মঙ্গলবার, ০১ Jul ২০২৫, ০৪:০৯ অপরাহ্ন

দৃষ্টি দিন:
সম্মানিত পাঠক, আপনাদের স্বাগত জানাচ্ছি। প্রতিমুহূর্তের সংবাদ জানতে ভিজিট করুন -www.coxsbazarvoice.com, আর নতুন নতুন ভিডিও পেতে সাবস্ক্রাইব করুন আমাদের ইউটিউব চ্যানেল Cox's Bazar Voice. ফেসবুক পেজে লাইক দিয়ে শেয়ার করুন এবং কমেন্ট করুন। ধন্যবাদ।

কার মতে কার ঐক্য?

মোস্তফা কামাল:
সেই জুলাই আর এই জুলাই। ঐক্য, বোধ, মত, চাওয়া-পাওয়ার কত যে ফের! চব্বিশের জুলাইতে নিজ দলের পতাকা নয়, প্রায় সবাই দেশের পতাকা তুলে ধরেছিল। ঝাঁপিয়ে পড়েছিল, ফ্যাসিবাদ থেকে মুক্তি পেতে রক্তক্ষয়ী আন্দোলনে। ছোট-বড় দলগুলো এক বছরের ব্যবধানে এখন যার যার দলীয়, পারলে ব্যক্তিগত এজেন্ডায় বলীয়ান। ভিন্ন ভিন্ন চিন্তায় বিভোর। সবাইকে কাছাকাছি রাখতে পারছে না সরকার। বিশেষ করে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন। রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনার অগ্রগতি আশাব্যঞ্জক নয়, খোলামেলাই বলেছেন জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সহসভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ। যে কমিশনের সভাপতি স্বয়ং প্রধান উপদেষ্টা নোবেল লরিয়েট বিশ্বময় খ্যাতিমান প্রফেসর ড. ইউনূস। আস্থা-বিশ্বাসেও চরম ঘাটতি। ভর করেছে অবিশ্বাসও। প্রধান দল বিএনপির সন্দেহ, নির্বাচন বিলম্বিত করার ষড়যন্ত্র চলছে। সংস্কারের নামে কাজের কাজ না করে, খানাপিনা বেশি হচ্ছে এমন কঠিন কথাও ছোড়া হয়েছে। বিএনপি ক্ষমতামুখী-নির্বাচনমুখী দল। তাদের প্রধান চাওয়া নির্বাচন। সেখানে প্রাপ্তির ঘাটতি। সরকারের দিক থেকে সংস্কারের চাপ। এর সঙ্গে ব্যাপক সায় জামায়াতে ইসলামী, ছাত্রদের সংগঠন এনসিপিসহ কয়েকটি দলের। বিএনপিকে পেয়ে বসার যেন মানসিকতা দিন দিন স্পষ্ট হয়ে উঠছে।

ঐকমত্য কমিশন চেয়ারম্যান আলী রীয়াজ সর্বশেষ রবিবার হতাশার স্বরে-সুরে বলেছেন, ‘আমরা স্বপ্ন দেখেছিলাম, আবু সাঈদের শাহাদাত বার্ষিকীতে সবাই মিলে জুলাই সনদে স্বাক্ষর করব। কিন্তু বাস্তবে সেটা কতটা সম্ভব হবে, তা নির্ভর করছে রাজনৈতিক দলগুলোর ওপর। আমরা খানিকটা শঙ্কিত যে, সে জায়গায় আমরা যাব না।’ রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের দ্বিতীয় দফার সপ্তম দিনের আলোচনার শুরুতে এমন আফসোস তার। নির্বাচন নিয়ে বোঝাপড়ার ফারাকের মধ্যেই চলে আসছে সাংবিধানিক ও সংবিধিবদ্ধ প্রতিষ্ঠানের নিয়োগ কমিটি, দ্বিকক্ষবিশিষ্ট পার্লামেন্ট, উচ্চকক্ষের নির্বাচন প্রক্রিয়া ও উচ্চকক্ষের দায়িত্ব ও ভূমিকাসহ আরও কত কী? গোটা দেশ গেল জুলাইতে যে নিপীড়নের মধ্যে ছিল, রাজনীতিকরাও কী দুর্গতিতে ছিলেন, এ জুলাইতে এসে সব কেমন যেন! সবাই বলছেন, কেউ আর আগের অবস্থায় ফিরে যেতে চান না। কিন্তু, কম-বেশি পেছনের টান সবার। সংস্কার প্রস্তাবে ঐকমত্য কমিশন মাঝেমধ্যে কঠোর থেকে নমনীয় হয়। অবস্থানে ছাড় দেয়। নির্বাচনে নিশ্চিত ব্যাপক বিজয়ের সম্ভাবনার দল বিএনপি, এরইমধ্যে অনেক ছাড় দিয়েছে। এরপরও অনাস্থা-অবিশ্বাসের বিস্তার। কথায়ও কেউ কাউকে ছাড়ছেন না। সংস্কারের যেসব বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলো একমত হবে, সে বিষয়গুলো একত্র করে জুলাই সনদ স্বাক্ষরের কথা উল্লেখ করে বিএনপি নেতা সালাহউদ্দিন আহমদ বলেছেন, ‘এখন এখানে যদি আমাদের বাধ্য করা হয় যে একমত হতেই হবে, তাহলে সেটা তো সঠিক হলো না।’ যদি জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের শতভাগ প্রস্তাবে একমত হতে বলা হয়, তাহলে আলোচনার জন্য ডাকা হলো কেন, সে প্রশ্নও তুলেছেন তিনি।

এদিকে, কড়া-মিঠা কথার তেজ এনসিপিরও। এখন আর কেবল বিএনপিকে লক্ষ্য করে নয়, সরকারের প্রতিও তাদের কথার বোলিং। সঙ্গে ব্যাটিংও। সরকার জুলাই ঘোষণাপত্র দিতে ব্যর্থ হয়েছে অভিযোগ করে এনসিপি থেকে বলা হয়েছে, তারাই ওই ঘোষণা দিয়ে দেবে। ক’দিন আগে বিএনপি থেকে যেমন বলা হয়েছিল, সরকার নির্বাচন দিতে দেরি করলে তারাই সিডিউল ঘোষণা করে দেবে। রবিবার জুলাই অভ্যুত্থানের বর্ষপূর্তিতে সংবাদ সম্মেলনে দলটির পক্ষ থেকে এনসিপি জানিয়েছে, আগামী ৩ আগস্ট এনসিপির পক্ষ থেকে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে জুলাই ঘোষণাপত্র ও ইশতেহার পাঠ করা হবে। গত বছরের ঠিক এ দিনেই কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে ফ্যাসিবাদবিরোধী এক দফা ঘোষণা করা হয়েছিল। জুলাই ঘোষণাপত্র সরকারের দেওয়ার কথা ছিল। আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধের দাবির সময় সরকার ৩০ কার্যদিবস সময় দিয়েছিল। সেই ৩০ কার্যদিবস পার হয়ে গেছে। ঘোষণাপত্র না থাকায় এখন পর্যন্ত জুলাইয়ের ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট, সাংবিধানিক স্বীকৃতি ও শহীদের স্বীকৃতি ইত্যাদি অনিশ্চিত। সরকারের দিক থেকে ওয়াদা ছিল, সব দলের সঙ্গে আলোচনা করে ঐকমত্যের মাধ্যমে এ ঘোষণা দেওয়ার। যে জাতীয় সনদ উৎসর্গ করা হবে তাদের প্রতি, যারা গত দেড় দশক ধরে দমন-পীড়ন, হত্যাযজ্ঞ, গুপ্তহত্যা ও রাষ্ট্রীয় নির্যাতনের মুখোমুখি হয়ে পিছু হটেননি; বরং নিষ্ক্রিয়তা ও আপসকামিতার অন্ধকার ছুড়ে ফেলে রাজনৈতিক মাঠে তীব্র বিস্ফোরকের জোগান দিয়েছেন এবং পরিশেষে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-আন্দোলন পুঞ্জীভূত ক্রোধে আগুন জ্বেলে ফ্যাসিবাদের মসনদ ছারখার করে দিয়েছে। যারা মৃত্যুকে উপেক্ষা করে বুক পেতে দিয়েছেন বুলেটের মুখে, যারা নির্যাতনের মঞ্চে দাঁড়িয়ে দুর্বার গর্জনে রাষ্ট্রের নির্মম নিস্তব্ধতা ভেঙেছেন, প্রতিরোধের আগুনে নিজেদের সঁপে দিয়েছেন যারা সর্বোপরি সেই জনগণ, যারা বুকের তাজা রক্তে বৈষম্যবিরোধী প্রজাতন্ত্র নির্মাণের অভিপ্রায় ঘোষণা করেছেন, তারাই জাতীয় সনদের অনুপ্রেরণা। জুলাই গণঅভ্যুত্থানে শ্রমজীবী, পেশাজীবী, ছাত্র-জনতা, প্রান্তিক মানুষ সবাই মিলে প্রমাণ করেছেন, বীরত্ব কোনো শ্রেণির নয়, এটি মানুষের চেতনার শ্রেষ্ঠতম রূপ। এই গণঅভ্যুত্থানের অভিপ্রায়ই জাতীয় সনদের নৈতিক ভিত্তি। ‘রক্তস্নাত গণঅভ্যুত্থানের পর বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংবিধানিক প্রেক্ষাপটে একটি ‘জাতীয় সনদ’ প্রণয়ন অপরিহার্য। সরকার ৮ আগস্টকে নতুন বাংলাদেশ দিবস করার কাজেও হোঁচট খেয়ে সরে এসেছে। ভেতরে-ভেতরে অবস্থা স্বস্তিদায়ক নয়। নির্বাচন সামনে রেখে চিন্তার বাইরেও অনেক প্রশ্ন ঘুরছে। সংস্কারের বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলো কতটা ঐকমত্যে আসতে পারবে, এলেও কত সময় লাগবে এমন অনেক জিজ্ঞাসার জবাব মিলছে না। কথা ছিল আলোচনা শেষ হওয়ার পর সবার জুলাই সনদে সই করার কথা, যার ভিত্তিতে আগামী নির্বাচন হবে। সেখানে এখন অনেক ধোঁয়াশা। কারও মতে, মৌলিক সংস্কার না হলে নির্বাচন করলে ফের স্বৈরতন্ত্রের আগমন ঘটবে। কেউ বলছেন, সংস্কার নিয়ে বেশি জোরাজুরি করলে নির্বাচনই অনিশ্চিত হয়ে পড়বে। আবার কারও মতে, সংস্কারের জন্য অন্তর্বর্তী সরকারের নেওয়া উদ্যোগ আরোপিত। মত চাপিয়ে দেওয়ার মানসিকতা। বিএনপির সঙ্গে ঐকমত্য কমিশনের অনেক দ্বিমত। নতুন দল এনসিপি অধিকাংশ বিষয়ে কমিশনের সঙ্গে সহমত। অন্যান্য দলের মধ্যে গণতন্ত্র মঞ্চ ও ১২ দলীয় জোট বিএনপির প্রস্তাবের সঙ্গে মোটামুটি একমত। বিএনপির ৩১ দফায় তাদেরও সায় ছিল।

জামায়াতে ইসলামীসহ দক্ষিণমুখীদের বিভিন্ন বিষয়ে সায় এনসিপির দিকে। মাঠের রাজনীতিতে তা এখন বিরোধের ঘনঘটায় রূপ নিয়েছে। দুই পক্ষই একে অপরের বিরুদ্ধে প্রশাসনকে প্রভাবিত করাসহ নানা অভিযোগ ছুড়ছে। বিএনপির বড় অভিযোগ, অন্তর্বর্তী সরকার এনসিপিকে পৃষ্ঠপোষকতা করছে। এনসিপির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম সরকার থেকে পদত্যাগ করলেও অপর দুজন করেননি। তারা নিজেদের অবস্থানও ব্যাখ্যা করেননি। এ অবস্থায় জাতীয় ঐকমত্য কমিশন কীভাবে বহুমত-পথকে এক জায়গায় করবে? কার মতের সঙ্গে কার মতকে মেলাবে? কাকে সহমত পার্টিতে জায়গা দেবে? এসব প্রশ্ন গোটা আবহকে জটিল থেকে জটিলতর করে তুলছে। সেক্ষেত্রে কাক্সিক্ষত-আলোচিত সনদ বা ঘোষণাই বরবাদ হয়ে যাওয়ার শঙ্কা ভর করেছে। বিশ্ব ইতিহাসে দেশে দেশে বহুবার ‘জাতীয় সনদ’ বা ‘গণচুক্তি’র মাধ্যমে সমাজ পুনর্গঠনের নজির রয়েছে। এটি একটি রাজনৈতিক দলিল। ফ্যাসিবাদী ব্যবস্থার বিপরীতে গণমানুষের ঐকমত্যের স্মারক। ভবিষ্যতের জন্য রাষ্ট্রের সঙ্গে জনগণের রাজনৈতিক ও নৈতিক চুক্তি। সেই চুক্তি নানান যুক্তিতর্কে কেবলই বিলম্বিত। এক জুলাই শেষে আরেক জুলাইতেও অনিশ্চিত। বিজয়ের সম্মিলন না থাকলে অন্যায়ের স্বীকারোক্তি ও অনুশোচনার ক্ষেত্র তৈরি হয় না। জুলাই অভ্যুত্থানে নারকীয় তাণ্ডব ও হত্যালীলার জন্য আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধ হলেও সেজন্য এখনো কোনো অনুশোচনায় আসেনি। ভুল করেছে বলে মনেও করে না। বরং ভবিষ্যতে সুযোগ পেলে আরও করবে বা দেখিয়ে দেবে বলে হুঙ্কার ছাড়ছে।

স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব এবং আমাদের অর্থনৈতিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক শৃঙ্খলার মৌলিক নিশ্চয়তা হবে জাতীয় ঐক্য এবং সব অপশক্তি মোকাবিলার প্রেরণা। জাতীয়তাবাদ এবং রাষ্ট্রের অভ্যন্তরে বিভিন্ন জাতিসত্তার আত্মনিয়ন্ত্রণ অধিকার নিশ্চিত করাই হবে স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বের রক্ষাকবচ। ‘জাতীয় সনদ’ কোনো বিনামূল্যের উপহার নয়, বরং রক্ত দিয়ে অর্জিত সমগ্র জাতির আকাক্সক্ষার অভিব্যক্তিস্বরূপ প্রজাতন্ত্রের একটি উজ্জ্বল মহৎকীর্তি। ‘জাতীয় সনদ’ কেবল একটি রাজনৈতিক চুক্তি নয় এটি ইতিহাস, ন্যায়, রক্তের উত্তরাধিকার এবং ভবিষ্যতের মধ্যে একটি নৈতিক সেতুবন্ধ। ‘জাতীয় সনদ’ একটি ঘোষণা, একটা দৃঢ়সংকল্প, একটি প্রতিশ্রুতি এবং আমাদের প্রত্যেক নাগরিকের জন্য এটা একটা পবিত্র উৎসর্গ। নানা ঘটনা ও কাণ্ডকীর্তিতে সেখানে পবিত্রতার বদলে অপবিত্রতার ছায়াপাত। এসব ছায়ার প্রতিফলন বিএনপি, জামায়াত, এনসিপি, বাম ও ইসলামপন্থি দলগুলোর মধ্যে। যা জাতীয় ইস্যুতে রাজনৈতিক ঐকমত্য গড়ে তোলাকে মহাচ্যালেঞ্জে ফেলেছে। আর সাংবিধানিক ও প্রশাসনিক সংস্কার, ক্ষমতা কাঠামো ও সংবিধানের মৌলিক সংস্কারও বড় চ্যালেঞ্জ সরকারের কাছে। এসব চ্যালেঞ্জে না জিতলে, চলমান অবিশ্বাস-অস্থিরতা দীর্ঘস্থায়ী হয়ে ওঠার সমূহ শঙ্কা সাধারণ কাণ্ডজ্ঞানেই বোধযোগ্য।

লেখক: সাংবাদিক-কলামিস্ট ডেপুটি হেড অব নিউজ, বাংলাভিশন

mostofa71@gmail.com

ভয়েস/আআ/দেশরূপান্তর

Please Share This Post in Your Social Media

© All rights reserved © 2023
Developed by : JM IT SOLUTION