সোমবার, ১৭ নভেম্বর ২০২৫, ০৬:৩০ পূর্বাহ্ন
আন্তর্জাতিক ডেস্ক:
গাজামুখী গ্লোবাল সুমুদ ফ্লোটিলার একটি নৌকা এগিয়ে যাচ্ছে গাজী অভিমুখে। বৃহস্পতিবার সকালে ইন্সটাগ্রামে ফ্লোটিলার আয়োজকদের পোস্ট করা ছবি।
ইসরায়েলি সেনারা গ্লোবাল সুমুদ ফ্লোটিলাকে ধাওয়া দিয়ে কয়েকটি নৌকায় উঠে গিয়ে দুই শতাধিক অধিকারকর্মীকে গ্রেপ্তার করার পরও গাজা অভিমুখী যাত্রায় অবিচল রয়েছে বাকি নৌকাগুলো। সেখান থেকে বার্তা আসছে, ফিলিস্তিন স্বাধীন না হওয়া পর্যন্ত তাদের পাল উড়বেই।
ফ্লোটিলার মুখপাত্র সাইফ আবুকেশেক বৃহস্পতিবার (২ অক্টোবর) ভোরে এক্সে দেওয়া এক পোস্টে ওই বার্তার তথ্য তুলে ধরে লেখেন, গাজার পথে তাদের মিশন ‘দৃঢ়ভাবে অগ্রসরমান’।
জরুরি সামগ্রী নিয়ে অবরোধ ভাঙার উদ্দেশ্যে গাজা অভিমুখী সুমুদ ফ্লোটিলার অন্তত ১৩টি নৌকার অধিকার্মীদের গ্রেপ্তার করেছে ইসরায়েরি হানাদার বাহিনী। ফ্লোটিলার ওয়েবসাইটে বলা হয়েছে, সাগরে আন্তর্জাতিক আইন অমান্য করে ফ্লোটিলায় হানা দিয়েছে ইসরায়েল।
এক্সের পোস্টে আবুকেশেক লিখেছেন, নাানা বাধা-বিপত্তি সত্ত্বেও তাদের বেশিরভাগ নৌকা গাজা উপত্যকার উপকূলের কাছাকাছি পৌঁছে গেছে।তিনি আরো লিখেছেন, “দখলদার ইসরায়েলি নৌবাহিনীর অবিরাম আগ্রাসন সত্ত্বেও ফ্লোটিলার ৩০টি নৌকা এখনো গাজার পথে অবিচলভাবে এগিয়ে যাচ্ছে।”
অবশ্য ইসরায়েলি বাহিনী দাবি করেছে, সব নৌকার গতিপথ থামিয়ে দেওয়া হয়েছে; তাদের ফিরে যেতে বলা হচ্ছে। তা না হলে অন্যদের মতো তাদের গ্রেপ্তার করা হবে।
বার্তা সংস্থা এএফপি ফ্লোটিলার মুখপাত্রকে উদ্ধৃত করে জানিয়েছে, ইসরায়েলি বাহিনী যে ১৩টি নৌকা নিয়ন্ত্রণে নিয়েছে, তাতে ইতালি ও স্পেনের নাগরিকের সংখ্যাই বেশি।
ওই বক্তব্যের পর অবশ্য ইন্সটাগ্রামে পোস্ট করা এক ভিডিওতে আবুকেশেক বলেন, “আমাদের মিশন চলছে।”
অবশিষ্ট নৌকাগুলোর কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, “তারা দৃঢ়প্রতিজ্ঞ, তারা অনুপ্রাণিত, আর তারা যা কিছু সম্ভব করছেন, যেন অবরোধ ভেঙে গাজায় পৌঁছাতে পারেন।”
গ্লোবাল সুমুদ ফ্লোটিলাকেই গাজা ফ্লোটিলা বলা হচ্ছে। আলজাজিরা লিখেছে, গাজা ফ্লোটিলা অর্থাৎ গাজার উদ্দেশে রওনা হওয়া নৌকার বহরে রয়েছেন বিশ্বের বিভিন্ন দেশের পাঁচ শতাধিক অধিকারকর্মী, রাজনীতিক, কূটনীতিক ও জলবায়ুকর্মী।
এই অধিকারকর্মীদের মধ্যে বিশ্বজুড়ে জলবায়ু আন্দোলনের জন্য বিশেষভাবে পরিচিত গ্রেটা টুনবার্গ রয়েছেন, যাকে গ্রেপ্তার করেছে ইসরায়েলি হানাদারা বাহিনী। তাকে গ্রেপ্তারের মুহূর্তের ভিডিও ফুটেজ প্রকাশ করেছে দ্য গার্ডিয়ান।
এই ফুটেজ ইসরায়েলের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে ছাড়া হয়; সেখান থেকে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম সংগ্রহ করেছে। ভিডিওতে গ্রেটার সঙ্গে তার সহযোগীদের দেখা গেছে।
ফ্লোটিলায় অংশ নিয়েছেন বাংলাদেশের প্রখ্যাত আলোকচিত্রশিল্পী ও অধিকারকর্মী শহিদুল আলম। তিনি এখনো আটক হননি বলে মনে করা হচ্ছে। অবশ্য ইসরায়েলি বাহিনী বলছে, সব নৌকার গতিপথ থামিয়ে দেওয়া হয়েছে।
ফ্লোটিলার ‘কনসায়েন্স’ নামে নৌকায় রয়েছেন শহিদুল আলম। বুধবার রাতে ফেসবুকে তার দেওয়া পোস্ট নজর কাড়ে দেশের মানুষের।
তিনি লেখেন, “আমি আমার বুকে আবু সাঈদকে পরিধান করেছি, যিনি সশস্ত্র পুলিশের সামনে তার বুক উন্মুক্ত করে দিয়েছিল। ২০২৪ সালের ১৬ জুলাই তাকে হত্যা করা হয় কিন্তু এটি শেখ হাসিনার পতনের আন্দোলনের মোড় ঘুরিয়ে দেয়।”
শহিদুল আলম আরো লেখেন, “ইতিহাসে যারা স্থিতাবস্থাকে (স্ট্যাটাস কো) চ্যালেঞ্জ জানিয়েছিলেন, তারাই সবকিছু বদলে দিয়েছেন। আজ ফ্লোটিলা ‘কনসায়েন্সে’ থাকা ব্যক্তিরা, ঢেউয়ের মধ্যে অগ্রভাগে থাকা নৌকার অন্যরা এবং বিশেষ করে যারা ফিলিস্তিনি জনগণের অধিকারের জন্য গাজায় তাদের জীবন ঝুঁকির মুখে ফেলেছেন, তারাই ইসরায়েল এবং তার মিত্রদের গণহত্যামূলক কর্মকাণ্ডকে চ্যালেঞ্জ জানাচ্ছে।”
“কিন্তু আমরা একা নই। বিশ্বজুড়ে কোটি কোটি মানুষ ইতিহাসের সঠিক পাশে দাঁড়িয়ে আছে। আমরা তাদের সম্মিলিত ক্ষোভের প্রতিনিধিত্ব করি। ফিলিস্তিনকে মুক্ত করার জন্য আমরা যা কিছু করতে পারি, তা করব। ফিলিস্তিন স্বাধীন হবেই,” লেখেন তিনি।
গাজা ফ্লোটিলা থেকে নিজের ভেরিফায়েড ফেসবুক ওয়ালে মাঝে মাঝে পোস্ট দিচ্ছিলেন শহিদুল আলম। সবশেষ ৫ ঘণ্টা আগে এক বার্তায় তিনি ফিলিস্তিনের স্বাধীনতা না আসা পর্যন্ত এই লড়াই চলবে বলে দৃঢ় ভাষ্য উচ্চারণ করেছেন।
অবশ্য ৮ ঘণ্টা আগে দেওয়া আরেক পোস্টে শহিদুল আলম লেখেন, “আজ (বুধবার) রাতে সমুদ্র ক্রুদ্ধ হয়ে উঠেছিল, আর আমরা বজ্রপাত ও ঝড়ের আগে আগে যেতে লড়াই করেছি।”
একই পোস্টে তিনি লেখেন, “আমাদের দ্রুত চলার আরেকটি কারণ ছিল, খবর এসেছে যে ইসরায়েলি জলদস্যুরা সামনের জাহাজ ‘আলমা’র দিকে এগিয়ে আসছে। এটাই তাদের কৌশল। আমাদেরটা সবচেয়ে বড নৌকা, আর আলমাকে আক্রমণ করে তারা আমাদের ভয় দেখাতে চাইছে। কিন্তু আমরা ভীত হব না।”
“আমরা এই ঝড়ো রাতে বের হয়েছি একটি বার্তা দেওয়ার জন্য এবং গান গাওয়ার মাধ্যমে আমাদের সংহতি প্রকাশ করার জন্য। আমরা জানি আপনিও আমাদের পাশে আছেন। উঠে দাঁড়ান। প্রতিরোধ করুন। ন্যায়বিচারের লড়াইয়ে আমরা হাল ছাড়তে পারি না,” বলেন শহিদুল আলম।
এই বার্তা দেওয়ার পর শহিদুল আলম ফ্লোটিলার সর্বশেষ অবস্থান জানিয়ে আর কোনো পোস্ট দেননি। অবশ্য আগের পোস্টে বহরের একেবারে শেষ নৌকায় রয়েছেন বলে জানিয়েছিলেন তিনি। আর ইসরায়েলি বাহিনী আটক করেছে সামনের দিকের ১৩টি নৌকা। ফলে তিনি আটক হয়েছেন কি না, সে বিষয়ে সবশেষ তথ্য পাওয়া যায়নি।
গ্লোবাল সুমুদ ফ্লোটিলায় অংশ নিয়েছে বিভিন্ন দেশের ৪৩টি নৌকা। এই বহরের মুখপাত্র সাইফ আবুকেশেক ইনস্টাগ্রামে ‘মিশন আপডেট’ নামে পোস্ট দিচ্ছেন।
আবুকেশেক তাতে নিশ্চিত করেছেন, গাজা সৈতক থেকে ভূমধ্যসাগরে ৭৫ কিলোমিটার দূরে ১৩টি নৌকা কব্জায় নিয়েছে ইসরায়েলি বাহিনী।
তিনি বলেছেন, এসব নৌকায় ৩৭টি দেশের ২০০ জনের বেশি অধিকারকর্মী রয়েছেন। এর মধ্যে স্পেন থেকে ৩০ জন, ইতালি থেকে ২২ জন, তুরস্ক থেকে ২১ জন এবং মালয়েশিয়া থেকে ১২ জন অংশ নিয়েছেন।
দ্য সান লিখেছে, গ্রেপ্তার করে অধিকারকর্মীদের ইসরায়েলের আশদোদ বন্দরে বন্দি রাখা হয়েছে। আইনি প্রক্রিয়া অনুসরণ করে তাদের মুক্ত হতে হবে।
পূর্বাপর
ইসরায়েলের গণহত্যা অভিযানে গাজার অন্তত ৬৬ হাজার মানুষ নিহত হয়েছেন, গুরুতর আহত হয়ে জীবনের সঙ্গে লড়ছেন প্রায় দেড় লাখ। বহু শিশু অনাহার-অর্ধাহারে মায়ের কোলে মারা যাচ্ছে, কঙ্কালসার সন্তান প্রসব করছেন গাজার মায়েরা। আর সব বয়সি মানুষ দুর্ভিক্ষের মধ্যে ধুকছে।
শুরুর দিকে বিশ্ব সম্প্রদায় নিশ্চুপ থাকলেও কয়েক মাস হলো ইউরোপ, এশিয়া ও দক্ষিণ আমেরিক ও আফ্রিকার বেশিরভাগ দেশ ইসরায়েলি আগ্রাসন বন্ধের পক্ষে সোচ্চার হয়েছে। যুক্তরাজ্য, ফ্রান্সহ অনেক দেশ ফিলিস্তিনকে স্বাধীন রাষ্ট্রের স্বীকৃতি দিয়েছে। এ নিয়ে উত্তাপ ছড়িয়েছে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের অধিবেশনেও।
শুধু যুক্তরাষ্ট্রের জোরালো সমর্থনে এখনো গণহত্যা চালিয়ে যাচ্ছে ইসরায়েল। বিশ্বের অধিকারকর্মীরা যখন গাজা ফ্লোটিয়া নিয়ে পৌঁছানোর চেষ্টা করছেন এবং অধিকাংশ দেশ যখন এই ফ্লোটিলার পক্ষে রয়েছে, তখনো গাজায় নরহত্যা অব্যাহত রেখেছে দখলদার ইসরায়েল।
আলজাজিরার সবশেষ খবরে বলা হয়েছে, বুধবারও (১ অক্টোবর) গাজায় ৯৩ জনকে হত্যা করেছে ইসরায়েল। ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর ইসরায়েলে অতর্কিতে হামলা চালায় গাজার হামাস। তাতে নিহত হন ইসরায়েলের প্রায় বারশত জন। একই দিন থেকে প্রতিশোধের যুদ্ধ শুরু করে ইসরায়েল, যার আর কোনো শেষ নেই। একতরফা গণহত্যার এই যুদ্ধে জ্বলেপুড়ে ছারখার হয়ে গেছে গাজা, নজিরবিহীন অবরোধের কারণে দুর্ভিক্ষে মরছে মানুষ। এই অবরোধ ভাঙতেই গ্লোবাল সুমুদ ফ্লোটিলার মিশন এখন চূড়ান্ত পর্যায়ে।
গাজা ফ্লোটিলা পথিপথ রুখে দিতে ইসরায়েলিরা হানা দেয়, যার প্রতিবাদে দেশে দেশে বিক্ষোভ হচ্ছে। এরই মধ্যে আর্জেন্টিনা ও ইতালিতে বিশাল র্যালি হয়েছে। মালয়েশিয়া, কলম্বিয়া, ভেনেজুয়েলাসহ অনেক দেশের রাষ্ট্র ও সরকারপ্রধান ইসরায়েলের নিন্দা করে অধিকারকর্মীদের নিঃশর্ত মুক্তি দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন।
কলম্বিয়া থেকে ইসরায়েলের সব কূটনীতিককে বহিষ্কার করা হয়েছে এবং কালবিলম্ব না করে তাদের দেশ ছাড়ার নির্দেশ দিয়েছে কলম্বিয়া সরকার।
ভয়েস/আআ