রবিবার, ০৬ Jul ২০২৫, ০৬:৫০ অপরাহ্ন
মাইসারা জান্নাত:
আজকের শিশুরাই আগামীর সমাজ, রাষ্ট্র ও উম্মাহর নেতৃত্বের দায়িত্ব গ্রহণ করবে। কিন্তু নেতৃত্বের উপযুক্ত হওয়ার আগে তাদের প্রয়োজন সুন্দর চরিত্র, মূল্যবোধ, আত্মশুদ্ধি ও একটি সুশৃঙ্খল জীবনবোধ। এই জীবনবোধের কেন্দ্রে থাকা উচিত ধর্ম, যা তাকে ন্যায়-অন্যায়, হালাল-হারাম, সৎকর্ম ও অসৎকর্ম সম্পর্কে অবহিত করবে। অথচ দুঃখজনকভাবে বলতে হয়, আধুনিকতার ঢেউ আর প্রযুক্তির বেপরোয়া আগ্রাসনে নতুন প্রজন্মের এক বড় অংশ আজ ধর্ম থেকে দূরে সরে যাচ্ছে।
নামাজে অনাগ্রহ, কোরআনের সঙ্গে দূরত্ব, সুন্নাহের প্রতি অবজ্ঞা, নৈতিক অবক্ষয় ও আধ্যাত্মিক শূন্যতা এই প্রজন্মের মধ্যে স্পষ্ট হয়ে উঠছে। এই সংকটের জন্য যেমন বহির্জাগতিক অনেক কারণ দায়ী, তেমনি দায় এড়াতে পারে না পরিবার, যা শিশুর প্রথম বিদ্যালয় এবং মা-বাবা, যারা তার প্রথম শিক্ষক।
কীভাবে একটি পরিবার নতুন প্রজন্মের মধ্যে ধর্মবোধ, নৈতিকতা ও ইসলামি আদর্শবোধ গড়ে তুলতে কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে, তা এখানে উল্লেখ করা হলো।
ধর্মীয় চেতনার বীজ : ধর্মীয় চেতনার বীজ বপনের সময় হলো শৈশব। নবী করিম (সা.) বলেছেন, প্রত্যেক শিশু ফিতরার ওপর জন্মগ্রহণ করে। অতঃপর তার পিতা-মাতা তাকে ইহুদি, খ্রিস্টান বা অগ্নিপূজক বানায়।
(সহিহ বুখারি)
এই হাদিস থেকে বোঝা যায়, শিশুর চরিত্র, বিশ্বাস ও জীবনের গঠন পুরোপুরি নির্ভর করে তার পারিবারিক শিক্ষার ওপর। একজন শিশু জন্মগতভাবে নিষ্পাপ, স্বচ্ছ ও গ্রহণক্ষম হৃদয় নিয়ে পৃথিবীতে আসে। সে যেভাবে গঠিত হয়, সেটার ভিত্তি স্থাপন করে পরিবার। তাই শৈশবেই তাকে মহান আল্লাহ, নবীজি (সা.), নামাজ, সত্যবাদিতা, পরোপকার, হালাল-হারামের পার্থক্য ইত্যাদি বিষয়ে শেখাতে হবে।
ধর্মীয় শিক্ষা ও চর্চা : শিশুকে যদি আমরা শুধু মুখস্থ কিছু দোয়া, কালেমা বা কিতাবি জ্ঞান দিই, অথচ সেই ধর্মীয় নীতির কোনো বাস্তব অনুশীলন না দেখি পরিবারে, তবে সে ধর্মকে আলাদা কোনো বিষয়ে পরিণত করে ফেলবে। অথচ ধর্মশিক্ষা হওয়া উচিত জীবনের অংশ। যেমন খাবারের আগে ও পরে মা-বাবা যদি দোয়া পড়ে, পরিবারের সবাই একসঙ্গে নামাজ পড়তে দাঁড়ায়, কেউ কটু কথা বললে মা-বাবা সতর্ক করেন যে ‘মুসলমান হিসেবে এটা শোভনীয় নয়’, তাহলে শিশুর মনে স্বাভাবিকভাবেই গেঁথে যাবে, ধর্ম মানে জীবনবিধান।
ঘরে ধর্মীয় পরিবেশ : একজন শিশু যদি ঘুম থেকে উঠে দেখে, মা-বাবা তাহাজ্জুদের নামাজে দাঁড়ানো, কোরআন তেলাওয়াত করছেন কিংবা জিকির-আজকারে ঘর মুখর থাকে, তাহলে তার মনেও গেঁথে যাবে, ‘আমার পরিবারে ধর্ম মানে ভালোবাসা ও প্রশান্তি।’ তবে পরিবেশ গড়ে তোলার সময় কিছু বিষয়ে সতর্ক থাকতে হবে। যেমন ধর্ম শেখানোর নামে কঠোরতা নয়, বরং অনুপ্রেরণা দিতে হবে। শিশুর বয়স ও মানসিকতার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে বুঝাতে হবে। কোনো ভুল হলে তাকে অপমান বা ভীতি না দেখিয়ে ভালোভাবে সংশোধন করতে হবে।
ধর্মের প্রতি আগ্রহ সৃষ্টি : অনেক মা-বাবা ভাবেন, ভয় দেখিয়ে সন্তানকে ধর্মের পথে আনা যায়। কিন্তু বাস্তবতা হলো, ভয় দিয়ে কেউ স্থায়ীভাবে সৎ হতে পারে না। বরং ভালোবাসা, হৃদ্যতা ও সম্পর্কের উষ্ণতা দিয়েই শিশুর মনে আল্লাহর প্রতি টান গড়ে তুলতে হয়। সন্তানকে মহান আল্লাহ সম্পর্কে এভাবে বোঝান, ‘আল্লাহ আমাদের সবচেয়ে বেশি ভালোবাসেন, তিনি আমাদের সব কাজ দেখেন, তিনি খুশি হলে আমাদের দোয়া কবুল হয়।’ নবীজি (সা.)-এর গল্প বলুন যাতে ভালোবাসা জাগে। এভাবে শিশুর হৃদয়ে ধর্ম এক প্রিয় ভালোবাসার জগৎ হয়ে উঠবে।
ধর্মীয় শিক্ষার ব্যবস্থাপনাগত দিক : শিশু সন্তানকে মাদ্রাসা বা ইসলামি শিক্ষাকেন্দ্রে পাঠানো একটি ভালো উদ্যোগ, তবে তা যথেষ্ট নয়। কারণ শিশুর অধিকাংশ সময় কাটে পরিবারে। তাই ঘরে কিছু ব্যবস্থা থাকা জরুরি। যেমন প্রতিদিন অন্তত ১৫ মিনিট কোরআন শেখার সময় নির্ধারণ করা, নবী (সা.)-এর জীবনী বা সাহাবিদের কাহিনি নিয়ে একসঙ্গে পড়া বা শোনা, সপ্তাহে একদিন পুরো পরিবার মিলে ইসলামিক আলোচনা বা কুইজ আয়োজন করা। সাম্প্রতিক সময়ের অনেক অ্যাপ, অডিও-বুক, অ্যানিমেটেড সিরিজও আছে যেগুলো ধর্মীয় শিক্ষা দেয় শিশুবান্ধব ভাষায়, এগুলোও কাজে লাগানো যেতে পারে।
প্রযুক্তির যুগে চ্যালেঞ্জ ও করণীয় : বর্তমান সময়ের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে প্রযুক্তির প্রতি আসক্তি। স্মার্টফোন, ট্যাব, ইউটিউব, গেমস, সোশ্যাল মিডিয়া এসব শিশু ও কিশোরদের মনে গভীর প্রভাব ফেলছে। একদিকে যেভাবে এতে সময় নষ্ট হয়, অন্যদিকে ভুল আদর্শ ও পশ্চিমা সংস্কৃতির গোপন প্রভাব ঢুকে পড়ে।
এই পরিস্থিতিতে করণীয় হলো, সন্তানের প্রযুক্তি ব্যবহার নিয়ন্ত্রণে রাখা, তাকে ইসলামি কনটেন্ট বা শিক্ষামূলক মাধ্যমের সঙ্গে যুক্ত করা, অবসরে মসজিদভিত্তিক কার্যক্রমে সম্পৃক্ত করা।
মা-বাবার ভূমিকা : সন্তান যা দেখে, সেটাই শেখে। বাবা-মা যদি নিজেরাই নামাজ না পড়েন, মিথ্যা বলেন, হারাম রোজগার করেন তাহলে সন্তানকে কীভাবে শেখাবেন যে নামাজ পড়ো, সত্য বলো, হালাল খাও? মহান আল্লাহ কোরআনে বলেন, ‘হে বিশ্বাসীরা! তোমরা নিজেদের ও তোমাদের পরিবারকে এমন আগুন থেকে রক্ষা করো, যার ইন্ধন হবে মানুষ ও পাথর।’
(সুরা তাহরিম ৬) এই আয়াত আমাদের বলে, শুধু নিজে ভালো হলেই হবে না, পরিবারকেও সে পথে আনতে হবে।
অভিভাবকদের জন্য পরামর্শ : এক. প্রতিদিন ১০ মিনিট ধর্মীয় আলোচনা করুন। সহজ ভাষায় শিশুদের জন্য গল্প বলুন, প্রশ্ন করুন, তারা কীভাবে বুঝেছে তা জানুন। দুই. সন্তানকে মসজিদে নিতে অভ্যস্ত করুন। তিন. পবিত্র দিনগুলো উদযাপন করুন ধর্মীয় আবহে যেমন ঈদ, রমজান ইত্যাদি এসব দিন যেন তাদের মনে আনন্দ আর ধর্মীয় স্মৃতি তৈরি করে। চার. তাদের বন্ধু নির্বাচনেও সহায়তা করুন। ভালো বন্ধু মানেই ভালো প্রভাব। শিশুর বন্ধুরাও যেন ধর্মানুরাগী হয় সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। নতুন প্রজন্মকে সৎ, সুশৃঙ্খল ও ধর্মপ্রাণ মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতে চাইলে প্রথমেই পরিবারকে সচেতন হতে হবে। কারণ আল্লাহর রাসুল (সা.) বলেছেন, তোমরা প্রত্যেকেই একজন অভিভাবক এবং প্রত্যেককেই তার অধীনস্তদের ব্যাপারে জবাবদিহি করতে হবে। (সহিহ বুখারি) এই জবাবদিহির অনুভূতি থেকেই আমাদের শিশুদের হৃদয়ে ইসলামের আলো জ্বালাতে হবে। যেন তারা কেবল নামধারী মুসলমান না হয়ে আল্লাহভীরু, নীতিনিষ্ঠ, দায়িত্ববান মানুষে পরিণত হয়, যারা আলোকিত করবে সমাজ, উম্মাহ ও ভবিষ্যৎ পৃথিবী।
ভয়েস/আআ