মঙ্গলবার, ০১ Jul ২০২৫, ০৪:০৮ অপরাহ্ন
মো. আবদুর রহমান:
মানুষের চরিত্র ও আত্মার পরিশুদ্ধির জন্য আত্মসমালোচনা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ইসলাম একজন মুমিনের জীবনে এই আত্মসমালোচনাকে শুধু উৎসাহিতই করে না, বরং এটাকে ধারাবাহিক অভ্যস্ততার রূপ দেওয়ার নির্দেশ দেয়। আত্মসমালোচনার মাধ্যমে একজন মুমিন নিজের অন্তর্দৃষ্টি জাগ্রত করতে পারে, নিজের আত্মিক উন্নয়ন সাধন করতে পারে, নিজেকে নির্মোহভাবে বিশ্লেষণ করতে সক্ষম হয় এবং পাপ ও ভুল থেকে ফিরে আসার সঠিক পথ খুঁজে পায়। এটি আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের এক গুরুত্বপূর্ণ উপায়ও বটে।
আত্মসমালোচনা হলো নিজের ভালো-মন্দ কাজের জন্য নিজের কাছে নিজেই জবাবদিহি করা। মন্দ কাজের জন্য অনুতপ্ত হয়ে মহান আল্লাহর কাছে তওবা করা এবং সে কাজটি পরিত্যাগ করে ভবিষ্যতে তা না করার অঙ্গীকার করা। আর ভালো কাজের জন্য মহান আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করা এবং তা আগামীতে অব্যাহত রাখার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা।
আল্লামা মাওয়ারদি (রহ.) বলেছেন, ‘মানুষ রাতের কোনো এক সময়ে তার দিনের কাজগুলো যাচাই-বাছাই করে দেখবে। যদি সেগুলো ভালো ও কল্যাণকর হয় তাহলে তা যথারীতি বহাল রাখবে এবং ভবিষ্যতে অনুরূপ কাজ সামনে এলে তা করে যাবে। আর যদি তার কাজগুলো মন্দ ও অকল্যাণকর হয় তাহলে অনুশোচনা করা, লজ্জিত হওয়া এবং ভবিষ্যতে আর কোনোভাবেই এসব কাজ করবে না বলে প্রতিজ্ঞা করা।’ (আদাবুদ দ্বীন ওয়াদ দুনিয়া ৩৪)
আত্মসমালোচনার মাধ্যমে নিজের দোষত্রুটিগুলো সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায় এবং তা সংশোধন করে নেওয়ার সুযোগ তৈরি হয়। এ ব্যাপারে আল্লামা ইবনুল কাইয়্যিম (রহ.) বলেন, ‘আত্মসমালোচনার অর্থ হচ্ছে নিজের করণীয় ও বর্জনীয় পৃথক করে ফেলা। অতঃপর সর্বদা ফরজ ও নফল কর্তব্যগুলো আদায়ের জন্য প্রস্তুত থাকা এবং হারাম বা নিষিদ্ধ বিষয়সমূহ পরিত্যাগ করার ওপর সুদৃঢ় থাকা। তিনি আরও বলেন, আত্মসমালোচনার অর্থ হলো প্রতিটি কাজে সর্বপ্রথম মহান আল্লাহর হকগুলোর প্রতি দৃষ্টি দেওয়া, অতঃপর সেই হকগুলো যথাযথভাবে আদায় করা হচ্ছে কি না সেদিকে লক্ষ রাখা।’ (আল-ফাওয়ায়েদ)
আত্মসমালোচনা প্রত্যেক মুমিনের জন্য একান্ত অপরিহার্য। আত্মসমালোচনার প্রতি উৎসাহিত করে পবিত্র কোরআনে আল্লাহতায়ালাা বলেন, ‘হে মুমিনরা! তোমরা আল্লাহকে ভয় করো এবং প্রত্যেক ব্যক্তির উচিত আগামীকালের (আখেরাতের) জন্য সে কী প্রেরণ করেছে, তা চিন্তা করা। আর তোমরা আল্লাহকে ভয় করো, তোমরা যা করো আল্লাহ সে সম্পর্কে সম্যক অবগত। তোমরা তাদের মতো হয়ো না, যারা আল্লাহকে ভুলে গেছে, ফলে আল্লাহ তাদের আত্মভোলা করে দিয়েছেন। নিশ্চয়ই তারা পাপাচারী।’ (সুরা হাশর ১৮-১৯)
এই আয়াতের ব্যাখ্যায় ইবনুল কাইয়্যিম (রহ.) বলেন, আল্লাহতায়ালা প্রত্যেক মুমিনের জন্য আত্মসমালোচনা ওয়াজিব করে দিয়েছেন। এই আয়াতের ভাষ্য হলো, তোমাদের অবশ্যই চিন্তা করা কর্তব্য যে, আখেরাতের জন্য তুমি যা প্রেরণ করেছ তা তোমার জান্নাতের পথ সুগম করছে, না-কি তোমাকে ধ্বংসের দিকে ঠেলে দিচ্ছে? (মাদারিজুস সালেকিন ১/১৮৭)
অন্য আয়াতে আল্লাহতায়ালা আত্মসমালোচনাকারীদের প্রশংসা করে বলেন, ‘নিশ্চয়ই যারা আল্লাহকে ভয় করে, তাদের শয়তান যখন কুমন্ত্রণা দেয় তখন তারা আল্লাহকে স্মরণ করে এবং এতে তাদের জ্ঞানচক্ষু খুলে যায়।’ (সুরা আরাফ ২০১)
এই আয়াতের ব্যাখ্যায় তাফসিরে যাকারিয়াতে বলা হয়েছে, শয়তান যেহেতু ইসলামের পথের দিকে দাওয়াত দেওয়ার কাজটি কখনো সহ্য করতে পারে না তাই সে সর্বদাই এ ব্যাপারে প্রতিকূল পরিস্থিতির সৃষ্টি করে। তাই এ আয়াতে বলা হয়েছে, যারা মুত্তাকি তারা নিজেদের মনে কোনো শয়তানি প্ররোচনার প্রভাব এবং কোনো অসৎ চিন্তার ছোঁয়া অনুভব করতেই সজাগ হয়ে ওঠে। তারপর এ পর্যায়ে কোন ধরনের কর্মপদ্ধতি অবলম্বনে দ্বীনের স্বার্থ রক্ষা হবে তা তারা পরিষ্কার দেখতে পায়। তারা তওবা করে এবং প্রচুর পরিমাণে সৎকাজ করে। ফলে শয়তান বিফল মনোরথ হয়ে ফিরে যেতে বাধ্য হয়। এটা আত্মসমালোচনার কারণে।
হাদিস থেকেও আত্মসমালোচনার ধারণা পাওয়া যায়। শাদ্দাদ ইবনে আওস (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘বুদ্ধিমান ওই ব্যক্তি, যে নিজের নফসের সমালোচনা করে এবং মৃত্যু-পরবর্তী জীবনের জন্য আমল করে। আর নির্বোধ ও অক্ষম সেই ব্যক্তি, যে নিজের নফসের কামনা-বাসনার অনুসরণ করে চলে এবং আল্লাহর কাছে বড় বড় আশা পোষণ করে। (জামে তিরমিজি)
আত্মসমালোচনার গুরুত্ব সম্পর্কে হজরত ওমর (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘তোমরা নিজেদের আমলনামার হিসাব নিজেরাই গ্রহণ করো, চূড়ান্ত হিসাব দিবসে তোমাদের কাছ থেকে হিসাব গৃহীত হওয়ার পূর্বেই। আর তোমরা তোমাদের আমলনামা ওজন করে নাও চূড়ান্ত দিনে ওজন নেওয়ার আগেই। কেননা আজকের দিনে নিজের হিসাব নিজেই গ্রহণ করতে পারলে আগামী দিনের চূড়ান্ত মুহূর্তে তা তোমাদের জন্য সহজ হয়ে যাবে। তাই সেই মহাপ্রদর্শনীর দিনের জন্য তোমরা নিজেদের সুসজ্জিত করে নাও, যেদিন তোমরা (তোমাদের আমলসহ) উপস্থিত হবে এবং তোমাদের কোনো কিছুই সেদিন গোপন থাকবে না।’ (জামে তিরমিজি)
অনুরূপভাবে হাসান বসরি (রহ.) বলেন, ‘মুমিন ব্যক্তিকে স্বীয় আত্মার পরিচালক হিসেবে আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্যই আত্মসমালোচনা করতে হবে। যারা দুনিয়াতে আত্মসমালোচনা করে, কেয়ামতের দিন অবশ্যই তাদের আমলের হিসাব সহজ হবে। আর যারা এ বিষয়টি থেকে বিরত থাকবে, কেয়ামতের দিন তাদের হিসাব কঠিন ও কষ্টদায়ক হবে।’(আজ-জুহদ ৩০৮)
ইমাম শাফেয়ি (রহ.) বলেন, ‘সবচেয়ে জ্ঞানী ব্যক্তি সেই যে দুনিয়াকে পরিত্যাগ করে দুনিয়া তাকে পরিত্যাগ করার পূর্বেই। কবরকে আলোকিত করে কবরে বসবাস করার পূর্বেই। স্বীয় প্রভুকে সন্তুষ্ট করে তার সঙ্গে সাক্ষাৎ লাভের পূর্বেই। নিজের হিসাব নিজেই গ্রহণ করে হিসাব দিবসে তার হিসাব গ্রহণ করার পূর্বেই। জামাতে নামাজ আদায় করে তার ওপর জামাতে নামাজ (জানাজার নামাজ) পড়ার পূর্বেই।’
মালেক বিন দিনার (রহ.) বলেন, ‘আল্লাহর রহম ওই বান্দার প্রতি যে তার নফসকে (কোনো মন্দ কাজের পর) বলে, তুমি কি এর সাথী নও? অতঃপর তাকে নিন্দা করে, এরপর তার লাগাম টেনে ধরে, অতঃপর আল্লাহর কিতাবের ওপরে তাকে আটকে রাখে তখন সে হয় তার পরিচালক। (ইগাসাতুল লাহফান ১/৭৯)
ভয়েস/আআ