বুধবার, ০২ Jul ২০২৫, ১২:৫৪ পূর্বাহ্ন
ভয়েস নিউজ ডেস্ক:
আজ ১ জুলাই। ২০২৪ সালের এই মাস বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে এক গভীর অধ্যায়ের সৃষ্টি হয়। সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবিতে শুরু হওয়া ছাত্র আন্দোলন ক্রমেই একটি গণজাগরণে রূপ নেয়। যার পরিসমাপ্তি ঘটে স্বৈরাচারী আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের মধ্য দিয়ে। শিক্ষার্থীদের নেতৃত্বে শুরু হওয়া এই আন্দোলন সফল গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে শেষ হয়।
২০২৪ সালের ৫ জুন ২০১৮ সালের কোটা বাতিলের সরকারি প্রজ্ঞাপনকে হাইকোর্ট কর্তৃক অবৈধ ঘোষণা করে। এই রায়ের মাধ্যমে সরকারি চাকরিতে কোটা পদ্ধতি পুনর্বহাল করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়; যা মেধার অবমূল্যায়ন বলে করে শিক্ষার্থীরা। সরকার ২০১৮ সালে তীব্র ছাত্র আন্দোলনের চাপে প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির সরকারি চাকরিতে কোটা বাতিল করেছিল। কিন্তু হাইকোর্টের রায়ে ৫৬ শতাংশ কোটা পুনঃপ্রবর্তিত হয়, যাতে মুক্তিযোদ্ধার সন্তানদের জন্য ৩০ শতাংশ, নারীদের জন্য ১০ শতাংশ, পশ্চাৎপদ জেলার জন্য ১০ শতাংশ, সংখ্যালঘুদের জন্য ৫ শতাংশ এবং প্রতিবন্ধীদের জন্য ১ শতাংশ বরাদ্দ করা হয়।
ছাত্ররা এই ব্যবস্থাকে মেধাবীদের প্রতি বৈষম্য হিসেবে মনে করে প্রতিবাদে রাস্তায় নামে। সরকার প্রতিবাদকারীদের কঠোরভাবে দমন করতে চাইলে পরিস্থিতি বিদ্রোহে রূপ নেয়।
গত বছরের ৫ জুন কোটা বাতিলের সিদ্ধান্তকে অবৈধ ঘোষণার প্রতিবাদে সেদিন রাতেই ক্যাম্পাসে মিছিল ও সমাবেশ করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। আন্দোলনের কেন্দ্রীয় সমন্বয়ক এবং বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া তার ‘জুলাই : মাতৃভূমি অথবা মৃত্যু’ বইতে লিখেছেন, ‘৫ জুন বিকেলে আমি ঢাকা মেডিকেল কলেজের পাশে চানখাঁরপুলে স্কুটি মেরামত করাচ্ছিলাম। তখন ফেসবুকে দেখিÑ হাইকোর্ট কোটা পুনর্বহাল করেছে। মনে হলো ২০১৮ সালের অর্জনগুলো ধূলিসাৎ হয়ে যাচ্ছে।’ এরপর কেন্দ্রীয় লাইব্রেরির সামনে সাধারণ শিক্ষার্থীদের নিয়ে এক বৈঠকের মাধ্যমে প্রতিবাদ কর্মসূচির সূচনা হয়। রাত সাড়ে ৭টায় ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী’ ব্যানারে একটি মিছিল বের হয় এবং সেখানে সংক্ষিপ্ত সমাবেশের মধ্যদিয়ে তা শেষ হয়। এই সমাবেশে তারা হাইকোর্টের রায়কে ‘মেধাবীদের সঙ্গে তামাশা’ বলে প্রত্যাখ্যান করে।
৩০ জুন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা মানববন্ধনের আয়োজন করে। যা ছিল আন্দোলনের প্রথম বড় আকারের কর্মসূচি। সারা দেশের অন্য শিক্ষার্থীরা এতে উদ্বুদ্ধ হয়।
১ জুলাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা তিন দিনের কর্মসূচি ঘোষণা করে। যার মধ্যে ছিল বিক্ষোভ মিছিল, গণসমাবেশ এবং অবরোধ। এর পরপরই এই আন্দোলন দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়সহ অন্যান্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে। ২ থেকে ৬ জুলাই পর্যন্ত দেশের প্রায় সব বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা রাজপথে নেমে আসে। তারা বিভিন্ন স্থানে সড়ক ও রেলপথ অবরোধ করে প্রতিবাদ ও বিক্ষোভ চালায়।
৭ জুলাই শিক্ষার্থীরা সারা দেশে ‘বাংলা ব্লকেড’ কর্মসূচি ঘোষণা করে। এতে ঢাকার পাশাপাশি বড় শহরগুলোতে ব্যাপক বিক্ষোভ ও অবরোধ কর্মসূচি চলে। বিক্ষোভ ও অবরোধ কর্মসূচিতে সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা বিভিন্ন ক্যাম্পাসে আন্দোলন দমনের চেষ্টা চালায়। তারা শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা চালায়, ভয়ভীতি দেখায় এবং সরকারি প্রশাসনের সঙ্গে মিলে আন্দোলন দমন করার প্রচেষ্টা চালায়। তবে এসব সহিংসতা আন্দোলনের শক্তি যেন আরও বাড়িয়ে দেয়।
১৬ জুলাই, রংপুরের রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে পুলিশের সরাসরি গুলিতে আবু সাঈদ শহীদ হন। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া সেই নির্মম হত্যার ভিডিও দেখে দেশের মানুষ ক্ষোভে ফেটে পড়ে। শিক্ষার্থীদের আন্দোলন তখন ক্যাম্পাসের বাইরে চলে আসে। সকল শ্রেণি-পেশার মানুষ জড়িয়ে পড়ে। রূপ নেয় জাতীয় আন্দোলনে। এই হত্যাকাণ্ডের পর ঢাকাসহ দেশের অন্যান্য জায়গার বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়, কলেজ এবং মাদ্রাসার শিক্ষার্থীরাও রাস্তায় নেমে আসে। তারাও অবরোধ-বিক্ষোভ কর্মসূচি চালায়। একই দিন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন ক্যাম্পাসে পুলিশ এবং ছাত্রলীগের হামলা হয়। ১৬ জুলাই আন্দোলনে উত্তাল হয়ে ওঠে বন্দর নগরী চট্টগ্রাম। রংপুরে আবু সাঈদের শহীদ হওয়ার কিছুক্ষণ পরেই চট্টগ্রামে সন্ত্রাসীদের গুলিতে শহীদ হন চট্টগ্রাম কলেজ ছাত্রদলের আহ্বায়ক কমিটির সদস্য ওয়াসিম আকরাম। ১৬ জুলাইয়ের পর আন্দোলন দমন করার জন্য ঢাকার মধ্যে সরকার ইন্টারনেট সেবা বন্ধ করে দেয়।
১৮ জুলাই আন্দোলনকারীরা সারা দেশে কমপ্লিট শাটডাউনের ডাক দেন। সেই দিন বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা নিহতদের স্মরণে শহীদবেদি নির্মাণ করেন। এ সময় সরকারের দমননীতি তখন আরও কঠোর হয়ে ওঠে। সেনাবাহিনী মোতায়েন করা হয়, কারফিউ জারি করা হয় এবং আন্দোলনের নেতাদের গ্রেপ্তার চলতে থাকে। ২৬ জুলাই আন্দোলনের তিনজন সমন্বয়ককে সাদা পোশাকধারী পুলিশ তুলে নিয়ে যায়। কিন্তু এসব ভয়ভীতি শিক্ষার্থীদের মনোবল ভাঙতে পারেনি। বরং আন্দোলন আরও বিস্তৃত হয়।
২৮ জুলাই দেশজুড়ে বিক্ষোভ ও সমাবেশের ঢল নামে। ৩১ জুলাই বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা একযোগে ‘মার্চ ফর জাস্টিস’ কর্মসূচি পালন করেন। ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন শহরে লাখো মানুষ রাস্তায় নেমে আসে।
১ আগস্ট গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) হেফাজতে থাকা বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ছয় সমন্বয়ককে ছেড়ে দেওয়া হয়। এদিন জামায়াতে ইসলামী ও ইসলামী ছাত্রশিবিরকে নিষিদ্ধ করে প্রজ্ঞাপন জারি করে সরকার।
৩ আগস্ট ব্যাপক বিক্ষোভের পর শিক্ষার্থী সমন্বয়ক এবং আন্দোলনের অন্য নেতারা শেখ হাসিনাকে পদত্যাগ এবং ক্ষমতা ছেড়ে দেওয়ার জন্য এক দফা দাবি ঘোষণা করেন। অভ্যন্তরীণ বিতর্ক ও পরামর্শের ফলে সেনাবাহিনীর নেতৃত্ব আন্দোলনের বিরোধিতা না করার সিদ্ধান্ত নেন। বলপ্রয়োগের মাধ্যমে আন্দোলন দমনে আওয়ামী লীগের মরিয়া চেষ্টা অব্যাহত ছিল শেষ পর্যন্ত।
৪ আগস্টও পুলিশ প্রতিবাদী ক্ষুব্ধ জনতার ওপর আক্রমণ চালায়। প্রধানমন্ত্রীর সরকারি বাসভবন অবরোধের জন্য দেশজুড়ে ব্যাপক বিক্ষোভ প্রদর্শনে ছাত্র সমন্বয়কেরা ‘লংমার্চ টু ঢাকা’ কর্মসূচির আহ্বান জানান। মার্চ টু ঢাকা কর্মসূচি প্রথমে ৬ আগস্ট ঘোষণা করা হলেও ব্যাপক জনসমর্থনের কারণে সমন্বয়কেরা ঘোষণা দিয়ে ৫ আগস্ট এগিয়ে আনেন। শিক্ষার্থীরা দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ঢাকা শহরে বিক্ষোভকারীদের প্রবেশের সমন্বয় করেন।
৫ আগস্ট সোমবার সকালেও রাজধানীর বিভিন্ন পয়েন্টে ছাত্র-জনতার সঙ্গে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সংঘর্ষ চলে। গুলিতে সেদিনও অনেক শিক্ষার্থী নিহত হন। ৫ আগস্ট সোমবার সকালেও রাজধানীর বিভিন্ন পয়েন্টে ছাত্র-জনতার সঙ্গে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সংঘর্ষ চলে। গুলিতে সেদিনও অনেক শিক্ষার্থী নিহত হন। ‘মার্চ টু ঢাকা’ কর্মসূচিতে অংশ নেওয়া লাখো মানুষের সমাবেশ দুপুর আড়াইটার দিকে যাত্রা করে গণভবনের দিকে। এরপর জনগণের উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে শেখ হাসিনার পদত্যাগের কথা বলেন সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান। ৬ আগস্ট শান্তিতে নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকার গঠনে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের প্রস্তাব মেনে নেন রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন। সংসদ বিলুপ্ত করা হয়। ৭ আগস্ট পুলিশের শীর্ষ পর্যায়ে রদবদল। চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুনকে বাদ দিয়ে মো. ময়নুল ইসলামকে আইজিপি নিয়োগ। র্যাব ও ডিএমপি কমিশনারও পরিবর্তন করা হয়।অ্যাটর্নি জেনারেল এ এম আমিন উদ্দিন পদত্যাগ করেন। মুখ্য সচিব মো. তোফাজ্জল হোসেন মিয়ার নিয়োগ বাতিল করা হয়। ৮ আগস্ট প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূসসহ ১৪ জন উপদেষ্টাকে শপথ পড়ান রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন।
ভয়েস/জেইউ।