বৃহস্পতিবার, ২৩ জানুয়ারী ২০২৫, ০৪:০২ পূর্বাহ্ন
মাওলানা হাফেজ আল আমিন সরকার:
ধর্মের চর্চা ও প্রচার-প্রসারে দাওয়াত এবং তাবলিগের গুরুত্ব অপরিসীম। দাওয়াতের নির্দেশ দিয়ে আল্লাহ বলেন, ‘(হে নবী!) আপনি নিজের রবের পথে দাওয়াত দিন প্রজ্ঞা ও সুন্দর উপদেশের মাধ্যমে। আর প্রয়োজনে তাদের সঙ্গে উত্তম পন্থায় দলিলভিত্তিক আলোচনা করুন।’ (সুরা নাহল ১২৫) অন্য আয়াতে আল্লাহ বলেন, ‘হে রাসুল! আপনি পৌঁছে দিন, যা আপনার কাছে আপনার রবের পক্ষ থেকে অবতীর্ণ হয়েছে।’ (সুরা মায়েদা ৬৭) দাওয়াত ও তাবলিগ হলো দ্বীনের প্রতি মানুষের আগ্রহ জাগানোর মাধ্যম। যার ভেতর দ্বীনের প্রতি আগ্রহ নেই, দাওয়াতের কাজ হলো তাকে দ্বীনদার বানানো, মুত্তাকি বানানো। যখন কারও মনে দ্বীনের ব্যাপারে আগ্রহ জাগে, সে আগ্রহ পূরণ করার জন্য তাকে কোরআন-সুন্নাহর সবক নিতে হয়। যারা ইলমের মেহনত করছেন, তাদের কাছে এসে ধর্মের শিক্ষা নিয়ে তবেই তাবলিগের মাঠে নামতে হবে। এজন্যই তাবলিগের মেহনত শুরু করার আগে হজরতজি ইলিয়াস (রহ.) দীর্ঘ সময় রশিদ আহমদ গাঙ্গুহি, আশরাফ আলী থানবি, শাইখুল হিন্দ মাহমুদুল হাসান, খলিল আহমদ সাহরানপুরী (রহ.)-এর মতো যুগশ্রেষ্ঠ আলেমদের তত্ত্বাবধানে থেকেছেন।
হজরতজি ইলিয়াস (রহ.) ছিলেন ভারতবর্ষের একজন প্রথিতযশা আলেম। তিনি ১৮৮৫ সালে ভারতের কান্ধলায় জন্মগ্রহণ করেন। শিশুকালেই তিনি কোরআনের হিফজ সম্পন্ন করেন। এরপর দীর্ঘ ১০ বছর রশিদ আহমদ গাঙ্গুহি (রহ.)-এর সান্নিধ্যে থেকে ইলমে শরিয়ত ও তরিকতের উচ্চ মাকাম অর্জন করেন। ১৯০৮ সালে তিনি দারুল উলুম দেওবন্দে শায়খুল হিন্দ মাহমুদুল হাসান (রহ.)-এর কাছে বুখারি ও তিরমিজির দরস নেন। এরপর খলিল আহমদ সাহারানপুরীর কাছে বায়াত গ্রহণ করেন। এর দুই বছর পর তিনি মাজাহিরু উলুম সাহারানপুরে শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন। এর কিছুদিন পর তিনি দিল্লির নিজামুদ্দিনের বাংলাওয়ালি মসজিদে তাবলিগের মেহনত শুরু করেন। বিংশ শতাব্দীর এই মহান দাঈ দাওয়াত ও তাবলিগের ময়দানে এক ইতিহাস সৃষ্টি করেন। সাধারণ মুসলমানদের মধ্যে ইসলামি নীতি ও আদর্শের মহিমা ফিরিয়ে আনতে ১৯২০ সালে তিনি প্রচলিত ধারার তাবলিগ জামাতের সূচনা করেন। তাবলিগ জামাত মানুষকে আল্লাহর পথে চলার দাওয়াত দেয়। ব্যক্তি জীবনের কাজ-কর্ম, অফিস, ব্যবসা-বাণিজ্যসহ সবকিছু ঠিক রেখে কোরআন-সুন্নাহ মেনে চলা যে কষ্টসাধ্য বিষয় নয়, তা হাতেকলমে শেখানোই তাবলিগ জামাতের মূল উদ্দেশ্য।
তাবলিগ জামাতের উদ্দেশ্য সম্পর্কে ইলিয়াস (রহ.) বলেন, ‘আমি এই ইমানি আন্দোলনের মাধ্যমে প্রতিটি জায়গায় ওলামায়ে কেরাম এবং সাধারণ মানুষের মধ্যে পারস্পরিক বন্ধন গড়ে তুলতে চাই।’ (মালফুজাত, মালফুজ নম্বর ১০২) তিনি আরও বলেন, ‘আমাদের এই তাবলিগ মেহনত সুন্দর জীবন গঠন করার মেহনত। আর এর উসুল যথাযথভাবে পালন করার মধ্যেই কামিয়াবি ও সফলতা নিহিত। এই মেহনতের গুরুত্বপূর্ণ একটি উসুল হলো, মুসলমানদের মন-মানসিকতা বুঝে তাদের সামনে ইসলামের আহ্বান তুলে ধরা। মুসলমানদের মধ্যে সাধারণত তিনটি স্তর দেখা যায়। এক. হতদরিদ্র শ্রেণি। দুই. উন্নত শ্রেণি। তিন. ওলামায়ে দ্বীন। এই তিন শ্রেণির সঙ্গে যে আচরণ করতে হবে তা একত্রে এই হাদিসের মধ্যে উল্লেখ আছে, ‘যে ব্যক্তি আমাদের ছোটদের স্নেহ করল না, বড়দের সম্মান করল না এবং ওলামায়ে কেরামকে ইজ্জত করল না, সে আমাদের দলভুক্ত নয়।’ (মালফুজাত, মালফুজ নম্বর ১৩৫)
ইলিয়াস (রহ.) বলেন, ‘তাবলিগি কাজের একটি উসুল হলো, স্বাধীনভাবে নিজের মন মতো না চলা; বরং নিজেকে ওই সব বুজুর্গের পরামর্শ অনুযায়ী পরিচালনা করা, যাদের ওপর দ্বীনি বিষয়ে আমাদের পূর্ববর্তী আকাবির হজরতরা আস্থা রেখে গেছেন এবং আল্লাহর সঙ্গে যাদের খাস সম্পর্কের ব্যাপারটি সর্বস্বীকৃত। রাসুলুল্লাহ (স.)-এর পর সাহাবায়ে কেরামের সাধারণ নিয়ম এই ছিল যে, নবীজি (সা.) যাদের ওপর বেশি আস্থা রেখেছিলেন তারাও তাদের ওপর বেশি আস্থা রাখতেন। পরবর্তী যুগে বেশি আস্থার পাত্র ছিলেন ওইসব বুজুর্গানে দ্বীন, যাদের ওপর আবু বকর (রা.) ও ওমর (রা.) আস্থা রেখেছিলেন।’ তিনি আরও বলেন, ‘দ্বীনের কাজে আস্থাশীল ব্যক্তি নির্বাচন করার ক্ষেত্রে অত্যন্ত সতর্কতা জরুরি। অন্যথায় অনেক বড় ধরনের গোমরাহির আশঙ্কা আছে।’ (মালফুজাত, মালফুজ নম্বর ১৪৩)
আলেমদের কাছে দ্বীন শেখার নিয়তে যাওয়ার ব্যাপারে হজরতজি ইলিয়াস (রহ.) বলেন, ‘আমাদের তাবলিগের সাথীদের তিন শ্রেণির লোকদের কাছে তিন উদ্দেশ্যে বিশেষভাবে যাওয়া উচিত। ওলামায়ে কেরাম ও বুজুর্গানে দ্বীনের খেদমতে যাওয়ার উদ্দেশ্য হবে তাদের থেকে দ্বীন শেখা। নিজের চেয়ে নিম্নশ্রেণির লোকদের কাছে যাওয়ার উদ্দেশ্য হবে দ্বীনি কথাবার্তা প্রচার করে নিজের ইমান মজবুত করা। আর বিভিন্ন শ্রেণির লোকদের কাছে যাওয়া উদ্দেশ্য হবে তাদের ভালো গুণাবলি গ্রহণ করা।’ (মালফুজাত, মালফুজ নম্বর ৮৬)
হে আমার তাবলিগি ভাই! যেসব সোনালি উসুলের কারণে হজরতজির মেহনত ব্যাপক পরিসরে কবুল হয়েছে, তা সংরক্ষণ করা জরুরি। এসব উসুল থেকে সরে আসার কারণে সর্বত্রই আজ বিশৃঙ্খলা দেখা দিয়েছে। আমরা যারা তাবলিগের সঙ্গে যুক্ত আছি, ছয় উসুল থেকে কোনোভাবেই বের হওয়া যাবে না। কালেমা, নামাজ, ইলম, জিকির, তাসহিহে নিয়ত, ইকরামুল মুসলিমিন, যা আমাদের বুনিয়াদি সাধনা। এগুলো কোনোভাবেই বিসর্জন দেওয়া যাবে না। দাওয়াতি মেজাজ হলো সব সময় ক্ষমা, কোমলতা, মায়া-মমতা ও উদারতার সঙ্গে থাকা। এটা হজরতজির ব্যক্তিগত শিক্ষা নয়, খোদ নবী (সা.)-এর শিক্ষা। এক ব্যক্তি নবীজিকে একা পেয়ে তরবারি উঁচিয়ে হত্যা করতে চেয়েছিল, নবীজি তাকে ক্ষমা করে দিয়েছেন। আবার আয়েশা (রা.)-এর রূঢ় কথার জবাবে নবীজি (সা.) বলেছেন, ‘আয়েশা! নম্র ভাষী হও, রূঢ় ভাষা বাদ দাও।’ (সহিহ বুখারি ২৯৩৫)
ভয়েস/আআ