বুধবার, ১১ ডিসেম্বর ২০২৪, ১১:৪৮ পূর্বাহ্ন
রাজেকুজ্জামান রতন:
জনগণের এত প্রত্যাশা নিয়ে আর কোনো সরকার আগে কখনোও ক্ষমতায় আসেনি। যদিও সরকার অন্তর্বর্তীকালীন কিন্তু তার কাছে প্রত্যাশা বিপুল। এই সব প্রত্যাশার পেছনে আছে বিগত সরকারের দুর্নীতি-দুঃশাসনের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ আর মৃত সহযোদ্ধাদের জন্য হারানোর বেদনা। রক্ত আর অশ্রুর বন্যায় স্বৈরাচারকে উচ্ছেদ করার মাধ্যমে এই সরকারের আগমন। ফলে একদিকে প্রত্যাশা অন্যদিকে দায়, এই দুটোকে মাথায় রেখে সরকারকে চলতে হচ্ছে। এ কথা জানা যে, বৈষম্য আর বঞ্চনা মানুষকে যত ক্ষুব্ধ করে অন্য কোনো কিছুতেই মানুষ তত ক্ষুব্ধ হয় না। কিন্তু মুক্তির পথ খুঁজে না পাওয়া পর্যন্ত সাধারণ মানুষ অপেক্ষায় থাকে। কবে আসবে সেই সুদিন, যেদিন সে মুক্তি পাবে বঞ্চনার অসম্মান থেকে। মুক্তির পথ চিহ্নিত করা আর সেই পথে মানুষকে আহ্বান করা জনগণের পক্ষের রাজনৈতিক দলের প্রধান কাজ। ফলে পরাধীনতার বিপরীতে স্বাধীনতা, বৈষম্যের বিপরীতে সাম্য, নিপীড়নের বিপরীতে সুবিচার আর স্বৈরাচারের বিপরীতে গণতন্ত্রের দাবি নিয়ে আন্দোলন-সংগ্রাম চলতেই থাকে। গত পনের বছর ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের লুটপাট, দমন-পীড়ন, নির্বাচনকে কলুষিত করে ক্ষমতা প্রলম্বিত করার কৌশলে জনমনে যে বিক্ষোভ দানা বেঁধে উঠেছিল, তার প্রতিক্রিয়ায় যে গণবিস্ফোরণ তার ধাক্কায় পদত্যাগ ও দেশত্যাগের ঘটনা ঘটেছে।
আমাদের দেশে বহুল প্রচলিত কথা ছিল, জনগণ বেশি কিছু চায় না, মোটা ভাত আর মোটা কাপড় হলেই খুশি। যদিও খাওয়া-পরার পাশাপাশি আর একটি চাওয়া ছিল, খাওয়া-পরা যেমনই হোক একটু শান্তিতে যেন ঘুমাতে পারি। দেশ কত এগিয়েছে, মাথাপিছু আয় কত বেড়েছে, জিডিপি এখন কত, দেশ কি ইউরোপ হয়ে যাচ্ছে না বেহেশত হচ্ছে সে সব বিষয়ে যত বিতর্কই চলুক না কেন, সাধারণ মানুষের চাওয়া যেন এই ন্যূনতম গণ্ডি পেরোতে পারছে না এখনো। এখনো সাধারণ স্বপ্ন তার সন্তানের জীবন যেন একটু ভালোভাবে কাটে। যেন সেই শত শত বছর আগের চিরন্তন চাওয়া ‘আমার সন্তান যেন থাকে দুধে-ভাতে’। কিন্তু সেই দুধ-ভাতে উৎপাত লেগেই আছে। দেশের উৎপাদনের প্রধান কারিগর কৃষক আর শ্রমিকদের দুটো সাদা ভাত আর দুধ নয়, ভাতের সঙ্গে ডালের জন্য নোনতা ঘাম আর লাল রক্ত ঝরাতে হয় বারবার।
সন্তানের মঙ্গল কামনায় বর্ণিত উদ্ধৃতিটির রচয়িতা মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ প্রতিভা ভারতচন্দ্র রায়গুণাকর। কবিতাটির কাহিনি আখ্যানটি হলো এ রকম : অন্নপূর্ণা দেবী কুলবধূ বেশে খেয়াপারের জন্য নদীর ঘাটে এসেছিলেন। মাঝি ঈশ্বরী পাটনী জানতে চেয়েছিল তার পরিচয়। কিন্তু কুলবধূ তো স্বামীর নাম মুখে আনতে পারেন না। সেকালের বিবেচনায় কথা যথার্থ। ফলে পরিচয় না জেনেই মাঝি রাজি হয়ে তাকে নৌকায় তুলল। কুলবধূ নৌকার কাঠের পাটাতনে পা রেখে বসলেন। কী আশ্চর্য! পায়ের স্পর্শে মুহূর্তেই নৌকার কাঠের পাটাতন সোনায় রূপান্তরিত হলো। মাঝি ঈশ্বরী পাটনীর বুঝতে বাকি থাকল না, ইনি কুলবধূ নন, নিশ্চয় কোনো দেবী। একসময় দেবী অন্নপূর্ণা ছদ্মবেশ ছেড়ে মাঝিকে বললেন, ‘তুমি কী বর চাও’। মাঝি তখন যা চাইবে তাই তো পেতে পারে। ফলে তার সর্বোচ্চ চাওয়াটাই সে দেবির কাছে জানাল। তার সন্তানদের মায়ের মনের কথাই দেবীকে জানিয়ে বলেছিল : ‘প্রণামিয়া পাটনী কহিছে জোড় হাতে/ আমার সন্তান যেন থাকে দুধে-ভাতে।’ ঘটনা সত্য কি না তা নিয়ে বিতর্ক থাকতে পারে কিন্তু মায়ের কামনা যে আন্তরিক তা নিয়ে বিতর্ক কেউ করবে না, নিশ্চয়ই।
চাওয়ার ক্ষেত্রে দুধে-ভাতে, মাছে-ভাতে, ডাল-ভাতে এমন করে নানা বিবর্তন হলেও ‘ভাত’ কিন্তু সবক্ষেত্রেই আছে। ভাতের পরিবর্তন হয়নি। রাজনীতি, সংস্কৃতি, অর্থনীতি সবখানেই ভাতের দাবিই মুখ্য। ভালো জীবনের মানে হলো, দুবেলা দুমুঠো ভাত জোগাড় করার সক্ষমতা। রেমিট্যান্স পাঠানো প্রবাসী শ্রমিক যখন বলে, কতদিন ভালোমতো ভাত খাই না, এমন কথা শুনে বুকে কি একটু মোচড় লাগে না? কিংবা, ভাত দে হারামজাদা, তা না হলে মানচিত্র খাব এই পঙ্ক্তি পড়ে ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে না এমন যুবক পাওয়া কঠিন। সেই দেশে ভাতের জন্য গ্রাম ছেড়ে শহরে আসা বা দেশ ছেড়ে বিদেশে পাড়ি দেওয়া মানুষের সংখ্যা অসংখ্য। কিন্তু ভাতের সঙ্গে নিরাপত্তা, নিশ্চয়তা, মর্যাদা আর ভবিষ্যৎ জীবনের কথা মানুষ এখন ভাবে। ভাবে আর কাজ করে বা কাজ খোঁজে। জীবিকার চাপে জীবন থেকে বিদায় দেয় বিশ্রাম আর জীবনে ভর করে অনিশ্চয়তা ও আতঙ্ক। মনে করতে থাকে, সারাটা জীবন কি শুধু বোঝা টেনেই চলতে হবে?
যখনই কোনো আন্দোলন তৈরি হয় তখনই তারা আশায় বুক বাঁধে আর ভাবে, এবার হয়তো তাদের আশা পূরণ হবে। বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে এই যে বিপুল সংখ্যক মানুষের অংশগ্রহণ তার অন্তর্নিহিত কারণটাও এ রকমই। মূল্যস্ফীতি ১২ শতাংশ এটা কেবলমাত্র সংখ্যা নয়, জীবনযাপনের কষ্টের সংখ্যাগত পরিমাপ এটি। আয় বাড়ছে না, ব্যয় বেড়ে যাচ্ছে। ফলে পথ দুটো। হয় দুর্নীতির সুযোগ নাও নাহলে দুঃখ সহ্য করার ক্ষমতা বাড়াও। সমাজের সবাই দুর্নীতি করতে পারে না তাই কিছু মানুষের দুর্নীতির কারণে দুর্ভোগ বাড়ে বহু মানুষের। এর ফলে বৈষম্য ক্রমাগত বাড়তে থাকে। বৈষম্য মাপার অন্যতম পদ্ধতি, গিনি সহগ অনুযায়ী বাংলাদেশে বৈষম্য এখন ০.৪৯ যার অর্থ দাঁড়ায় দেশে চূড়ান্ত বৈষম্য বিরাজ করছে। বৈষম্য শুধু অর্থনৈতিক নয়, নারী- পুরুষ, ধনী-গরিব, মালিক-শ্রমিক, গ্রাম-শহর সব ক্ষেত্রেই। ধর্মীয় এবং জাতিসত্তার বৈষম্য যেমন বাড়ছে, তেমনি বৈষম্যের বিস্তার ঘটছে মানুষের মননেও।
অথচ সংবিধানের ২৮ (১) অনুচ্ছেদে লেখা আছে, ‘কেবল ধর্ম, গোষ্ঠী, বর্ণ, নারী-পুরুষভেদ বা জন্মস্থানের কারণে কোন নাগরিকের প্রতি রাষ্ট্র বৈষম্য প্রদর্শন করিবেন না’। কিন্তু স্বাধীনতার পর দেশের জিডিপি বেড়ে ৯ বিলিয়ন ডলার থেকে ৪৫০ বিলিয়ন ডলার হয়েছে, মাথাপিছু আয় বেড়ে ১১০ ডলার থেকে ২৮২৪ ডলার হয়েছে কিন্তু এর সঙ্গে সঙ্গে বেড়েছে মানুষে মানুষে বৈষম্য। পরাধীন ব্রিটিশ আমলে বৈষম্য ছিল দুই ধরনের। ব্রিটিশ বনাম ভারতীয় আর ভারতীয় নাগরিকদের অভ্যন্তরীণ বৈষম্য। কিন্তু মানুষ প্রথমে দূর করতে চেয়েছিল ব্রিটিশ শাসন। সে কারণে স্বাধীনতার লড়াইয়ে অংশ নিয়েছিল তারা। পাকিস্তান আমলেও পূর্ব বাংলার মানুষ ছিল দুই ধরনের বৈষম্যের শিকার। সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে পাকিস্তানি শোষণের অবসান হলেও বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ শোষণ বন্ধ হয়নি বরং তীব্র হয়েছে। বৈষম্যের মূল কারণ যে শোষণমূলক পুঁজিবাদী ব্যবস্থা এর বিরুদ্ধে লড়াই করা ছাড়া এই বৈষম্য দূর করা যাবে না। বিগত ৫২ বছরে তা প্রমাণিত হয়েছে।
যখন নির্বাচনে সম্ভব হয় না তখন গণ-অভ্যুত্থান ঘটে, অত্যাচারী শাসককে জনগণের শক্তিতে ক্ষমতা থেকে সরানোর জন্য। এরপর ক্ষমতায় কে আসবে তার চেয়েও বড় কথা হয়ে দাঁড়ায়, যে আছে তাকে ক্ষমতা থেকে টেনে নামানো। ৬৯, ৯০-এর মতো ২৪ সালেও তেমন ঘটনা ঘটেছে। ছাত্র-শ্রমিক-জনতা ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টের গণআন্দোলনে আওয়ামী লীগকে ক্ষমতা থেকে নামাতে চাইলেও বিশেষ কাউকে ক্ষমতায় বসানোর জন্য রাজপথে নামেনি। সরকারের প্রতি ক্ষোভ থেকে জনগণ রাজপথে নেমে এসেছে তাদের সঙ্গে। ২০১৮ সালে নিরাপদ সড়ক আন্দোলনের সময় ছাত্ররা রাজপথে লিখেছিল ‘রাষ্ট্র সংস্কার চলছে’। সে সময় হেলমেট বাহিনী দিয়ে তা দমন করা হয়েছিল। কিন্তু তাদের সেই কথা মানুষের বুকে ঠাঁই করে নিয়েছিল। এবারের আন্দোলনেও তারা বারবার সংস্কারের কথা বলেছে। ছাত্রদের এই দাবির সঙ্গে দেশের সচেতন মহল দাবি তুলেছে যে, গণতান্ত্রিকব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করতে হলে এমনভাবে সংস্কার করতে হবে যাতে সাংবিধানিক সংস্থাগুলোর ওপর নির্বাহী বিভাগের বিশেষ একজনের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ কর্র্তৃত্বের অবসান ঘটে, সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদের পরিবর্তন করা হয়। সংসদ সদস্যরা নিজের সুবিধার জন্য নয়, গণতান্ত্রিক আইন প্রণয়নের জন্য সংসদে যান। কালো টাকার জোর, ধর্মের রাজনৈতিক ব্যবহার এবং পেশিশক্তি, পুলিশ ও প্রশাসনকে কাজে লাগিয়ে মানুষের মতামত দেওয়ার সুযোগ কেড়ে নেওয়া না হয়। মানুষের ভোটকে মূল্যহীন বানিয়ে ফেলার সংস্কৃতির অবসান ঘটে। নির্বাচনব্যবস্থা এমন হবে যাতে প্রতিটি মানুষ ভাবতে পারবে যে, জাতীয় নীতিনির্ধারণের ক্ষেত্রে তার মতেরও মূল্য আছে। কিন্তু বর্তমান ব্যবস্থায় প্রার্থী ও ভোটার দুটোই কেনাবেচার পণ্যে পরিণত হয়েছে। ফলে সংসদ হয়ে পড়েছে ব্যবসায়ীদের সিন্ডিকেটের মতো। এই সংসদে জনগণের কথা বলা এবং জনগণের জন্য ভাবার মানুষ যাওয়া প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়েছে।
জনগণ কী চায় তার সংক্ষিপ্ত তালিকা হলো দ্রব্যমূল্য তার ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে থাকুক। সন্তানের শিক্ষা যেন দুর্মূল্য না হয় আর চিকিৎসা যেন ব্যয়বহুল না হয়। ঘুষ দুর্নীতি চাঁদাবাজি বন্ধ হোক, দেশের টাকা পাচার বন্ধ হোক, মানুষের কাজ এবং ন্যায়সংগত মজুরি থাকুক, কৃষক কৃষিপণ্যের ন্যায্য দাম পাক আর বাজারে সিন্ডিকেটের নিয়ন্ত্রণ বন্ধ হোক। প্রশাসন যেন জনগণকে তাচ্ছিল্য না করে আর পুলিশ যেন দানবের মতো আচরণ না করে। মামলা দিয়ে হয়রানি আর গ্রেপ্তার বাণিজ্য যেন বন্ধ হয়, সময়মতো নির্বাচন এবং নির্বাচন যাতে সুষ্ঠু হয়। ক্ষমতায় যেই থাকুক মানুষ যেন একটু শান্তিতে থাকতে পারে। যদিও পুঁজিবাদীব্যবস্থায়, মুক্তবাজার অর্থনীতিতে এ সবের অনেকটাই আকাশ কুসুম কল্পনা। তারপরও মানুষ চায় একটু স্বস্তি। ভিড়ে ঠাসাঠাসি বাসে হেলপার ডাকে সিট খালি, সিট খালি বলে। ঠেলে ঠুলে যাত্রী উঠলে, সে আবার বলে পেছন দিকে আগাইয়া যান। তেমনি সংস্কারের বোঝা বড় করে দেশ যেন আবার পেছন দিকে যাওয়া শুরু না করে। যা চেয়েছি তা পাব কি-না এই আশঙ্কা যেমন বাড়ছে, তেমনি পেছনে যেন না যাই এই চাওয়াটাও ক্রমশ বড় হয়ে উঠছে।
লেখক: রাজনৈতিক সংগঠক ও কলাম লেখক
rratan.spb@gmail.com
ভয়েস/আআ