বুধবার, ১৯ মার্চ ২০২৫, ১০:৪৩ অপরাহ্ন

দৃষ্টি দিন:
সম্মানিত পাঠক, আপনাদের স্বাগত জানাচ্ছি। প্রতিমুহূর্তের সংবাদ জানতে ভিজিট করুন -www.coxsbazarvoice.com, আর নতুন নতুন ভিডিও পেতে সাবস্ক্রাইব করুন আমাদের ইউটিউব চ্যানেল Cox's Bazar Voice. ফেসবুক পেজে লাইক দিয়ে শেয়ার করুন এবং কমেন্ট করুন। ধন্যবাদ।

সর্বাধিক হাদিস বর্ণনাকারী সাহাবি

মুফতি মাহবুব হাসান:
বিখ্যাত সাহাবিদের মধ্যে আবু হুরায়রা (রা.) অন্যতম। তিনি একনিষ্ঠ জ্ঞানপিপাসু ছিলেন। রাসুল (সা.)-এর সান্নিধ্যে থেকে অল্প সময়ে শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করেছিলেন। কঠোর সাধনায় পরিণত হয়েছিলেন হাদিস শাস্ত্রের সম্রাট হিসেবে। রাসুল (সা.)-এর সাহাবিদের মধ্যে তিনিই সর্বাধিক হাদিস বর্ণনা করেছেন। তার বর্ণনাকৃত হাদিসের সংখ্যা ৫ হাজার ৩৭৪টি। শুধু সহিহ বুখারিতে তার সনদে বর্ণিত হাদিসের সংখ্যা ৪৪৮টি, আর সহিহ মুসলিমে ৫৪৫টি। আবু হুরায়রা (রা.) অষ্টম হিজরির শেষের দিকে ইসলাম গ্রহণ করেন।

তিনি ইসলামের টানে মাতৃভূমি ইয়েমেন ছেড়ে মদিনায় চলে আসেন। পরিবারের একমাত্র সদস্য ছিলেন তার মা। মায়ের প্রতি তার ভক্তি, ভালোবাসা ও টান ছিল অন্যরকম। আবু হুরায়রা (রা.) দিন-রাত রাসুল (সা.)-এর প্রতিষ্ঠিত মাদ্রাসা আসহাবে সুফফায় পড়ে থাকতেন। ইলম অর্জন করতেন। তখনও তার মা ইসলাম গ্রহণ করেননি। এটা তিনি কিছুতেই মেনে নিতে পারছিলেন না। আবু হুরায়রা (রা.) বলেন, আমার মাকে ইসলামের প্রতি আহ্বান জানাতাম। তিনি মুশরিকা ছিলেন। একদিন আমি তাকে ইসলাম কবুলের জন্য আহ্বান জানালাম। তখন তিনি রাসুল (সা.) সম্পর্কে আমাকে এমন কথা শোনালেন, যা আমার কাছে খুবই অপ্রিয় ছিল। আমি কাঁদতে কাঁদতে রাসুল (সা.)-এর কাছে আসলাম। আমি বললাম, হে আল্লাহর রাসুল! আমি মাকে ইসলামের দাওয়াত দিয়ে আসছিলাম আর তিনি অস্বীকার করে আসছিলেন। এরপর তাকে আজ দাওয়াত দেওয়াতে তিনি আমাকে আপনার সম্পর্কে এমন কথা শোনালেন তা আমি পছন্দ করি না। সুতরাং আপনি আল্লাহর কাছে দোয়া করুন তিনি যেন আবু হুরায়রার মাকে হেদায়েত দান করেন। তখন রাসুল (সা.) বললেন, ‘হে আল্লাহ! আবু হুরায়রার মাকে হেদায়েত দান করো।’

আবু হুরায়রা বলেন, তার দোয়ার কারণে আমি খুশি মনে বেরিয়ে এলাম। যখন আমি ঘরের দরজায় পৌঁছলাম, তখন তা বন্ধ দেখতে পেলাম। আমার মা আমার পায়ের আওয়াজ শুনতে পেয়ে বললেন, আবু হুরায়রা একটু দাঁড়াও। তখন আমি পানির কলকল শব্দ শুনছিলাম। তিনি বললেন, এরপর আমার মা গোসল করলেন এবং গায়ে চাদর পরলেন আর তড়িঘড়ি করে ওড়না জড়িয়ে নিলেন। এরপর ঘরের দরজা খুলে দিলেন। এরপর বললেন, হে আবু হুরায়রা! আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, আল্লাহ ব্যতীত কোনো ইলাহ নেই। আমি আরও সাক্ষ্য দিচ্ছি যে মুহাম্মদ (সা.) তার বান্দা ও রাসুল। (সহিহ মুসলিম)

ইসলাম গ্রহণের আগে আবু হুরায়রা (রা.)-এর নাম ছিল আবদে শামস। ইসলাম গ্রহণের পর রাসুল (সা.) তার নাম দেন আবদুর রহমান। তার উপনাম আবু হুরায়রা তথা বিড়ালওয়ালা বা বিড়ালের মালিক। তিনি এই নামেই বিশ্বের মুসলমানদের কাছে পরিচিত। ইমাম তিরমিজি (রহ.) আবদুল্লাহ ইবনে রাফে (রহ.)-এর সূত্রে বর্ণনা করেছেন, তিনি বলেন, আমি আবু হুরায়রা (রা.)-কে জিজ্ঞেস করলাম, আপনি ‘আবু হুরায়রা’ উপনামে কেন ভূষিত হলেন? এর উত্তরে তিনি বললেন, (ছোটবেলায়) আমি ছাগল চরাতাম। বিড়ালের একটি বাচ্চা ছিল আমার। আমি সেটাকে রাতের বেলা গাছের ওপর ছেড়ে দিতাম। আর দিনের বেলা সঙ্গে রাখতাম, সেটাকে নিয়ে খেলা করতাম। লোকজন তা দেখে আমাকে ‘আবু হুরায়রা’ ডাকতে শুরু করে। (তিরমিজি) অপর বর্ণনামতে একদা তিনি বিড়ালের একটি বাচ্চা জামার হাতার মধ্যে রাখলেন। রাসুল (সা.) তা দেখে বললেন, ‘আবু হুরায়রা’ (বিড়ালওয়ালা)। এরপর তিনি এ নামে প্রসিদ্ধ হয়ে যান। (আল-ইসাবাহ)

তিনি অষ্টম হিজরির শেষ দিকে ইসলাম গ্রহণ করেও ইলমের ময়দানে অনেক ঊর্ধ্বে পৌঁছে যান। অথচ রাসুল (সা.)-এর স্নেহধন্য অসংখ্য সাহাবি ছিলেন। এ বিষয়ে আবু হুরায়রা (রা.)-এর বর্ণনা রয়েছে। তিনি বলেন, মানুষজন বলে যে, আবু হুরায়রা বেশি হাদিস বর্ণনা করে থাকে। তারা আরও বলে, মুহাজির ও আনসার সাহবিদের কী হলো যে, তারা আবু হুরায়রার মতো এত হাদিস বর্ণনা করে না। আবু হুরায়রা (রা.) বলেন, আমার মুহাজির ভাইদের বাজারে ব্যবসা-বাণিজ্য এবং আনসার ভাইদের তাদের খেত-খামার ও বাগানের কাজ-কর্ম ব্যতিব্যস্ত রাখত। আমি ছিলাম একজন মিসকিন লোক। পেটে যা জুটত, খেয়ে না খেয়ে তাতেই তুষ্ট হয়ে আল্লাহর রাসুল (সা.)-এর দরবারে পড়ে থাকতাম। তাই লোকেরা যখন অনুপস্থিত থাকত, আমি হাজির থাকতাম। লোকেরা যা ভুলে যেত, আমি তা স্মরণ রাখতাম।

একদিন রাসুল (সা.) বলেন, তোমাদের যে কেউ আমার কথা শেষ হওয়া পর্যন্ত তার চাদর বিছিয়ে রাখবে এবং আমার কথা শেষ হলে চাদরখানা তার বুকের সঙ্গে মেলাবে, তাহলে সে আমার কথা কখনো ভুলবে না। আমি আমার চাদর রাসুল (সা.)-এর কথা শেষ না হওয়া পর্যন্ত বিছিয়ে রাখলাম। সেই চাদর ছাড়া আমার গায়ে আর কোনো চাদর ছিল না। রাসুল (সা.)-এর কথা শেষ হওয়ার পর আমি তা আমার বুকের সঙ্গে মেলালাম। সেই সত্তার কসম! যিনি তাকে সত্য দিয়ে প্রেরণ করেছেন, আজ পর্যন্ত আমি তার একটি কথাও ভুলিনি। আল্লাহর কসম! যদি আল্লাহর কিতাবের এ দুটি আয়াত না থাকত, তবে আমি কখনো তোমাদের নিকট হাদিস বর্ণনা করতাম না। (তা হলো এই যে), ‘নিশ্চয়ই যারা আমার নাজিলকৃত উজ্জ্বল নিদর্শনাবলি ও হেদায়াতকে গোপন করে, যদিও আমি কিতাবে তা মানুষের জন্য সুস্পষ্টরূপে বর্ণনা করেছি, তাদের প্রতি আল্লাহ লানত বর্ষণ করেন এবং অন্য লানতকারীরাও লানত বর্ষণ করে।’ (সুরা বাকারা ১৫৯, সহিহ বুখারি)

সাহাবিদের মধ্যে হজরত আবু হুরায়রা (রা.)-এর হাদিস শেখার আগ্রহ সবচেয়ে বেশি ছিল। তাই তিনি সবচেয়ে বেশি হাদিস বর্ণনা করেছেন। হাদিস শেখার জন্য তিনি রাসুল (সা.)-কে কীভাবে অনুসরণ করতেন তা জানা যায় আরেক বর্ণনা থেকে। আবু হুরায়রা (রা.) বলেন, একদা আমরা (সাহাবিরা) রাসুল (সা.)-কে ঘিরে বসেছিলাম। আমাদের জামাতে আবু বকর ও ওমর (রা.)-ও ছিলেন। এ সময় রাসুল (সা.) আমাদের মাঝ থেকে উঠে গেলেন। দীর্ঘক্ষণ অতিবাহিত হওয়ার পর আমরা শঙ্কিত হলাম যে, তিনি কোথাও কোনো বিপদের সম্মুখীন হলেন কি না? তাই আমরা ব্যতিব্যস্ত হয়ে গেলাম। আর আমি সর্বপ্রথম বিচলিত হলাম। তাই আমি রাসুল (সা.)-এর খোঁজে বের হয়ে পড়লাম। বনু নাজ্জারের জনৈক আনসারির বাগানের নিকট এসে উপনীত হলাম। আর বাগানের অভ্যন্তরে প্রবেশের কোনো পথ খুঁজে পাওয়া যায় কি না, সে জন্য চারদিকে ঘুরলাম। কিন্তু পেলাম না। হঠাৎ দেখতে পেলাম বাইরের একটি কুয়া থেকে একটি সংকীর্ণ নালা বাগানের অভ্যন্তরে প্রবাহিত হচ্ছে। অতঃপর আমি নিজেকে শেয়ালের মতো সংকুচিত করে নর্দমার মধ্য দিয়ে গিয়ে রাসুল (সা.)-এর নিকট উপনীত হলাম। তিনি বললেন, আবু হুরায়রা নাকি? আমি বললাম, হ্যাঁ, হে আল্লাহর রাসুল! তিনি জিজ্ঞেস করলেন, কী ব্যাপার? আমি বললাম, আপনি আমাদের মাঝে উপস্থিত ছিলেন। হঠাৎ উঠে চলে এলেন, আর দীর্ঘক্ষণ পরও ফিরে না যাওয়ায় আমরা বিচলিত হয়ে পড়েছি। আমাদের অনুপস্থিতিতে কোথাও বিপদের সম্মুখীন হলেন কি না, আমাদের এ আশঙ্কা হলো। আর আমি সর্বপ্রথম বিচলিত হয়ে পড়ি। আমি এ দেয়ালের কাছে এসে শেয়ালের মতো সংকুচিত হয়ে নালার ভেতর দিয়ে এখানে উপস্থিত হলাম। অন্যরা আমার পেছনে আছে। তিনি তার জুতা-জোড়া আমাকে দিয়ে বললেন, হে আবু হুরায়রা, আমার জুতা-জোড়া সঙ্গে নিয়ে যাও। এ বাগানের বাইরে যার সঙ্গেই তোমার সাক্ষাৎ হয় তাকে বলো, যে ব্যক্তি দৃঢ় বিশ্বাস নিয়ে এ সাক্ষ্য দেয় যে, আল্লাহ ছাড়া প্রকৃত কোনো ইলাহ নেই, তাকে জান্নাতের সুসংবাদ দাও।’ (সহিহ মুসলিম)

এমন সাধনার কারণে তাকে মহান আল্লাহ ইলমের সুউচ্চ শেখরে আরোহণ করান। আর ইলম অন্বেষণের জন্য যিনিই সঠিক পদ্ধতিতে সাধনা করবেন মহান আল্লাহ তাকেই গন্তব্যে পৌঁছাবেন। এটাই মহান আল্লাহ শাশ্বত বিধান। আবু হুরায়রা (রা.) যেমন রাসুল (সা.)-এর প্রতি নিবেদিত ছিলেন, তেমনি ছিলেন জ্ঞানের প্রতিও কোরবান। জ্ঞান অর্জন ও জ্ঞানচর্চা তার অভ্যাস ও প্রধান লক্ষ্যে পরিণত হয়েছিল। তাই তিনি রাসুল (সা.) থেকে সর্বাধিক হাদিস বর্ণনা করার সৌভাগ্য লাভ করেন।

ভয়েস/আআ

Please Share This Post in Your Social Media

© All rights reserved © 2023
Developed by : JM IT SOLUTION