবে, তা-ও এ পর্যন্ত নিশ্চিত হওয়া যায়নি।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, গত ২২ অক্টোবর পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের সভায় সেন্টমার্টিনের বিষয়ে নানা বিধিনিষেধ আরোপ করে সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। সিদ্ধান্তের পরিপ্রেক্ষিতে গত ২৮ অক্টোবর একই মন্ত্রণালয়ের উপসচিব অসমা শাহীন স্বাক্ষরিত একটি পরিপত্র জারি করা হয়। যে পরিপত্রে পাঁচটি বিষয় উল্লেখ রয়েছে। যেখানে বলা হয়েছে, সেন্টমার্টিনে নৌযান চলাচলের বিষয়টি বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষ পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের সম্মতি গ্রহণ করে অনুমতি প্রদান করবে। নভেম্বর মাসে দ্বীপে পর্যটক গেলেও দিনে ফিরে আসতে হবে। রত্রিযাপন করতে পারবে না। ডিসেম্বর ও জানুয়ারি মাসে রাত্রিযাপন করা যাবে। পর্যটকের সংখ্যা গড়ে প্রতিদিন ২ হাজারের বেশি হবে না। দ্বীপে রাতে আলো জ্বালানো যাবে না, শব্দদূষণ সৃষ্টি করা যাবে না। বারবি-কিউ পার্টি করা যাবে না।
দ্বীপে আসা-যাওয়া নিয়ে জটিলতা
পর্যটকবাহী জাহাজ চলাচল এখনও শুরু হয়নি। স্পিডবোট চলাচলও বন্ধ রয়েছে। যাত্রীবাহী কাঠের ট্রলার থাকলেও তা যাতায়াতের জন্য প্রয়োজন রয়েছে প্রশাসনের অনুমতি। দ্বীপে দায়িত্বপ্রাপ্ত কোস্ট গার্ড এবং উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার মৌখিক অনুমতির ওপর নির্ভর করছে এসব ট্রলারের আসা-যাওয়া। তবে এই অনুমতি কেবল দ্বীপের বাসিন্দার জন্য। দ্বীপের বাসিন্দা নয় এমন কেউ যেতে চাইলে লিখিত অনুমতি নিতে হবে। আর ওই অনুমতি পাওয়া না গেলে কারও ট্রলারে ওঠার সুযোগ নেই।
দ্বীপ ইউনিয়নের ইউপি সদস্য খোরশেদ আলম জানিয়েছেন, দ্বীপের মানুষের জন্য যেখানে অনুমতি প্রয়োজন হচ্ছে সেখানে বাইরের কারও যাওয়া আরও কঠিন।
তিনি বলেন, দ্বীপের অসুস্থ মানুষের চিকিৎসার প্রয়োজনেও টেকনাফে আসতে অনুমতি লাগে। এতে অনেক রোগীর মৃত্যুও হচ্ছে। যেমনটি গত জানুয়ারি মাসের শেষে তার মায়ের ক্ষেত্রে হয়েছে।
তিনি বলেন, মা গুরুতর অসুস্থ হয়ে গেলে টেকনাফ আনতে গিয়ে স্পিডবোট বা নৌযান চলাচলের অনুমতি সংগ্রহ করতে গিয়ে বিলম্ব হয়ে যায়। অনুমতি পাওয়ার পর মাকে নিয়ে দ্বীপের জেটি ঘাটে পৌঁছার আগেই মারা যান মা।
টেকনাফ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. আদনান চৌধুরী জানিয়েছেন, পর্যটক হিসেবে দ্বীপে ভ্রমণের অনুমতি দেওয়া হচ্ছে না। দ্বীপে কর্মরত এনজিওকর্মী বা গবেষণার কাজে, গণমাধ্যমকর্মীদের জরুরি প্রয়োজনে যাওয়ার ক্ষেত্রে অনুমতি দেওয়া হচ্ছে। আগে তা না থাকলেও এখন তা করতে হচ্ছে।
সেন্টমার্টিন কোস্ট গার্ডের স্টেশন কমান্ডার লে. কমান্ডার এসএম রাশাদ হায়দার গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন, নিরাপত্তার বিষয়টিকে বিবেচনায় রেখে সরকারের নির্দেশনা অনুযায়ী পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে। ভ্রমণ করতে কেউ সেন্টমার্টিন যাতে না আসতে পারে সেজন্য তারা মনিটরিং করছে। কেউ যদি সেন্টমার্টিন দ্বীপে চলে আসে তাকে ফেরত পাঠানো হবে বলেও জানান কোস্ট গার্ড স্টেশন কমান্ডার।
চিকিৎসক-নার্স ও শিক্ষক সংকট
দ্বীপের সাড়ে ১০ হাজার মানুষের জন্য ২০ শয্যাবিশিষ্ট হাসপাতাল রয়েছে। সরকারি ২০ শয্যার হাসপাতালটি সরকারিভাবে একজন মেডিকেল অফিসার, একজন উপসহকারী কমিউনিটি মেডিকেল অফিসার, একজন মিডওয়াইফ থাকার কথা থাকলেও তা নেই। বিশ্বব্যাংকের ‘স্বাস্থ্য ও জেন্ডার সাপোর্ট প্রকল্প (এইচজিএফপি), স্বাস্থ্য ও লিঙ্গ সহায়তা প্রকল্পের (এইচজিএস) অধীনে রোহিঙ্গা সংকটে স্থানীয়দের জন্য বিশ্বব্যাংকের বরাদ্দ অর্থে আন্তর্জাতিক ও দেশীয় বিভিন্ন এনজিও সংস্থা জেলাব্যাপী হাসপাতাল, ইউনিয়ন স্বাস্থ্যকেন্দ্রে জনবল নিয়োগসহ নানা সহায়তা শুরু হয় ২০১৯ সালে।
কক্সবাজার সিভিল সার্জনের কার্যালয় সূত্র জানিয়েছে, ওই প্রকল্পের অধীনে সেন্টমার্টিন হাসপাতালে ১৬ জন কর্মকর্তা ও কর্মচারী নিয়োগ দেওয়া হয়। গত ৩০ জুন এই প্রকল্পের অর্থ বরাদ্দ না থাকায় জনবল প্রত্যাহারের চিঠি প্রদান করেছিল সংশ্লিষ্ট বাস্তবায়নকারী সংস্থা। বিষয়টি নিয়ে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরসহ সরকারের নানা পর্যায়ে চিঠি প্রেরণ করে জানানো হয়। এর পরিপ্রেক্ষিতে ১ জুলাই বিশ্বব্যাংকের পক্ষে প্রেরিত এক চিঠিতে এসব প্রকল্প ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছিল। পরবর্তী ৬ মাস প্রকল্প চালু রাখার কথা থাকলেও হঠাৎ করে ৩০ সেপ্টেম্বর প্রকল্পের অর্থ বরাদ্দ না থাকায় আবারও বন্ধ করে দেওয়া হয়।
একই দ্বীপের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষক সংকট তীব্র বলে জানিয়েছে স্থানীয়রা। তারা বলছে, প্রাথমিক বিদ্যালয় চলছে দুজন প্যারা শিক্ষক দিয়ে। মাধ্যমিক স্কুলটিতে রয়েছে শিক্ষক সংকট। সূত্র:প্রতিদিনের বাংলাদেশ।
ভয়েস/ জেইউ।