মঙ্গলবার, ২১ অক্টোবর ২০২৫, ১০:০৫ অপরাহ্ন
একটি ক্ষুদ্র সিলিকন টুকরো আজকের বিশ্বে নিয়ন্ত্রণ করছে রাজনীতি, অর্থনীতি ও প্রযুক্তির ভবিষ্যৎ। নাম তার চিপস বা সেমিকন্ডাক্টর। এ যুগে ‘জ্বালানি’ বলা হচ্ছে চিপসকে, যার গুরুত্ব বেড়েই চলেছে। স্মার্টফোন, রোবট, যুদ্ধবিমান, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, এমনকি সাধারণ ফ্রিজ- সবখানেই চিপস অপরিহার্য। কিন্তু চিপস কেবল প্রযুক্তির প্রতীক নয়; এটি এখন ক্ষমতার মূল উৎস। যে দেশ উন্নত চিপ তৈরি করতে পারে, সে আধুনিক বিশ্বের প্রযুক্তি ও অর্থনীতি নির্ধারণ করে এবং সামনের দিনে আরও প্রভাবশালী হয়ে উঠবে।
এই ধারণাই জন্ম দিয়েছে ‘চিপস জিওপলিটিক্স’-এর, যেখানে যুক্তরাষ্ট্র, চীন, তাইওয়ান, দক্ষিণ কোরিয়া ও ইউরোপ প্রতিনিয়ত প্রতিযোগিতায় লিপ্ত। যুক্তরাষ্ট্র দীর্ঘদিন ধরে চিপস শিল্পের শীর্ষে। তারা ডিজাইন করে, উদ্ভাবন করে এবং এনভিডিয়া, ইন্টেল, এএমডির মতো প্রতিষ্ঠানগুলোর মাধ্যমে বিশ্ববাজার নিয়ন্ত্রণ করে। কিন্তু চীনের দ্রুত উত্থান ওয়াশিংটনের কাছে বড় হুমকি। ২০২২ সালে যুক্তরাষ্ট্র পাস করে ‘চিপস অ্যান্ড সায়েন্স অ্যাক্ট’। উদ্দেশ্য ছিল ৫২ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ দিয়ে দেশীয় উৎপাদন বাড়ানো। লক্ষ্য একটাই- তাইওয়ান ও চীনের ওপর নির্ভরতা কমানো এবং সেমিকন্ডাক্টর শিল্পকে জাতীয় নিরাপত্তার অবকাঠামো হিসেবে গড়ে তোলা।
অন্যদিকে চীন ‘মেইড ইন চায়না ২০২৫’ কর্মসূচির মাধ্যমে নিজস্ব চিপস সক্ষমতা তৈরি করছে। তারা জানে চিপস আমদানিনির্ভরতা মানে প্রযুক্তিগত পরাধীনতা। যুক্তরাষ্ট্র এই ক্ষেত্রে কঠোর পদক্ষেপ নিয়েছে, হুয়াওয়ে ও এসএমআইসির মতো চীনা প্রতিষ্ঠানকে উন্নত চিপ তৈরি করতে রেস্ট্রিকশন দেওয়া হয়। এভাবে চিপস হয়ে উঠেছে নতুন ঠান্ডা যুদ্ধের কেন্দ্রবিন্দু, যেখানে অস্ত্র নয়, সিলিকনই শক্তির প্রতীক।
চিপস রাজনীতির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ খেলোয়াড় তাইওয়ান। বিশ্বের প্রায় ৬৫ শতাংশ উন্নত চিপস এই ছোট দ্বীপে তৈরি হয়, যার মধ্যে তাইওয়ান সেমিকন্ডাক্টর ম্যানুফ্যাকচারিং কোম্পানি বা টিএসএমসি একাই নেতৃত্ব দিচ্ছে ৩-ন্যানোমিটার প্রযুক্তিতে, যা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, কোয়ান্টাম কম্পিউটিং ও আধুনিক সামরিক ব্যবস্থার জন্য অপরিহার্য। বিশেষ করে, সবচেয়ে উন্নত চিপের (৭ ন্যানোমিটারের নিচে) ক্ষেত্রে তাইওয়ানের শেয়ার ৯০ শতাংশের বেশি হতে পারে। তাইওয়ান কেবল অর্থনৈতিক নয়, কৌশলগতভাবেও বিশ্বব্যবস্থার হৃৎপিণ্ড। একে আঘাত করা মানে বৈশ্বিক প্রযুক্তি সরবরাহ অচল করা। ওয়াশিংটন তাইওয়ানকে রক্ষা করতে চায়, বেইজিং আবার এটিকে নিজেদের ‘অবিচ্ছেদ্য অংশ’ হিসেবে পুনর্দখল করতে চায়। তাইওয়ানের চিপ কারখানাগুলো একরকম ‘ডিজিটাল পারমাণবিক বোমা’, যার ধ্বংস মানে পুরো বিশ্ব অর্থনীতির ধস।
চিপসের রাজনৈতিক অর্থনীতি বোঝাতে গেলে একটি বিষয় স্পষ্ট- বিশ্বায়ন এখন দ্বিমুখী। একদিকে এটি সহযোগিতা তৈরি করে, অন্যদিকে নির্ভরতা ও নিয়ন্ত্রণের সুযোগ দেয়। একটি চিপের নকশা হয় যুক্তরাষ্ট্রে, উৎপাদন তাইওয়ান বা কোরিয়ায়, যন্ত্রপাতি আসে ইউরোপের এএসএমএল থেকে, কাঁচামাল জাপান ও নেদারল্যান্ডস সরবরাহ করে। সরবরাহ শৃঙ্খলার কোনো একটি অংশে বিঘ্ন মানেই পুরো শিল্পে প্রভাব। প্রযুক্তি-নিয়ন্ত্রণ মানেই বাজার-নিয়ন্ত্রণ, আর বাজার-নিয়ন্ত্রণ মানেই রাজনীতির নিয়ন্ত্রণ।
বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর জন্য চিপস শিল্প একটি বড় শিক্ষা। আমরা হয়তো এখনই চিপস তৈরি করতে পারি না, তবে অ্যাসেম্বলি, টেস্টিং, ডিজাইন সার্ভিস বা প্যাকেজিং খাতগুলোতে প্রবেশ করা সম্ভব। হাইটেক পার্কে সেমিকন্ডাক্টর জোন তৈরি, দক্ষ জনবল প্রশিক্ষণ এবং বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণ- এসবের মাধ্যমে বাংলাদেশ চিপস সাপ্লাই চেইনে যুক্ত হতে পারে।
ভারত ইতোমধ্যেই নিজস্ব সেমিকন্ডাক্টর নীতি গ্রহণ করেছে, ভিয়েতনাম ও মালয়েশিয়া বিনিয়োগ আকর্ষণ করছে। বাংলাদেশও চাইলে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে মাইক্রোইলেকট্রনিকস ইঞ্জিনিয়ারিং ও ন্যানো টেকনোলজি শিক্ষাকে শক্তিশালী করে ভবিষ্যতের জন্য প্রস্তুত হতে পারে। চিপস কেবল প্রযুক্তির বিষয় নয়; এটি অর্থনৈতিক সার্বভৌমত্বের বিষয়।
আজকের বিশ্বে চিপসই নতুন ভূ-রাজনৈতিক অস্ত্র। এটি নির্ধারণ করছে কে হবে পরবর্তী শতকের প্রযুক্তি নেতা। যুক্তরাষ্ট্রের জন্য নিরাপত্তার প্রশ্ন, চীনের জন্য সার্বভৌমত্বের প্রশ্ন, বাকি বিশ্বের জন্য টিকে থাকার প্রশ্ন। এই ক্ষুদ্র সিলিকন টুকরো মানবসভ্যতার বৃহত্তম অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক গল্পের কেন্দ্রে অবস্থান করছে।
যে দেশ চিপস নিয়ন্ত্রণ করে, সে-ই নিয়ন্ত্রণ করছে ভবিষ্যৎ। বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর জন্য এখন সময় প্রস্তুতি নেওয়ার- শ্রম নয়, জ্ঞানের রপ্তানি হবে ভবিষ্যতের শক্তি।
ঘটনা হলোÑ ১৯৮৫ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সেমিকন্ডাক্টর টেকনোলজি রিসার্চ সেন্টার (এসটিআরসি) প্রতিষ্ঠিত হয়। এটি সেমিকন্ডাক্টর উপাদান, ডিভাইস ডিজাইন, ন্যানোমেটেরিয়ালস এবং ন্যানোটেকনোলজির ওপর গবেষণা করে থাকে। যদিও এই কেন্দ্রটি এখনো পূর্ণাঙ্গ চিপ উৎপাদনে প্রবেশ করতে পারেনি, তবে এটি শিক্ষার্থীদের প্রশিক্ষণ দিয়ে আসছে। ভবিষ্যতের জন্য প্রস্তুতি নিতে আরও জোর দিতে হবে।
বুয়েটের ইইই বিভাগ সেমিকন্ডাক্টর ডিভাইস ও টেকনোলজি বিষয়ে গবেষণা পরিচালনা করছে। নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটিতে মাইক্রোইলেকট্রনিক্স ও ভিএলএসআই ডিজাইন বিষয়ে কোর্স আছে। ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ে নিউরাল সেমিকন্ডাক্টরের সাথে যৌথ গবেষণা ও সেমিকন্ডাক্টর ডিজাইন ইকোসিস্টেম উন্নয়নে কাজ করছে।
এ ছাড়া বাংলাদেশ সেমিকন্ডাক্টর ইন্ডাস্ট্রি অ্যাসোসিয়েশন (বিএসআইএ) নামে একটি সংগঠন আছে, যা এ দেশের সেমিকন্ডাক্টর খাতের উন্নয়ন ও প্রচারে কাজ করে। এর লক্ষ্য ২০৩০ সালের মধ্যে সেমিকন্ডাক্টর রপ্তানি ১ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত করা। বর্তমানে দেশে ৭০০-এরও বেশি চিপ ডিজাইনার রয়েছে এবং প্রতি বছর ২০ হাজারের বেশি কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ারিং ও ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং গ্র্যাজুয়েট তৈরি হচ্ছে। এটা আশা জাগায়।
‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ কতদূর এগিয়েছে তা নিয়ে প্রশ্ন থাকলেও, ‘সিলিকন বাংলাদেশ’-এর রূপান্তর হলেই আমরা প্রযুক্তি ও অর্থনীতির ভবিষ্যতের দিকে দৃঢ়ভাবে এগোতে পারব।
বাংলাদেশে চিপস বা সেমিকন্ডাক্টর শিল্পের উন্নয়ন একটি সম্ভাবনাময় ক্ষেত্র হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। সরকারি, বেসরকারি ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর যৌথ প্রচেষ্টায় এই খাতে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি অর্জন সম্ভব। তবে পূর্ণাঙ্গ চিপ উৎপাদনে প্রবেশ করতে হলে উচ্চমানের গবেষণা, উন্নত অবকাঠামো এবং আন্তর্জাতিক সহযোগিতার প্রয়োজন।
বাংলাদেশ ও চীন সেমিকন্ডাক্টর, অপটিক্যাল টেকনোলজি ও উচ্চশিক্ষা খাতে নিজেদের মধ্যে সহযোগিতা বাড়াতে কাজ করছে। এ লক্ষ্যে গত ২৫ আগস্ট ঢাকায় এক অনুষ্ঠানে হুবেই সেমিকন্ডাক্টর ইন্ডাস্ট্রি অ্যাসোসিয়েশন ও বিএসআইএ’র মধ্যে দুটি এমওইউ সই হয়েছে। চুক্তি অনুযায়ী হুবেই সেমিকন্ডাক্টর অ্যাসোসিয়েশন বাংলাদেশে চিপ ডিজাইন ও সেমিকন্ডাক্টর উৎপাদনে সহায়তা দেবে। এ ছাড়া এর ফলে দুই দেশের মধ্যে প্রযুক্তিগত সহযোগিতারও সুযোগ তৈরি হবে।
সেমিকন্ডাক্টর খাতে বর্তমানে বাংলাদেশের বছরে প্রায় ৬০ লাখ মার্কিন ডলারের (৬ মিলিয়ন) রপ্তানি আয় আসছে। আগামী পাঁচ বছরের মধ্যে এই রপ্তানি আয় এক বিলিয়ন বা ১০০ কোটি ডলারে নিয়ে যাওয়া সম্ভব। এজন্য খাতটিতে বিনিয়োগকারীদের জন্য ১০ বছর কর অব্যাহতি, নির্দিষ্ট যন্ত্রাংশে শুল্কছাড় ও বিশেষ তহবিল সুবিধা দেওয়া প্রয়োজন। গত ৩ জুলাই বিকালে ঢাকার ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানায় বাংলাদেশের সেমিকন্ডাক্টর শিল্পের উন্নয়নে গঠিত জাতীয় টাস্কফোর্স কমিটি। লেখক:আজাদ-আল-আমিন
ভয়েস/জেইউ।